মাসকট। বর্তমান দুনিয়ায় খেলাধুলার যে কোন ইভেন্টে মাসকট কমন ব্যাপার। এটি ছাড়া যেন ঠিক জমে না কিছু। মাসকটকে স্বাগতিক দেশের প্রতিনিধি বলা যায়। একে আবার ধরা হয় সৌহার্দ্যের প্রতীক হিসেবেও। ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মহাযজ্ঞ বিশ্বকাপেও মাসকট ব্যবহৃত হচ্ছে। মোট কুঁড়িটি আসর বসলেও মাসকট ছিল না প্রথম সাত আসরে। ইংল্যান্ডে প্রথম এর প্রচলন ঘটে। তারপর থেকে অব্যাহত মজাদার এই চরিত্রের যাত্রা। যাত্রাপথে ১৯৬৬’র মাসকটের মিলেছে আরো ১২জন সঙ্গী, রাশিয়ায় মিলবে আরেকজন। চলুন ঘুরে আসি তাদের দুনিয়া থেকে…
১৯৬৬, ইংল্যান্ড
• নাম : ওয়ার্ল্ড কাপ উইলি
• ডিজাইনার : রেগ হোয়ি
১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের অষ্টম আসর বসে ফুটবলের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের এক এবং একমাত্র বিশ্বকাপ জয় ছাড়াও সে আসর সবার মনে থাকবে অন্য কারণে। সেবারই প্রথম মাসকট দেখেছিল ফুটবলের বিশ্ব আসর। ওয়ার্ল্ড কাপ উইলি নামক পাপেট সিংহের শরীরে জড়ানো ছিল ব্রিটিশদের বিখ্যাত ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ। জার্সিতে বড় হরফে ইংলিশে লিখা ‘ওয়ার্ল্ড কাপ’ বুঝিয়েছে ইংল্যান্ডে বিশ্ব আসরের অবস্থান।
১৯৭০, মেক্সিকো
• নাম : হুয়ানিতো
• ডিজাইনার : মারি শাজ
১৯৭০ আসরটা জুলে রিমে ট্রফির শেষ বছর আর রঙিন জমানার শুরু। সে বছর থেকেই সাদাকালো ছেড়ে রঙিনভাবে শুরু হয় টিভি সম্প্রচার। মুকুটের মতো দেখতে চওড়া টুপি আর স্বাগতিক মেক্সিকোর কিটে সুদর্শন পুতুল বালক হুয়ানিতোকে বেশ প্রাণবন্তই লাগছিল। হুয়ানিতোর টুপিতে বড় করে লিখা ছিল ‘মেক্সিকো সেভেন্টি’।
১৯৭৪, পূর্ব জার্মানি
• নাম : টিপ ট্যাপ
• ডিজাইনার : **
বিশ্বকাপের দশম আসরেই বর্তমান ট্রফিটির পথচলা শুরু হয়। ওই আসরে তৃতীয়বারের মতো মাসকটের দেখা মিললেও এর আগের দুইবারের চেয়ে ভিন্নতা দেখে গেছে সেবার। দুইজন মাসকটকে একসাথে এর আগে দেখেনি বিশ্বকাপ। টিপ এবং ট্যাপ নামের দুই বালকের শরীরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে জার্মান জার্সি। অার তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে ‘WM’ যার পূর্ণরূপ ‘Weltmeisterschaft, World Cup’, বর্তমান জার্মানির ডাইম্যানশ্যাফট এর বিভক্ত রূপ। ১৯৭৪ সালকে জানান দিতে স্বভাবতই জার্সিতে ৭৪ সংখ্যাটি রাখা হয়েছিল। মূলত দুই শিশুর মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব জাগানোই ছিল লক্ষ্য।
১৯৭৮, আর্জেন্টিনা
• নাম : গাউচিতো
• ডিজাইনার : **
মাঠ দাপাচ্ছে বালক ফুটবলার গাউচিতো। মাথায় ক্যাপ, ক্যাপের মাথায় আবার আর্জেন্টিনা ৭৮ লিখা। ১-২৫ জুন, ১৯৭৮। প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য ছিল মাসকট গাউচিতো, পায়ে তার ফুটবল।
১৯৮২, স্পেন
• নাম : নারাঞ্জিতো
• ডিজাইনার : ফার্নান্দো মার্টিনেজ
নারাঞ্জিতো শব্দটি এসেছে নারাঞ্জো থেকে, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘কমলা’। অন্যান্য আসরগুলোতে বিভিন্ন প্রাণীর আদলে মাসকট তৈরি হলেও ফলের অবয়বে অভিনব মাসকটের দেখা একবারই মিলেছিল, ১৯৮২র স্পেন বিশ্বকাপে।
১৯৮৬, মেক্সিকো
• নাম : পিকে
• ডিজাইনার : স্পাইয়ো
আগের আসরে স্প্যানিশদের ফল মাসকটের পর মেক্সিকানরা এবার নিয়ে আসে সবজি বা মশলা। নিজেদের মাটিতে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ আয়োজনে শুরুতেই তারা ভিন্নতা আনে। লাতিনের বিখ্যাত সমব্রেরো টুপি, পায়ে ফুটবল নিয়ে ৮৬তে দেখা গেছে পিকেকে। চিকন দেহের পিকের নাম এসেছে পিকান্তে শব্দ থেকে, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ মরিচ। আদতে কাঁচামরিচের মাথায়ই টুপি পরিয়েছে লাতিন অঞ্চলের দেশটি।
১৯৯০, ইতালি
• নাম : সিয়াও
• ডিজাইনার : **
‘৮২, ‘৮৬ এর পর ভিন্নতা বজায় ছিল ‘৯০ এর আসরেও। মাসকটটি দেখতে একেবারেই আলাদা। তার শরীরটা লাঠির অবয়বে, মুখটা ফুটবল। লাল, সবুজ, সাদা রঙ ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় সারা গায়ে। সিয়াও মানে শুভেচ্ছা, ইতালিতে আপনাকে স্বাগতম।
১৯৯৪, যুক্তরাষ্ট্র
• নাম : স্ট্রাইকার
• ডিজাইনার : ওয়ার্নার ব্রাদার্স
প্রথমবারের মত মার্কিন মুলূকে বসে ফুটবল মহাযজ্ঞ। সেই যজ্ঞে মাসকট হিসেবে আমেরিকানরা উপস্থাপন করেছে সবচাইতে প্রিয় পোষা প্রাণী কুকুরকে। ‘স্ট্রাইকার, দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ পাপ’ নামের কুকুরের লাল, নীল, সাদা রঙের পোশাকে লিখা ছিল ‘USA 94’.
১৯৯৮, ফ্রান্স
• নাম : ফুটিক্স
• ডিজাইনার : ফেব্রিস পিয়ালোট
মোরগ, ফরাসিদের জাতীয় প্রতীক। সঙ্গত কারণেই বিশ্বকাপের মাসকট নির্বাচনে প্রাধান্য পেয়েছে এটি। ফুটিক্সের পুরো শরীর নীলে আবৃত, ঝুঁটির শোভা বাড়ায় লাল, আর ঠোঁট হলুদ রঙে। হাতে ফুটবল নিয়ে আটানব্বইয়ের আসরে ফ্রান্স দলের জন্য সত্যিকার অর্থেই সৌভাগ্য বয়ে এনেছে ফুটিক্স। ফুটিক্স নামটি এসেছে ১৮,৫০০ জনের ভোটাভুটির পর যেখানে মোরগের পরিচায়ক হতে লড়েছে জিম্বু, হোউপি, র্যাফি এবং গ্যালিক। মোট ভোটের ৪৭ শতাংশই পড়ে ফুটিক্সের ব্যালটে।
২০০২, কোরিয়া-জাপান
• নাম : এটো, ক্যাজ, নিক
• ডিজাইনার : **
এর আগে ১৯৭৪ সালে দুইজনের দেখা মিললেও কোরিয়া-জাপানে দেখা যায় একত্রে তিনজনকে। এশিয়ার মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে কোরিয়ার সেমিফাইনাল চমকের আগে চমক ছিল মাসকটের থিমেও। কম্পিউটার ভিত্তিক কাল্পনিক ফুটবল গেমে সৃষ্টি হয় চরিত্রগুলির। ফিকশনাল ফুটবল টিম ‘এটমোবল’ এর কোচের নাম এটো, ক্যাজ আর নিক ওই দলের খেলোয়াড়। চমৎকার ভাবনার সঙ্গে পুতুলগুলির কালার কম্বিনেশনও হয়েছিল দারুণ। কমলা, নীল, বেগুনি রঙ এবং চেহারার গঠনে এদের দেখতে যেন লাগছিল ভিনগ্রহীই।
২০০৬, জার্মানি
• নাম : গোলিও সিক্স
• ডিজাইনার : দ্য জিম হ্যানসন কোম্পানি
গোলিও, গোল+লিও। লিও অর্থ সিংহ, গোল মানে গোল’ই। ২০০৬ বিশ্বকাপের মাসকট সিংহটির পড়নে ছিল জার্মানির সাদা জার্সি, বুকে লেখা জার্মানি জিরো সিক্স।
২০১০, দক্ষিণ আফ্রিকা
• নাম : জাকুমি
• ডিজাইনার : আন্দ্রিয়েস ওদেন্ডাল
Zakumi-র ‘ZA’ এসেছে South Africa থেকে, ‘Kumi’ মানে দশ। জাকুমি একটি বিশেষ প্রজাতির চিতা বাঘ। সবুজ চুল, হলুদ সোনালী দেহে ফুটে উঠেছে আফ্রিকান ফুটবল দলের প্রতিচ্ছবি।
২০১৪, ব্রাজিল
• নাম : ফুলেকো
• ডিজাইনার : ব্রাজিলের ছয়টি ডিজাইনিং প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রয়াস
পর্তুগিজ ভাষায় ফুলেকো শব্দের অর্থ ফুটবল। আমিজুবি এবং জুজেকো এই দুটি নামকে পেছনে ফেলে প্রায় ১৭ লাখ ফুটবলপ্রেমী ভোটারের মধ্যে ৪৮% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয় ফুলেকো নামটি। মাসকটটি ব্রাজিলের পরিবেশ বৈষম্য, অর্থনৈতিক অবনতি এবং একই সঙ্গে খেলাধুলাকে তুলে ধরেছে। ফুলেকোকে সাজানো হয়েছিল সাদা রঙের টি-শার্টে যাতে ইংরেজিতে লিখা ‘ব্রাজিল ১৪’।
২০১৮, রাশিয়া
• নাম : জাবিভাকা
• ডিজাইনার : একতারিনা বোচারোভা
চোখে লাল চশমা, পরনে সাদা টি-শার্ট, লাল শর্টস বাদামি শরীর, সামনে লাথি খাবার অপেক্ষায় একটি ফুটবল। কল্পনায় ভেসে উঠছে সুদর্শন কোন পুরুষ। ভুল ভাসছে। এটি একটি ভাল্লুকের বর্ণনা। বলা হল এ বছরের রাশিয়া বিশ্বকাপের অফিশিয়াল মাসকট জাবিভাকার কথা।
২০১৬ সালের ২১শে অক্টোবর উন্মোচন করা হয় একে। তার আগে ভোট হয়। বাঘ, বিড়াল নাকি ভাল্লুক, কে হবে রাশানদের প্রতিনিধি? শঙ্কা উড়িয়ে ৫২.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে জাবিভাকা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে পাওয়া ফলাফল প্রকাশ কর হয় টিভিতে লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে।
**- অজ্ঞাত