প্রথম অধ্যায় : অদ্ভুত যুবক
পৃথ্বীরাজ থিয়েটার, মুম্বাই, ১৯৯২। জুন মাসের শুরু থেকেই টানা বৃষ্টিতে অচল জীবন। টানা বৃষ্টি শুরুর দিনটাতেই ফিল্মের রঙ্গিন জগতের একজন হবার স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাইয়ের বুকে পা রেখেছিল বাইশ বছর বয়সের অদ্ভুত এক যুবক। উত্তর প্রদেশে জন্ম নেয়া এবং দিল্লিতে পড়াশোনার পাট চুকানো সে যুবকের মুম্বাইয়ের ম্যাপে শুধু একটি জায়গার নাম ছিল; পৃথ্বীরাজ থিয়েটার। সেখানেই ঠাই নেয়া। দুপুরে ওয়েটারের কাজ, রাতভর ডায়ালগ প্রম্পট। এবং দুটোই বিনা পারিশ্রমিকে। ক্ষ্যাপাটে এ যুবক অল্প দিনেই নজরে আসে থিয়েটারের মানুষদের। তারা যখন প্রশ্ন করছে, যে এ কে? তখন সে যুবকটি আরো কাজ খুজছে করার জন্য! জানা গেল, সে খুব দ্রুত লিখতে পারে। বাড়তি হিসাবে যোগ হল লেখার কাজও।
দ্বিতীয় অধ্যায় : নামহীন লেখক থেকে ‘সত্য’
শুরু হল ভারতীয় টেলিভিশনে ডেইলি সোপের যুগ। টানা এপিসোড লেখার মত যোগ্য মানুষ দরকার। ডেইলি সোপ নির্মাতাদের মাথায় আসলো পৃথ্বীরাজ থিয়েটারের সে যুবকের কথা। প্রস্তাব আসতেই বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেল সে। কোন পারিশ্রমিক এমনকি ডেইলি সোপে নিজের নাম প্রচার ছাড়াই। একের পর এক এপিসোড লিখেই চলেছে সে, আর যেন কোন কিছুই নেই পৃথিবীতে। খুব দ্রুতই মিডিয়ায় নাম চাউর হল সে যুবকের। কিছুদিন পর পারিশ্রমিকও আসতে লাগলো। এমনই এক সময় প্রস্তাব আসলো মহেশ ভাটের কাছ থেকে। বেশ লোভনীয় একটি চুক্তি। সে সময়েই মনোজ বাজপাইয়ের পরামর্শে রাম গোপাল ভার্মা তার ‘সত্য’র জন্য প্রস্তাব দিলেন সেই যুবককে, কিন্তু অনেক কম পারিশ্রমিকে। দ্বিধা জাগা স্বাভাবিক, এক দিকে নগদ পয়সা অপর দিকে স্বপ্নের জগতের হাতছানি। সেই যুবকের মনে দ্বিধা জাগেনি। মুহুর্তে বেছে নিলেন সত্যকে। মুক্তির পর পুরো ভারতই নামটা জেনেছে, অনুরাগ কাশ্যপ। সত্য’র অনবদ্য স্ক্রিপ্ট এবং ডায়ালগ সৌরভ শুক্লার সাথে যৌথভাবে লিখেছিলেন তিনি।
তৃতীয় অধ্যায় : ‘সত্য’ থেকে ‘পাঁচ’; পরিচালক অনুরাগ
সত্যের সফলতায় বুদ হয়ে না থেকে অনুরাগ সুযোগ খুঁজতে লাগলেন ফিল্ম বানানোর; যে স্বপ্ন নিয়ে অচেনা মুম্বাইয়ে আগমন সেটি বাস্তবায়ন করার। শেষ পর্যন্ত শুরু হল নিজের প্রথম প্রজেক্ট ‘পাঁচ’ এর কাজ। ফিল্ম শেষ হলেও অনুরাগ শান্তি পাননি। কারণ, সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে, পরে প্রযোজকের সমস্যায় ‘পাঁচ’ কখনোই মুক্তি পায়নি। তাতে দমে না গিয়ে অনুরাগ হাত দিলেন পরবর্তী প্রজেক্ট ‘ব্ল্যাক ফ্রাই ডে’তে। যেটি মুক্তির জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দশ বছরেরও বেশি সময়। প্রথম সাফল্য আসলো দেবদাস এর আধুনিক ভার্সন ‘দেব-ডি’ দিয়ে। এরপর একে একে মুক্তি পেতে লাগল ‘গুলাল’, ‘মুম্বাই কাটিং’, ‘গার্লর্স ইন ইয়েলো বুট’। এরপরেই আসলো অনুরাগের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত প্রজেক্ট ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’। সমালোচক থেকে সাধারণ দর্শক, সবারই মন জয় করল ওয়াসিপুর। তবে, অনুরাগের যে ধারা, সেটির সূচনাকাল ধরা হয় ২০০৮-০৯ কে। সে সময়ের গুলাল, দেব-ডি দিয়ে তিনি অনেকটাই চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। পরবর্তীতে যে ধারা উপহার দিয়েছে ‘আগলি’ এবং ‘মুক্কাবাজ’ এর মত ফিল্ম।
চতুর্থ অধ্যায় : ‘ফ্যান্টম’ এবং প্রযোজক অনুরাগ
অনুরাগের ধারায় অনুপ্রাণিত অনেকেই তখন চেষ্টা চালাচ্ছিলেন প্রথার বাইরে গিয়ে পিওর রিয়েলিস্টিক ফিল্ম বানানোর। কিন্তু প্রযোজকদের অসহোযোগিতায় তাদের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যাচ্ছিল। এমন আরো দুইজন পরিচালক হচ্ছেন বিকাশ ভেল এবং বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানি। বিক্রমাদিত্যর প্রথম রিলিজ ‘উড়ান’ এর প্রযোজক অনুরাগ। উড়ান বেশ আলোচিত হয়েছিল সে সময়। প্রযোজনায় জড়িত ছিলেন ‘শয়তান’, ‘চট্টগ্রাম’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘শহীদ’ এর মত সিনেমায়। ২০১১ সালে অনুরাগ, বিক্রম এবং বিকাশের হাত ধরে জন্ম নেয় ‘ফ্যান্টম’। পরবর্তিতে তাদের সাথে যোগ দেন মধু ম্যান্টেনা। ফ্যান্টম এর প্রথম রিলিজ ছিলো ‘লুটেরা’। বিক্রমাদিত্যের এই ফিল্মটি সমালোচক মহলে প্রশংসিত হলেও মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে। শুরু থেকেই ফ্যান্টম একাধিক দর্শক এবং সমালোচকদের মন জয় করা ফিল্ম এর জন্ম দিয়েছে। ফ্যান্টমের ব্যানারে মুক্তি পাওয়া ‘কুইন’ জয় করে জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার। ফ্যান্টমের জন্য ২০১৫ সালটি ছিল মিশ্র। আনুশকা শর্মা প্রযোজক হিসাবে প্রথম রিলিজ ‘এনএইচ১০’ এ যুক্ত ছিল ফ্যান্টম। এরপর মুক্তি পায় ‘হান্টার’। দুটো ছবিই বেশ আলোচিত হয়। এ বছর ফ্যান্টমের ব্যানারে মুক্তি পাওয়া ‘মাসান’ ছিল ফ্যান্টমের অন্যতম আলোচিত সিনেমা। একই সাথে ‘বোম্বে ভেলভেট’ এর গায়ে লাগে বছরের অন্যতম ফ্লপ ফিল্মের তকমা।
পঞ্চম অধ্যায় : অনুরাগের অনুপ্রেরণা
অনুরাগের আগে যে আর্ট ফিল্ম একদমই হয়নি তা না। কিন্তু বর্তমানে আর্ট ফিল্মের যে অবস্থান সেটির পেছনে অনুরাগের অবদান অনস্বীকার্য। এর আগে যারা চেষ্টা করেছেন, দেখা গিয়েছে যে এক-দুটির পরে হয় তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন কিংবা কমার্শিয়ালের দিকে ঝুকেছেন। আর যারা চেষ্টা চালিয়েছেন তারাও সে অর্থে সফল হননি। আর্ট ফিল্ম যে শুধু সমালোচক না বরং সাধারণ দর্শকদের জন্যও উপভোগ্য সেটি দেখানোর কৃতিত্ব অনেকাংশেই অনুরাগের প্রাপ্য। এবং শুধু পরিচালক হিসাবেই না, নতুন পরিচালকদের জন্য প্রযোজক হিসাবেও দারুণ ভূমিকা রাখছেন অনুরাগ। এছাড়া কমার্শিয়াল ফিল্মে যাদের কদর নেই, কিন্তু অভিনয়ের সহজাত গুনে গুনী; এমন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই তুলে এনেছেন অনুরাগ। যার দুটি চমৎকার উদারহারণ হতে পারে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি এবং ভিকি কৌশল। অনুরাগ বলিউডে একজন ‘আউট সাইডার’। নামের শেষে কোনো ফিল্মি পরিবারের টাইটেল না থাকায় যাদের সংগ্রাম করতে হয় তাদের জন্যও অনুরাগ একটি অনুপ্রেরণার নাম। ‘মাসান’ ফিল্মের অভিনেত্রী শ্বেতা ত্রিপাঠি বলেছিলে, যাদের বলিউডে কোনো গডফাদার নেই, তাদের জন্য অনুরাগ আছেন। অারেক প্রযোজক গুণিত মঙ্গা বলেন, যারা স্বল্প বাজেটে ফিল্ম বানাতে চায়, কিন্তু সাহস করতে পারছিল না, অনুরাগ তাদের জন্য দারুণ এক আদর্শ।
ষষ্ঠ অধ্যায় : গল্পকার; সেলসম্যান নন
অনুরাগের ফিল্মগুলো নির্ভর করে নিরেট গল্পের ওপর। তথাকথিত বলিউডি মাশালা তাতে দেখা যায় না, যার জন্য অনুরাগের চরিত্রগুলো গান গাইতে জানলেও নাচতে জানে না। তার ফিল্মে নায়করা একাই দশজনকে ধসিয়ে দিয়ে আসে না। বরং কখনো ভালোবাসার জন্য হেরে যায়, হেরে যায় ক্ষমতার কাছে। একটি সাধারণ কাহিনীও যে টানা দুঘন্টা মানুষকে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে সেটিও প্রতিনিয়ত দেখিয়ে চলেছেন অনুরাগ। এর একটি চমৎকার নিদর্শন ‘আগলি’। রিয়েল লোকেশনে শ্যুটিং, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ইম্প্রোভাইজ করার অবাধ স্বাধীনতা, স্টারের বদলে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্ভরতা এবং স্বল্প বাজেট; খুব সহজে এ জিনিসগুলোকে বলা যায় অনুরাগের ট্রেডমার্ক। বিষয়টা এমন না, যে কমার্শিয়ালে তার ব্যাপক অরুচি বা কমার্শিয়াল ফিল্মের আর্টিস্টদের অগ্রাহ্য করেন তিনি। তাই অনুরাগ পরিচালিত বা প্রযোজিত ফিল্মগুলোতে দেখা যায় রণবীর কাপুর, রণবীর সিং কিংবা সঞ্জয় মিশ্রদের মত কমার্শিয়ালের নিয়মিত মুখগুলোকে। মজার বিষয় হল, অনুরাগ বা ফ্যান্টমের কোনো ‘তারকা’ নির্ভর ফিল্ম সে অর্থে সাফল্যের মুখ দেখেনি। ছোট বাজেটের গল্প নির্ভর ফিল্মগুলোই বরং মন কেড়েছে মানুষের।
সপ্তম অধ্যায় : সেন্সর ও সিস্টেমের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ
সাফল্যের গল্পটা এখন লেখা যত সহজ হয়ে যাচ্ছে, অনুরাগের জন্য বিষয়টা ঠিক ততটাই কঠিন ছিল। আউসাইডার হিসাবেই শুধু না, বরং নিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে সেন্সর বোর্ডের সাথে। সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে তো আলোর মুখই দেখল না ‘পাঁচ’। শুধু পাঁচই না, বরং কমবেশি প্রত্যেকটি ফিল্মের জন্যই সেন্সর বোর্ডের সাথে যুদ্ধে নামতে হয়েছে তাকে। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘উড়তা পাঞ্জাব’ এর মুক্তির জন্য তো আদালত পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে অনুরাগকে। সেন্সরের বাঁধা বলতে সাধারণত ‘অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট’ই মাথায় আসে প্রথমে। কিন্তু অনুরাগের বেলায় দেখা যায়, অ্যাডাল্ট কন্টেন্টের চেয়ে তিনি বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন ড্রাগ্স এবং ভায়োলেন্সের চিত্রায়ণ নিয়ে। কখনো বা ডায়ালগ নিয়ে। এ বিষয়গুলোও বেশ মজার। অনুরাগের বেশিভাগ গল্পের প্লটই ছোট শহরকে কেন্দ্র করে, সেখানকার একটি গুন্ডা যে শুদ্ধ বচনের বদলে গালিতেই স্বস্তিবোধ করবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ এটি নিয়েও বিপদে পড়েছেন তিনি। আর, পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স বা ড্রাগের যে চিত্রগুলো তার ফিল্মে দেখা যায়, সেগুলো যে নেহায়েত কল্পনাই নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিদিনকার খবরের কাগজেই। ভারতে যখন হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়, তখন জাত-পাতের মতন স্পর্শকাতর দৃশ্য ফিল্মের রিলেতে লেখার সাহস দেখাতে পারেন বলেই তিনি অনুরাগ। আর এ জন্য শুধু সেন্সর বোর্ডই না, লড়াই করতে হয় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধেও। একই রকমভাবে লড়াই চলে ‘সিস্টেম’র বিরুদ্ধেও। সিস্টেমের শিকার হয়ে কি করে স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যায়, তার সর্বশেষ নমুনা ‘মুক্কাবাজ’।
অষ্টম অধ্যায় : অর্জন
ব্যবসায়িক সাফল্যের যে প্রচলিত ব্যারোমিটার, সে বিবেচনায় কেউ যদি অনুরাগকে ব্যর্থ বলতে চান সেটি হবে বড় ভুল। কারণ তিনি স্থির বিশ্বাস নিয়ে যে ধারাটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সে ধারায় নিয়মিত ছবি হওয়া এবং সে ছবিগুলো নিয়ে দর্শকদের আগ্রহের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই বলে দেয় যে অনুরাগ ব্যর্থ নন। বরং স্লথ গতিতে হলেও এগিয়ে চলেছেন নিজের পথে। অনুরাগের একাধিক ফিল্ম কান, রোম চলচিত্র উৎসবসহ মর্যাদাপূর্ণ আসরগুলো মাত করে এসেছে। ‘আগলি’ এবং ‘মাসান’র জন্য পেয়েছেন স্ট্যান্ডিং ওভেইশন। মাসানের অভিজ্ঞতা নিয়ে শ্বেতা ত্রিপাঠি জানান যে বিষয়টি অকল্পনিয় ছিল। কারণ, স্ট্যান্ডিং ওভেইশনটার ব্যাপ্তি ছিল পাঁচ মিনিটের বেশি, এবং প্রায় সবার চোখই ছিল ভেজা। পরিচালক-প্রযোজক হিসাবে কান, সাংহাই চলচিত্র উৎসবের মত আসরে স্ট্যান্ডিং ওভেইশন পাওয়াটা যে কারো জন্যই স্বপ্নের। তবে যেভাবে তিনি এগুচ্ছেন তাতে আরো বড় কিছু যদি এসে যায় অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন সম্ভবত ‘মূলধারা’র ফিল্মগুলোকে ধাক্কা দেয়াটা। কারণ, শেষ কিছু ফিল্মের হিসাবই বলে দিচ্ছে অনুরাগের ফিল্ম এখন আর সমালোচকদের মাঝেই না, দাগ কাটছে সাধারণ দর্শকদের মনেও। এটি প্রকৃত অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে উঠতি পরিচালকদের জন্য দারুণ। আর এ ধারার সাফল্যের কারণেই, মিডিয়ায় বিশ বছর পার করে প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন সঞ্জয় মিশ্রের মতন আর্টিস্টরা।