‘কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,
তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।
এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে_
তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?’
কবিতার এই কয়েক চরণ সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাংশ থেকে নেয়া। ‘আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা লুজান’ নামক এক টেকো স্প্যানিশের স্মরণে। সদ্যজাত শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর কাঁদতে থাকে অনর্গল। বাকিরা উল্লাসে হাসে। কালের বিবর্তনে বুড়িয়ে যাওয়া শিশুর প্রস্থানে তার আশপাশ কান্নায় ভাসে। নিশ্চল প্রাণের করার থাকে না কিছু। ইনিয়েস্তার বেলাতেও তাই! স্পেনের বার্সেলোনা শহরের নাম ভূমিকায় থাকা ক্লাব বার্সার একাডেমি ‘লা মাসিয়া’য় যখন আসেন, পরিবার ছেড়ে আসার কষ্টে তিনি কেঁদে যান কেবল। দেড়যুগ পরে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে ঘর ছাড়ার সময়ে ওই তিনিই নির্বাক। বোবা কান্নায় হয়ত নিজেকে সামলাচ্ছেন!
আচ্ছা, ইনিয়েস্তা কে?
যার খেলায় খুঁত খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হতে হয় তিনি ইনিয়েস্তা। যার খেলা দেখতে বসলে সম্মোহিত হতে হয় তিনি ইনিয়েস্তা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকরা নিজেদের মাঠেই শত্রুশিবিরের সেরা অস্ত্রকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো ব্যক্তি হচ্ছে ইনিয়েস্তা। ২০০৯ এর সর্বজয়ী বার্সা টিমের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর। সেই বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল দ্বিতীয় লেগে চেলসির বিপক্ষে গোলের জন্য মরিয়া থেকেও চেলসি গোলরক্ষক পিওতর চেককে ফাঁকি দিতে ব্যর্থ মেসি-ইতোরা। ত্রাতার ভূমিকায় ইনিয়েস্তা। শেষমূহুর্তে চোখধাঁধানো গোল এবং বার্সা ফাইনালে। সেই গোলের পর হলুদ জার্সি খুলে তা ঘুরাতে ঘুরাতে তার উদ্যাম দৌঁড় ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবে অনেক অনেকদিন। ওই গোলের সুবাদে খুলে যায় বার্সেলোনার শিরোপা দুয়ার, সে দুয়ার দিয়ে একে একে ন্যু ক্যাম্পে পেপ অ্যান্ড কোং নিয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপ আর ক্লাব বিশ্বকাপ।
বার্সেলোনার একসময়ের মধ্যমাঠের সেরা অস্ত্র জোসেফ গার্দিওলা একবার বলেছিলেন, ইনিয়েস্তা একদিন শাসন করবে ফুটবলবিশ্ব! শাসন না হোক, গার্দিওলার কথার সত্যতা পেয়ে গেছে বিশ্ববাসী। শেষমূহুর্তে গোল দিয়ে কেবল চেলসিকে নয়, কাঁদিয়েছেন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলকেও, বিশ্বকাপের ফাইনালে! ১১৮ মিনিটে দেওয়া কোনাকুনি শটের দৃষ্টিনন্দন গোলে সমৃদ্ধ হয়েছে স্পেনের ট্রফিকেস, স্প্যানিশদের এনে দিয়েছে গর্বের উপলক্ষ্য।
স্প্যানিশ ম্যাটাডোরদের জার্সি ২০০৬ সালে গায়ে জড়ানোর পর থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১২৪ ম্যাচে, গোল ১৩টি। বার্সার হয়েও আছে ৫৭ গোল। ইনিয়েস্তা গোল করেছেন এমন ম্যাচে পরাজয়ের স্বাদ পায়নি বার্সেলোনা এবং স্পেন। তার গোল মানেই না হারার নিশ্চয়তা! ক্লাব-দেশ, বয়সভিত্তিক দল মিলিয়ে জিতেছেন ৩৬টি মেজর শিরোপা! অাছে বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো শ্রেষ্ঠত্ব। বগলদাবা করেছেন অজস্র ব্যক্তিগত সম্মাননা। যার একটি ২০১০-এ পাওয়া ‘প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড’। আরেকটি ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘গোল্ড মেডেল অব দি রয়্যাল অর্ডার অব স্পোর্টিং মেরিট ২০১১’।
৬৭১ ম্যাচ। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার জার্সিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ। কখনোই সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকারী হতে পারবেন না। চলতি মৌসুম শেষে ছাড়ছেন ক্লাব। কতটা ডেডিকেটেড দলের প্রতি, বোঝা যায় তার কথায়। ‘কাতালানদের ছেড়েছেন, তবে ইউরোপে খেলবেন না। যদি বার্সার মুখোমুখি হতে হয়’!
শেষসময়ের গোলে প্রতিপক্ষের হৃদয় চুরমার করে দেন বলে ‘হার্টব্রেকার’ ডাকনাম পাওয়া ‘দ্য ডন আন্দ্রেস’ ১৯৮৪ সালের ১১মে স্পেনের ফুয়েঞ্চেলবিল্লায় জন্ম নেন।
শুভ জন্মদিন নক্ষত্র, মধ্যমাঠের জাদুকর।