যুক্ত্ররাষ্ট্রের ইসরায়েলি দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ভূয়সী প্রশংসা করেন ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকায়, ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ২৪০০ গুরুতর আহত হন। এই আক্রমণের পরে, সোমবার জেরুজালেমে প্রায় ৮০০ অফিসিয়ালের সামনে নেতানিয়াহু এই দিনকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ইসরায়েলের ইতিহাসের একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একদিকে হত্যা অন্যদিকে হাততালি ও শান্তির ভাষণ, এ যেন চরম এক নাটকের মঞ্চায়ন।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি পূরণ করায় নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন, ‘আগের চেয়ে বহুগুনে শক্তিশালী’।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে আপনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে আজকে একটা শুভ দিন। আপনি শুধু সত্যের মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং সত্য হচ্ছে, তিন হাজার বছর আগে থেকেই ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেম’।
অনেকে নেতানিয়াহুর কথাগুলোকে ভাল চোখে দেখেননি। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জা ইয়েভস লা দ্রিয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, এই দূতাবাস স্থানান্তর ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনের লঙ্ঘন।
জেরুজালেমকে মুক্ত কর
দূতাবাস স্থানান্তরের পরে দ্রুতই মহাসড়কের রাস্তায় ল্যাম্পোস্ট এবং গাছগুলো ‘ট্রাম্প মেইক ইসরায়েল গ্রেইট এগেইন’ লেখা প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে যায়।
দূতাবাসের বাইরে শতাধিক ফিলিস্তিনি এবং ইহুদী ইসরায়েলি আন্দোলনকারী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অস্বীকৃত এই দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিবাদ জানায়।
রাস্তায় নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যারিকেডের কারণে বেশিরভাগ আন্দোলনকারীই হেটে আসেন দূতাবাস এলাকায়। আন্দোলোনকারীদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা এবং ‘মেইক জেরুজালেম ফ্রি এগেইন’ এবং ‘নো টু ট্রাম্পস ইলিগাল ডিসিশন’ লেখা পোস্টার। ব্যারিয়ারের অপর দিক থেকে ইসরায়েলি পুলিশের আক্রমণের আগ পর্যন্ত পতাকা ও পোস্টার হাতে দূতাবাসের সামনে জমায়েত হয় আন্দোলনকারীরা।
আরো পড়ুন: জেরুজালেম সংকট-পরিক্রমা
ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ের সংগঠন ‘আল হাক’ এর আইনবিষয়ক গবেষক, রানিয়া মুহারেব আলজাজিরাকে বলেন, দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে ইসরায়েল, পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক অপসারণের এবং জেরুজালেমকে নিজেদের কর্তৃত্বে রাখার ‘সবুজ বাতি পেয়ে গেল’।
মুহারেব বলেন, ‘পূর্ব জেরুজালেম দখলের প্রথম থেকেই এই জোরপূর্বক অপসারণ চলছে, কিন্ত বিগত কয়েক মাসে শহর থেকে ফিলিস্তিনিদের অপসারণের মাত্রা ত্বরান্বিত করে, এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসকারীদের, জেরুজালেমের সাথে সংযুক্ত করছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে এবং এটা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বকে বৈধতা দিচ্ছে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রকেও উৎসাহিত করছে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করতে’।
দূতাবাস স্থানান্তরে সমর্থনকারী
ইসরায়েলি পুলিশ আন্দোলনকারী জনতার হাত থেকে ফিলিস্তিনের পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলে এবং মারধরের পর কমপক্ষে দুইজন ফিলিস্তিনিকে আটক করে।
শহরের আবাসিক ভবনগুলোর বারান্দা থেকে ইসরায়েলের পতাকা হাতে ইসরায়েলিরা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকরা প্রায়ই পানি ছিটিয়ে আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করে।
‘ট্রাম্প মেইক ইসরায়েল গ্রেট এগেইন’ লেখা নীল টি-শার্ট পরা লরা লুমার প্রতিবাদ আন্দোলনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আলজাজিরাকে জানান, ‘আগে থেকেই সেখানে ট্রাম্পের সমর্থক এবং আরো অনেকেই ছিল যারা দূতাবাসের স্থানান্তরের পক্ষে ছিল। সবকিছু শান্তিপূর্ণই ছিল, আন্দোলনকারীরা আসার পরই পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে’।
চব্বিশ বছর বয়সী ইহুদী আমেরিকান লরা লুমার নিউ ইয়র্কে থাকেন, কিন্তু দূতাবাস স্থানান্তরকে উদযাপন করতে তিনি জেরুজালেম আসেন। লরা বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের প্রতি আমার সমবেদনা দেখানো কঠিন, কারণ তারা নিজেদের হিংস্র উপায়ে প্রকাশ করছে’।
রাষ্ট্রের দ্বারা সন্ত্রাসবাদ
আট সপ্তাহ আগে শুরু হওয়া গাজা-ইসরায়েল বর্ডারে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রাণঘাতী আক্রমণে, সোমবার কমপক্ষে ৫৫ জন ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটে এবং আরো ২৪০০ জন আহত হন।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগঠন পিএলও’র সদস্য, ওয়াসিল আবু ইউসুফ এক বিবৃতিতে জানান, মৃতদের শোক প্রকাশ করতে, সকল ফিলিস্তিনি এলাকা থকে বৃহৎ আকারে বিক্ষোভ দেখা যাবে।
লুমারের মতে, মৃত্যুগুলোর জন্যে দায়ী হামাসের ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’। তিনি বলেন, ‘গাজা বর্ডারে যেয়ে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারী ফিলিস্তিনিদের সকলকে হামাস এক হাজার ডলার করে দিচ্ছে। গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে দেখাচ্ছে, কিন্ত তারা নিরপরাধ না’।
মুহারেব ইসরায়েলি আর্মিদের ওপর যুদ্ধাপরাধের দায় দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত, গুরুতর এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারী গণহত্যা’।
এখানেই থাকব
ফাদিল তাহবুদ নামের একজন জেরুজালেম নিবাসী বলেন, গত ডিসেম্বরে ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে গাজার পূর্ব তীরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারী শতাধিক ফিলিস্তিনিকে মারা হয়। তাহবুদ আলজাজিরাকে জানান, ‘বিচ্ছিন্ন, নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছে। দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা, ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং ইসরায়েলের দখল প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যকারী অবস্থান প্রকাশ করে’।
তিনি আরো বলেন, ‘জেরুজালেম ট্রাম্পের শহর না যে দিয়ে দিবে। আমরা এখানে বাস করছি এবং আমরা এখানেই থাকব। এখানে যা ঘটছে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে’।