মে মাসটি কেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো

মে মাসটি কেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো

বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তির জন্য এই মাসকে বেছে নেয়া কি কোন বিশেষ গুরুত্ববহন করে? চুক্তির বিষয়বস্তুর চেয়ে সময়ের বিবেচনাটি অনেকের কাছেই হয়তো অপ্রাসঙ্গিক ঠেকবে। কিন্তু চলতি মে মাসে যদি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আসামের দিকে নজর দেয়া হয়– তাহলে প্রশ্নটি খানিক প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
আসাম এই মূহূর্তে উত্তাল। এই মাসের শেষদিন, ৩১ মে, আসামের বহুল আলোচিত ‘এনআরসি’ (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন) বা নাগরিকদের তালিকা ঘোষণা করা হবে। আসন্ন এই ‘ঘোষণা’ নিয়ে আসাম জুড়ে উদ্বেগ রয়েছে। প্রায় ৬৮ লাখ পরিবারের ভাগ্য জড়িত এই ঘোষণার সঙ্গে এবং লাখ লাখ স্থানীয় মুসলমানকে এতে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে নাগরিকত্বহীন করে দেয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর এটা করা হচ্ছে শক্তিশালী স্থানীয় অসমীয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯৮৫ সালের এক ‘চুক্তি’র শর্ত হিসেবে। আসাম থেকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের তাড়ানো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রধানতম এক নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে।

আসন্ন এই এনআরসি অনুযায়ী তারাই আসামের নাগরিক– যারা বা যাদের পূর্বপুরুষ ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের আগে আসামে অবস্থানের পক্ষে ‘কাগজপত্র’ রয়েছে। আর এইরূপ ‘কাগজপত্র না থাকা’র মানে দাঁড়াচ্ছে সে অবৈধ অভিবাসী– সে বাংলাদেশি!

লক্ষ্যণীয়, ভারতের একটি প্রদেশের নাগরিকত্ব নির্ধারণের তারিখ নির্ধারিত হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের শুরুর একটি দিনকে অজুহাত হিসেবে সংশ্লিষ্ট করে। ভারতের কর্তৃপক্ষ সচেতনভাবেই এটা করেছে। পুরো বিষয়টি প্রথম থেকেই উস্কানিমূলক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এ নিয়ে কোনদিন কথা বলেছে বলে জানা যায় না।

আগেও পুনঃপুন এমন প্রচারণা ছিল এবং এমুহূর্তে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে আবার নতুন করে সেই প্রচারণা শুরু হয়েছে যে, যেহেতু আসামে লাখ লাখ মানুষ তাদের বসবাসসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখাতে পারছে না, যেহেতু এই মানুষরা সংখ্যাগরিষ্ঠই মুসলমান এবং এদের বিরাট এক অংশই যেহেতু বাংলায় কথা বলে সুতরাং এদের বাংলাদেশেই ফেরত পাঠানো উচিত। তবে যেহেতু ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন খুবই ভালো সুতরাং শেষোক্ত করণীয়টি আপাতত স্থগিত থাকা উচিত।’

সরাসরি ভারতীয় একটি মিডিয়া (দ্য কুইন্ট, ৪ জানুয়ারি) থেকে উদ্বৃতি তুলে ধরছি: Currently, the Indian Prime Minister enjoys a bonhomie with his Bangladeshi counterpart, who’s also readying for a crucial election in 2018. Considering the subject of deportation rakes up anti-India sentiment in Bangladesh, raising the need for a deportation mechanism at this point will not help India-Bangladesh relation.

অর্থাৎ যেহেতু এ মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাংলাদেশি প্রতিপক্ষের মাধুর্যমন্ডিত একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং যেহেতু শেষোক্ত জনের সামনে একটা সংকটপূর্ণ নির্বাচনের বছর এটা– সেহেতু এসময় আসামের মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া ভারত-বিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে তুলতে পারে (সুতরাং আপাতত তা স্থগিত থাকুক!)

তবে গত ৭ মে ‘স্ক্রল.ইন’-এ অরুণাভ সাইকিয়া এ বিষয়ে আরও সরাসরি লিখেছেন: In bilateral engagements between the two countries, India has not officially broached the subject. Analysts claim India’s reluctance is strategic; it does not want to upset ties with the current dispensation in Bangladesh.

সাইকিয়ার বক্তব্যের বাংলা তর্জমা সাধারণভাবে এইরূপ দাঁড়ায় যে, দু’ দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততাকে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়টি এনে ফোড়ন কাটেনি। বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতের এই অনীহা কৌশলগত; তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গতি-প্রকৃতিতে এই বিষয়টি এনে সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করতে চায়নি।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশও ভারতীয় এই অবস্থানের প্রতিদান দিতে বিলম্ব করলেও চূড়ান্তভাবে ভুল করেনি। ‘খুবই ভালো সম্পর্ক’-এর নবায়িত প্রমাণ হিসেবেই ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে নিয়েছে সে মে মাসেই; যে মাসের শেষ দিন আসামে এনআরসি’র চূড়ান্ত ঘোষণা আসছে।

অনেকেরই কাছেই এই দুইয়ে-দুইয়ে চার মেলানোটা অযৌক্তিক মনে হবে। তাদের চার-পাঁচ মাস পূর্বের পরিস্থিতি স্মরণ করতে বলব। যখন বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাবনা নিয়ে বাংলাদেশে নীতিনির্ধারক মহলে নেতিবাচক মনোভাব দেখে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে উষ্মা দেখা যাচ্ছিল এবং হঠাৎ করে সাময়িক সময়ের জন্য দুই দেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছিল। আর ঠিক তখনি আসামে হঠাৎ করেই এনআরসি’র একটা প্রাথমিক ফল ঘোষণা হয়। যার কয়েক লাখ মানুষকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে সীমান্তপথে ঠেলে দেয়ার আগাম শঙ্কা ছড়ায়। নিঃসন্দেহে সেই ঘোষণাটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা বড় বার্তা। ঠিক এই সময়েই আরাকানে হঠাৎ করেই ‘আরসা’ নামের একটি সংগঠনের উদয় হয়।

রোহিংগা টেউয়ের মুখে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রায় এক ঘরে বাংলাদেশের সামনে আরেকটি ‘আসাম-টেউ’ এর বোঝা বহনের শক্তি ছিল না। এখনও নেই। তাই বাংলাদেশকে ‘ভালো সম্পর্ক’-এর পথেই হাটতে হচ্ছে বারবার। সেই অন্তহীন ‘হাটাহাটি’রই অংশ ছিল গত কয়েক মাস ধরে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের অনেকগুলো প্রতিনিধিদলের দিল্লি গমনাগমন।

এক্ষেত্রে ভারতীয় ভূ-রাজনীতিবিদরা যেভাবে বিষয়টি পরিচালনা করেছেন তার প্রশংসা করতেই হয়। আসামে এই ‘বিদেশি’ সমস্যা প্রায় ৪০ বছর পুরানো। মূলত বাংলাদেশকে চাপে রাখতে এবং আসামের ভোটের রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রভাব কমাতেই সেখানে এই ইস্যুর জন্ম। ভারতের ২৯টি প্রদেশের কোথাও এনআরসি হয়নি। কারণটি অবোধগম্য নয়। জম্মু ও কাশ্মীরের বাইরে আসাম ব্যতীত অন্য কোন প্রদেশে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে তেমন প্রভাব-প্রতিপত্তি ধারণও করে না।

বাংলাদেশের সঙ্গে আসামের সীমান্ত প্রায় অনেকটাই অত্যাধুনিক সেন্সর প্রযুক্তি সম্বলিত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। তারপরও প্রতিনিয়ত সেখানে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ‘গল্প’গুলো প্রচার হয়ে চলেছে। কারণ আসামের মুসলমান ভোট ৩০ শতাংশ অতিক্রম করার পরই ভারতজুড়ে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। এনআরসি’র মধ্যদিয়ে আসামের দরিদ্র মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাজ্যটির রাজনৈতিক সমীকরণে মুসলমানদের প্রভাব যেমন খর্ব করা যাবে তেমনি একই ‘পণ্য’কে সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশকেও নমনীয় করা গেল। বিগত দিনগুলোতে সম্পর্কে অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোতে ভারতীয় প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সফল ছিল না। সেই খরা কেটেছে এবার।

গুয়াহাটি এবং নয়াদিল্লিতে সর্বশেষ বলা হচ্ছে, এনআরসি’র মাধ্যমে যারা নাগরিকত্বহীন হয়ে যাবে তাদের এমন একটা ‘পরিচয়পত্র’ দেয়া হবে যা দিয়ে তারা ভারতে কাজ করতে পারবে কিন্তু ভোট দিতে পারবে না। অর্থাৎ আসামের এই মুসলমানদের বড় এক অংশ সেখানে মজুর হিসেবে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে– তবে দেশটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে না। মূলত এটাই ভারতের অন্যসকল স্থানের জন্যই আরএসএস-বিজেপি পরিবারের অকথিত মূল আকাঙ্খা। আসামে এনআরসি অধ্যায়ের মধ্যদিয়ে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একটা ভালো সূচনা হল। তারই স্মারক হিসেবে গত মাসে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাঙ্গমা এবং কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যৌথভাবে জানিয়েছেন, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে অবৈধ অভিবাসী (পড়ুন ‘মুসলমান’)দের এভাবে ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেয়া হবে।

তবে এই ‘প্রকল্প’-এর বিরুদ্ধে বিজেপির একাংশ এখনও উচ্চকিত। তাদেরই একজন আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, ৩১ মে’র পর অবৈধ ঘোষিত সকলকে চলে যেতে হবে। উল্লেখ্য, হিমান্তই হলেন আসামে এনআরসি প্রকল্পের সমন্বয়ক এবং তাঁর ঘোষণাটি ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’র পরও বাংলাদেশকে চাপে রাখার একটা কৌশল হিসেবেও দেখা যায় বৈকি। উপরোক্ত সকল বিবেচনাতেই বাংলাদেশর জন্য ২০১৮-এর মে মাসটি ঐতিহাসিক বটে।