নিয়মিত শরীরচর্চা, প্রতিদিন সময়মত ৮ ঘন্টার ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাবারতালিকা মেনে জীবনধারন, ওজন কমানোর জন্যে যেকোন স্বাস্থ্যবিদ কিংবা পুষ্টিবিদের পরামর্শ তালিকায় স্বাভাবিকভাবেই এই তিনটি বিষয় প্রথম দিকে থাকবে। বয়স, শারীরিক কাঠামো এবং শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী একেকজন মানুষের জন্যে ওজন কমানোর ব্যায়াম, খাদ্যতালিকা এবং তৎসংক্রান্ত নিয়মকানুন বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সবে সন্তান জন্ম দেয়া নতুন মায়েদের জন্যে শরীরের বাড়তি ওজন কমানো কিছুটা সমস্যার হতে পারে। যেহেতু গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের ওজন খুব দ্রুত এবং প্রায়শই কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছাড়াই বেড়ে যায়, এবং সন্তান জন্মদানের পরে সেই বাড়তি ওজন কমানোর ঝোঁকও হঠাৎ করে মায়েদের মাথায় চেপে বসে, তাই এই বিষয়টিতে বাড়তি যত্ন এবং সাবধানতার আশ্রয় নেয়াই শ্রেয়, কেননা মায়ের সাথে এক্ষেত্রে শিশুর স্বাস্থ্যও জড়িত।
শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি বাড়তি ওজন কমানোর জন্যে প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকা এবং জীবনাচারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাওয়া মায়েদের অবশ্য নিরাশ হবার কিছু নেই। সুস্থ একটি শিশু সন্তানের পাশাপাশি ঝরঝরে একটি শরীর পাওয়া খুব কঠিন হবে না, যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্বপরিকল্পিত একটি কর্মপরিকল্পনা আপনি মেনে চলেন।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সদ্য সন্তান জন্মপ্রদান করা মায়েদের সাহায্যে আসতে পারে এমন কিছু উপায় বা পরামর্শ এখানে উল্লেখ করা হল–
১. প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় যতবেশি সম্ভব সবুজ শাকসবজি এবং রঙ্গিন ফলমূলাদি রাখুন। হোল গ্রেইন বা গম, বার্লি, ওটের তৈরি শুকনো খাবার, আমিষের জন্যে মাছ এবং সয়া, নরম মুরগির মাংস, ডিম ইত্যাদি মা এবং শিশুর জন্যে সর্বনিম্ন চর্বির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, মিনারেলের সরবরাহ নিশ্চিত করবে যা একই সাথে মায়ের শরীরে শক্তি যোগাবে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন প্রচুর পানি পান মায়ের শরীর থেকে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
২. প্রতিদিনের সকালের নাস্তায় স্বল্পচর্বিযুক্ত দুধের সাথে একবাটি হোল গ্রেইনের সিরিয়াল খাবারের মাধ্যমে জীবনাচারে পরিবর্তন শুরু করা যেতে পারে। প্যাকেটজাত সিরিয়ালের পরিবর্তে চিড়া কিংবা খই খেতে পারেন। সাথে প্রতিদিন একটি করে সিদ্ধ ডিম, এক কাপ দই, আঁশজাতীয় বিভিন্ন খাবার আপনার ক্ষুধা কমাবে এবং রুচি অক্ষুণ্ণ রাখবে।
৩. সিজারিয়ান অপারেশনের মধ্য দিয়ে যাওয়া মায়েদের শরীরে আত্ম-নিরাময়ের প্রবনতা বৃদ্ধিতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল, সবজি সাহায্য করে। লেবু, কমলা, আমলকি, টমেটো, আলু ভিটামিন সি এর সুলভমূল্য এবং সহজলভ্য উৎস।
৪. গর্ভকালীন সময়ের অভ্যাস অনুযায়ী সন্তান জন্মের পরেও মায়েদের ঘনঘন ক্ষুধা লাগা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। এমন সময়ে হালকা নাস্তা হিসেবে বিস্কুট, ভাজা চিড়া, মুড়ির মোয়া, চিনাবাদাম ইত্যাদি হাতের কাছে রাখতে পারেন।
৫. কোমর এবং তলপেটে হালকা চাপ ফেলে এরকম হালকা কিছু ব্যায়াম নিজের পছন্দ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী বেছে নিতে পারেন। গর্ভাবস্থায় শ্রোণিদেশীয় মাংসপেশিগুলো কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ে, এবং সন্তান জন্মদানের পরবর্তীতে এই পেশীগুলোর পুনরায় আগের শক্তিশালী অবস্থায় ফিরে আসা দরকার। কেননা পরিপাকতন্ত্রের কাজে এই পেশীগুলোর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জন্মদান প্রক্রিয়ার পরপরই এরকম ব্যায়াম কিছুটা কষ্টসাধ্য হতে পারে। প্রথমে সাধ্যমতো কয়েকটি ধাপ দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে ধাপগুলো বাড়ানোর চেষ্টা করুন। সময় লাগবে, প্রথমে কষ্ট হলেও ব্যায়ামের ফলাফল পেতে শুরু করলে আপনি নিজেই এই চেষ্টাটুকু উপভোগ করবেন।
৬. শ্রোণিদেশের উপযোগী ব্যায়ামগুলো আপনার কোমর এবং তলপেশের পেশিগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে পিঠের/মেরুদন্ডের ব্যাথা সাড়াতেও সাহায্য করবে। গর্ভাবস্থা থেকে জন্মদান পরবর্তী সময়গুলোতে পিঠের এবং কোমরের ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া মায়েদের সংখ্যা খুবই বেশি। তাই সময় এবং সুযোগ মত হালকা এবং সহজ কিছু ব্যায়াম আপনাকে স্বস্তি পেতে সহায়তা করবে। বর্তমানে বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক, গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী শারীরিক নানান বিষয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রিকা, ইন্টারনেট পেজ বা ইউটিউবে ছবি এবং ভিডিওসহ এই উপযোগী ব্যায়ামের নির্দেশনা পেয়ে যাবেন।
৭. পায়ের হাটুর ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রথমে ১০ সেকেন্ড করে ঘড়ির কাটার অভিমুখী চক্রাকারে হাটু ঘুরিয়ে পরবর্তী ১০ সেকেন্ড ঘড়ির কাটার বিপরীতে ঘুরাবেন। ব্যায়ামটি বসে, শুয়ে কিংবা দাড়িয়েও করতে পারেন। দিনে ৩-৪ বার ব্যায়ামটি করলে দ্রুত ফলাফল পাবেন।
৮. ওজন কমানোর হাটা সবচাইতে সহজ এবং সফল উপায় হতে পারে যদি আপনি নিয়মিত হাটাহাটি করেন। ভোর এবং বিকেলে খোলা পরিবেশে হাটাহাটি শরীরের বাড়তি ওজনের পাশাপাশি গর্ভকালীন এবং সন্তান জন্মদান পরবর্তী মানসিক বিষন্নতা মোকাবেলায় ও সাহায্য করবে আপনাকে।
৯. শারীরিক দুর্বলতা বা যেকোন কারণে ব্যায়াম আপনার জন্যে কঠিন হলে যথাযথ সার্টিফিকেট প্রাপ্ত নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে মেডিটেশন করতে পারেন। মেডিটেশন শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকে আপনাকে হালকা হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
১০. ওজন কমানোর চেষ্টায় আপনার শিশু সন্তানের কথা ভুলে যাবেন না। শিশুর জন্মের প্রথম ছ’মাস মায়ের শালদুধই শিশুর জন্যে একমাত্র খাদ্য। এ সময়ে মায়ের শরীরে ওজন কমানোর চেষ্টায় হুট করে ঘটা যেকোন পরিবর্তনে যেন শিশুর জন্যে প্রয়োজনীয় শালদুধের মান এবং পরিমাণের ঘাটতি না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।
বাড়তি ওজন, বাড়তি মেদ ঝেড়ে ফেলা যেকোন মানুষেরই একান্ত কাম্য। কিন্তু যেকোন বয়সে, যেকোন শারীরিক পরিস্থিতিতে ওজন বাড়ানো এবং কমানো সংক্রান্ত বিষয়গুলো স্বীকৃত চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে আপনার জন্যে উপযুক্ত পদ্ধতি বেছে নিন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আপনাকে দ্রুত, কার্যকরী এবং সুস্থ উপায়ে ওজন কমাতে সাহায্য করবে এবং মানসিক সাহস যোগাবে। সর্বোপরি, ভয় বা দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনের পথে এগিয়ে যান, আর আপনার এবং আপনার শিশুর একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুন।