All that I am, or hope to be, I owe to my angel mother. –Abraham Lincoln
‘মা’ এমনই একজন, যার কাছে এলেই একটা শান্তির ঠাণ্ডা ছোঁয়া পাই। জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে৷ তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই৷ তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১২ সালের ৮ই মে থেকে৷ সঙ্গে উপহার হিসেবে সাদা কার্নেশন ফুল৷ সমীক্ষা বলছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন৷ আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন পড়ে? তারা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা’ ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান৷
ইসলামে ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেস্ত’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাৎপর্য৷ উপনিষদে পড়েছি, ‘মাতৃ দেব ভব’৷ অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী৷ তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় আমরা যাদের পেয়েছি, তাদের কিন্তু আমরা মাতৃরূপেই চিনেছি৷ এ জন্য কুসন্তান বলা হলেও, কুমাতা কখনও বলা হয় না৷ সেই মায়ের জন্য কিনা বছরে একটা মাত্র দিন!
কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি কিন্তু দেবীর মতোই৷ এই যেমন, বৈদিক, সনাতন বা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে প্রতিদিন নানা দেব-দেবীর পুজো হলেও, বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ দেবতার পুজোও হয় আলাদাভাবে, ঘটা করে৷ এই ‘বিশ্ব মা দিবস’ ঠিক তেমনই নয় কী?
পরিচিতি অন্যের থেকেই আসুক বা নিজের, সেটা অবশ্য বিষয় না। আমার দেখার বিষয় ‘মা’। যে মা তার সন্তানের জন্য নিজের কাজ ছেড়ে দিলেন, দেখা গেল সেই সন্তান যখন বড় হয়ে গেল, নিজের জগৎ খুঁজে পেল, মাকে তার আর প্রয়োজন নেই, বরং মা কিছু বলতে এলেই সে ভীষণ বিরক্ত, সেই মা এখন কী করবেন? মাঝবয়সে পৌঁছে সেই মা তখন অনেকখানি উদ্যম হারিয়ে ফেলেছেন, আবার নতুন কিছু কাজকর্ম জুটিয়ে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব না, তার এখন দিনরাত কি নিয়ে কাটবে?
যে বয়স্ক মায়েরা একা বাড়িতে, তাদের দেখভাল করার কেউ থাকুক আর না থাকুক, তারা নিজের ভিটেতেই মরতে চাইলেন, তাদের থাকল নিজের অতীতের স্মৃতিটুকু। আর যারা নিজেদের ভাল লাগার কিছু খুঁজে পেলেন, তাদের শেষ দিনগুলো হয়ে উঠল কিছুটা স্বস্তির। অনেকেই আর ক্লান্তির জন্যই হোক বা উদ্যমের অভাবে সেই চেষ্টাটুকু করেন না। আর দুপুর ও সন্ধ্যেগুলো টিভি সিরিয়াল তাদের মস্তিষ্ক খেয়ে ফেলতে থাকে। আর তারা সেটা টেরও পান না। এখনকার মায়েরা কখনই চান না যে তাদের সন্তান দুধে ভাতে থাকে। তারাই সন্তানকে বৃহত্তর পৃথিবীর দিকে এগিয়ে দেন। কিন্তু নিজেরা সেই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আর ব্যস্ত সন্তান হয়ত সময়ের অভাবে মাকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না, তাই তাদের একাকীত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। অনেক সময় লোকবলের অভাবে বা নিজেদের আস্তানা দেখভালের অক্ষমতায় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। এই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা তাই বাড়ছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে এই ব্যবসা।
আজকাল কত ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধুকে দেখি মায়েদের অযত্ন করতে, তাদের অবহেলা করতে৷ তখন খুব খারাপ লাগে৷ যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে৷
আপনি হয়ত বলবেন বিদেশের কথা৷ কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা৷ সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি৷ এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন –এটাই স্বাভাবিক৷ কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এজন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তারা৷ কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা’ বলে ডাকি৷ দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তার পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা৷ বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য৷
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি’? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে৷ এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু৷ এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য৷ তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন৷ যতদিন ‘মা’ বেঁচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস’ হিসেবে৷ হুমায়ূন আহমেদ এর একটি কথা যা খুব মনে পড়ে আমার- ‘অসংখ্য কষ্ট, যন্ত্রণা পেয়েও মেয়েরা মায়ার টানে একটা ভালোবাসা, একটা সম্পর্ক, একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে চায়। এই জন্য মেয়েরা মায়াবতী আর মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই’।
আমার কাছে প্রতিটি দিনই যে মা দিবস৷
সবশেষে বলতে চাই মায়ের জন্যে কিছু শব্দ, যা খুব কম মনে হয় আমার কাছে…
‘যেভাবে প্রতিটা স্নেহলতা জেনে রাখে সিঁড়ি ভাঙা অংকের দিন। আমি গলে যাওয়া আইসক্রিমে ঠোঁট মেখে নিই, অনায়াসে ভর করি প্রজাপতি ডানায়। তুমি তার নাম দাও স্বপ্ন। তারপর আঙ্গুল ছুঁয়ে নিজেকে দেখা। সকাল মানে যেমন দিন, তুমি ঈশ্বর হয়ে ওঠো প্রতিটা মুহূর্তে। নরম ওমের ভেতর তীব্র আলো তোমায় ছুঁয়ে দিলেই চেনা গন্ধ আতর ছড়িয়েছে চারপাশ। একটার পর একটা জন্মদিন স্মৃতি ক্যালেন্ডারে… অন্ধকার গিলে নেবার আগে তুমি আলো এনে দাও। আর বলো- শক্ত হতে শেখো, শক্ত… তুমি আমি ও অনাগত প্রজন্ম। দাগ মিলিয়ে যাওয়ার আগে নারীর গিঁটে অমরত্ব লিখে রাখি। ঈশ্বরের শ্বাসবায়ু বিন্দু বিন্দু জমতে থাকে তোমার পায়ে। কারণ তুমি মানেই একটা গোটা পৃথিবী’।