সাতকানিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কি?

সাতকানিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কি?

হয়তো শরমিন্দা হওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না– কিন্তু চারিদিকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এর আতশবাজির মাঝেই তিন কেজি চালের জন্য জমায়েতে লাশ পড়লো দশটি। বলা হচ্ছে ‘পদদলিত হয়ে মৃত্যু– কিন্তু সাতকানিয়ার গতকাল সোমবারের ঘটনাটি সকল অর্থেই ডেকে নিয়ে খুনের সঙ্গে তুলনা চলে। আগেও সেখানে এমনটি ঘটেছে এবং একই গোষ্ঠী কর্তৃক।

প্রচারমাধ্যম ‘পদদলিত হয়ে মৃত্যু’ বললেও এই প্রশ্ন তুলছে না মানুষগুলোকে সেখানে কে বা কারা ডেকে নিল? কেন ডেকে নিল? ডেকে নেয়ার পর কীভাবে তাদের মৃত্যুর শিকার হতে হল? এই মৃত্যুর দায় কার? শত শত মানুষের উপস্থিতি সামাল দিতে সেখানে পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থাপনা ছিল কি না? বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে জীবনের দাম থাকলে উপরোক্ত প্রতিটি প্রশ্নই অনুসন্ধানের দাবি রাখে বৈকি।

ঘটনার যে বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট, কোন ধরনের সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার আয়োজন ছাড়াই স্থানীয় নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গায় একটি মাদ্রাসার মাঠে ইফতার সামগ্রী দেয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে জড়ো করা হয়। কথিত ইফতার সামগ্রীর মধ্যে ছিল এক কেজি ডাল, তিন কেজি চাল ও অন্যান্য কিছু সামগ্রী।
কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) নামের স্থানীয় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ এই আয়োজনের হোতা। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এই কোম্পানিটি স্টিল ব্যবসায় অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের যেকোন আয়োজন পর্যাপ্তভাবে পরিকল্পিত হবে সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সংস্থার মালিকরা দানবীর হিসেবে আবির্ভূত হতে যেয়ে পবিত্র রমযান মাস আসার আগেই আগাম ইফতার সামগ্রী বিলাতে এত প্রচারণার আশ্রয় নিয়েছিল যে, সাতকানিয়া ছাড়িয়ে লোহাগড়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী– এমনকি বান্দরবান থেকেও লোক নিয়ে এসেছিল। নিহতদের তালিকায় সুদূর বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের বাসিন্দাদেরও পাওয়া গেছে। এসব মানুষকে অপেক্ষা করানোর জন্য কোন সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনাই ছিল না। অনেকে পূর্ব-রাত থেকেই দানসামগ্রী নিতে জড়ো হয়েছিলেন। অর্থাৎ অনেক আগে থেকে বহু লোকের সমাগম লক্ষ্য করা সত্তে¡ও আয়োজকরা মানুষের জীবন রক্ষায় সময় মতো উদ্যোগী হলে মৃত্যু-অধ্যায় এড়ানো যেত। অথচ আলোচিত কোম্পানিটির ওয়েব ঠিকানায় দেখা যাচ্ছে দেশজুড়ে তারা প্রতিনিয়ত গলফ টুর্নামেন্ট থেকে শুরু করে নানান ধরনের ইভেন্ট করে থাকে। কেবল গরীবের জমায়েতে এসে তাদের কর্পোরেট দায়িত্বশীলতা খুঁজে পাওয়া গেল না।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, মৃত্যুর শিকার মানুষগুলো ঠিক কি অবস্থায় মারা গেল সে বিষয়ে বিবরণ দেয়ার চেয়ে স্থানীয় প্রচারমাধ্যমগুলো এখন জোর দিচ্ছে কোম্পানির বক্তব্য প্রচারের ওপর। যথারীতি বলা শুরু হয়েছে ‘অত্যাধিক গরমে’ এবং ‘ডিহাইড্রেশনে’ সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যদি বিষয়টি তা হয়ও– সেক্ষেত্রে তার সত্যাসত্য রাষ্ট্রীয় তদন্তদলের হাতে ছেড়ে দেয়ার আগেই কিছু অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার প্রস্তাব কেন দিচ্ছে আলোচ্য কোম্পানিটি– সেও বোধগম্য নয়।

আমরা জানি, ইসলামে দান করাকে উৎসাহিত করা হলেও তা গোপনে করাই উত্তম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যদের অনুপ্রাণিত করতেই কেবল দানের বিষয় জানানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইদানিং রমযান এলেই একদল ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইমেজ বাড়াতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খয়রাতে নামেন। ইসলামে এধরনের কার্যক্রমকে বলা হয় ‘লোক দেখানো ইবাদত’। অনেক ফরজ কাজও– যেমন জাকাত প্রদান এখন লোক দেখানো ইবাদতে পরিণত হয়েছে।

জাকাত যার প্রাপ্য তার বাড়িতে যেয়ে দিয়ে আসার ব্যাপার হলেও নিয়মিতই দেখা যায়– প্রাপককে ঢেকে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে– কষ্ট দিয়ে, ভিড় বাড়িয়ে, ছবি তোলার নাম করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

আলোচ্য কোম্পানিটি কেএসআরএম-এর কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন তাই তোলাই যায়। প্রথমত তারা এই দান অনুষ্ঠানের পক্ষে যে মাইকিং করেছিল সেটা কোন ধর্মীয় বিধান মতে? মাইকিংয়ের কারণে বিপুল মানুষ জড়ো হবে জানা সত্ত্বেও কোম্পানির মালিক এই বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করেছিলেন কি না এবং প্রশাসন সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না।

প্রচারমাধ্যম বলছে, কেএসআরএম কথিত অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল। কিন্তু তা হলে বিতরণ কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট শ্রমিকপল্লী বা চট্টগ্রাম শহরে না হয়ে সাতকানিয়ার নলুয়ায় কেন? আসলে কি কোম্পানি আয়োজক ছিল নাকি এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দান ক্ষয়রাতের আয়োজন করেছিলেন? স্থানীয় মানুষ কিন্তু বলছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান নিজে এই আয়োজনের উদ্যোক্তা। তাহলে কী ব্যক্তির ভূমিকা আড়াল করতেই কোম্পানির নাম আসছে এখন সামনে?

ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, তাদের এই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আর চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার প্রচারমাধ্যমকে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন ‘অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে’ (দৈনিক আজাদি, ১৫ মে)। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোবারক হোসেন বলেছেন, উপজেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে অবহিতও করা হয়নি (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৫ মে)। স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে এই অব্যবস্থাপনাজাত মৃত্যুর জন্য কাউকে তদন্তপূর্বক গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না। যেহেতু আয়োজনটি ছিল জনৈক মোহাম্মদ শাহাজাহানের বাড়ির সামনে, তার দ্বারা– স্বভাবত অব্যবস্থাপনার দায় তার ওপরই বর্তায়। তদন্তদল এসব বিষয় খতিয়ে দেখবেন নিশ্চয়ই।

ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, পুলিশ সুপারের উপরোক্ত স্পষ্ট অভিমত সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা তার কোম্পানির কাউকে আটক করা হয়নি– বরং তারা এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার পক্ষে নিজেদের অবস্থানের যথার্থতা তুলে ধরেছে। সেই সংবাদ সম্মেলনের সাফাই স্থানীয় অনেক প্রচারমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার হচ্ছে– অথচ নিহতদের মেডিক্যাল রিপোর্ট সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন নেই। তবে সোমবার সংবাদ সম্মেলনেই আয়োজকদের তরফ থেকে স্বীকার করা হয়েছে, প্রায় ২০ হাজার মানুষকে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে– যে দেশে আর্থসামাজিক কোন বিষয়ে ৮-১০ জনের মানববন্ধন করতেও ইদানিং থানা-পুলিশের অনুমতি নিতে হয় সেখানে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে জড়ো করা হচ্ছে অথচ প্রশাসন তা অবহিত নয়।

এইরূপ হত্যালীলা অবশ্য চাটগাঁয়ে এবং বাংলাদেশে এবারই প্রথম নয়। অভিযোগ রয়েছে, ২০০৫ সালের অক্টোবরেও এই কেএসআরএম গ্রুপ একইভাবে ইফতার বিতরণের নামে আট ব্যক্তিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে– নানান উপলক্ষ্যে এভাবে গরীব মানুষকে লোভে ফেলে হত্যা চট্টগ্রামের ধনাঢ্যদের এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে বলা যায়। ১৯৯০-এর এপ্রিলে সেখানে আবুল বিড়ি কোম্পানির মালিক যাকাত দিতে যেয়ে ৩৫ জনের পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়েছেন। তখনও বলা হয়েছে এরা পদদলিত হয়ে মারা গেছে। সেবার আহত হয়েছিল আরও দুই শত জন। গত বছর ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে সাবেক মেয়রের মেজবান অনুষ্ঠানে একইভাবে মারা যায় ১০ জন। দেশের অন্যত্রও এভাবে মৃত্যুর আয়োজন অব্যাহত রয়েছে। রমযান এলেই এই শোকগাঁথায় নতুন নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়।

২০১৫ সালে ময়মনসিংয়েও একইভাবে ২৭ জনের হত্যর ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালে বরিশালে খান এণ্ড সন্স গ্রুপের যাকাত বিতরণকালে মারা যায় ২২ জন। এইরূপ মৃত্যুর মিছিল থামছে না কারণ কোথাও নিহত ও আহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়নি, হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে আইনগত পদক্ষেপও নেয়া হয়নি এবং তদন্ত প্রক্রিয়ার নামে ধীরে ধীরে প্রশাসনও নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

এইরূপ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যেকটির সঙ্গে দেশের বড় বড় ধনাঢ্য পরিবারগুলো যুক্ত বিধায় দ্রুতই নানান রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে ‘পদদলিত’ গল্পের ভেতরে অনুসন্ধানী প্রবেশ থেকে নিরস্ত্র করে ফেলা হয়। আশা করতে চাই এবার অন্তত চট্টগ্রামের মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা সেটা হতে দেবেন না।