তার সময়ের সেরাদের একজন ছিলেন কলম্বিয়ার সাবেক গোলকিপার রেনে হিগুইতা। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন মাত্র একটি। মাঠে হোক আর মাঠের বাইরে, চরিত্রের কারণে সব সময়ই আলোচনায় থাকতেন হিগুইতা। মাঠে তার ছিল নিজের আলাদা স্টাইল। কখনো স্কোরপিওর মত লাফ দিয়ে আটকে দিতেন গোল, কখনোবা বল নিয়ে চলে যেতেন প্রতিপক্ষের পোস্টে। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা ৫৯। গোল করেছেন তিনটি। গোল রক্ষণের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্টাইল পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সকল গোলরক্ষকের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি ফিফার সাথে এক আলাপচারিতায় তার খেলোয়াড় জীবনের নানা কথা বলেছেন অকপটে। জবানের পাঠকদের জন্যে আলাপচারিতাটি অনুবাদ করে দেওয়া হল, অনুবাদ করেছেন দেওয়ান মারুফ শুভ।
ফিফাঃ আপনাকে আপনার যুগের সেরা গোলকিপারদের একজন ধরা হয় কিন্ত আপনি শুধু একটা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন। আপনার ক্যারিয়ারের মুকুটে এটা কোন নতুন অলংকার যুক্ত করেছিল কি?
রেনেঃ আমরা আটাশ বছর পরে বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলাম; বলাই বাহুল্য এই বিশ্বকাপ আমাদের ফুটবলের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া রুখে দিয়েছে। এটা ছিল কলম্বিয়ার ফুটবলের জন্যে একটি জাগরণ। আপনি যখন বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবেন, তখন অবশ্যই ভালো কিছু ঘটতে থাকে। বিশ্বকাপ আপনার ক্যারিয়ারের মুকুটস্বরূপ। নিজের ক্লাব থেকে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলা আর বিশ্বকাপে নিজের দলের হয়ে খেলা কখনো এক নয়।
১৯৯০ বিশ্বকাপের শেষ ষোলতে ক্যামেরুনের সাথে হেরে বাদ পড়ার জন্যে আপনাকে দায়ী করা হয়। গোলটা এখনো মনে আছে আপনার?
রেনেঃ আমার ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ভুলের তুলনায় ইতিবাচক দিক বেশি ছিল। যদিও ভুলগুলোর মধ্যে একটা ছিল ক্যামেরুনের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচে রজার মিলার গোল। আগে গোলকিপারদের পায়ে বল দেয়া হতনা, কিন্ত এখন গোলকিপাররাও নিজেদের পায়ে খেলে। রেনে হিগুইতাকে দেখার পরই গোলকিপারদের খেলার ধরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে নিয়মের পরিবর্তন এসেছে। একজন কলম্বিয়ান গোলকিপার আসে এবং বলে, “এভাবেই খেলতে হবে। এটা হিগুইতার নিয়ম।” এটা এমন একটা অর্জন যা পেলে, ম্যারাডোনা, মেসিরাও পারেনি অর্জন করতে। অবশ্যই আমাদের ভুল হত, কিন্ত আমরা এভাবেই খেলতাম।
আমরা এক গোলে পিছিয়ে ছিলাম এবং আমাদের রিস্ক নিতে হয়েছিল। আমরা অনভিজ্ঞও ছিলাম। আমরা যদি ২-০, ৩-০ বা ৪-০ তে হারতাম তাহলে সবাই এই ভুলের কথা ভুলে যেত। কিন্ত সমস্যা হয় যখন বানার্দোর গোলে ফলাফল হয় ২-১ এবং সংবাদমাধ্যম তখন বলতে থাকে, হিগুইতা ভুল না করলে আমরা ম্যাচটা ড্র করতে পারতাম।
আপনার কি মনে হয় সবাই রজার মিলার কৃতিত্বটাও মুছে দিয়েছে?
অবশ্যই। আমার মনে আছে, পেরেরা আমার পায়ে বল দেয়ার আগেই মিলা আমার দিকে দৌড়ে আসছিল…মনে হচ্ছিল ও ফাউল করতে আসছে। সে বল জিতে নেয়। তাই সব কৃতিত্বই রজার মিলার। যদিও আমাদের দুর্ভাগ্য যে এটা দ্বিতীয় গোল ছিল। এবং বার্নারদোর গোলটা আমার ভুলকে আরো বেশি করে নজরে আনে। কিন্ত আমি কোন ভুল করিনি। এটাই ছিল আমার পজিশন এবং এভাবেই আমরা খেলতাম।
আজকের দিনে অবশ্যই আমি বার্সেলোনার মত দলে খেলতে চাইতাম। দুরের কোন খেলোয়াড়ের কাছে বল দেয়া, ওয়ান-টু খেলা, মাঠে জায়গা বের করে নেয়া ইত্যাদি, এই ধরণের খেলা সব সময়ই বিকশিত হচ্ছে।
‘হিগুইতা স্টাইল’ কীভাবে আসলো?
এটা স্বাভাবিকভাবেই আসে। অনেকে বলে আমি সাবেক আর্জেন্টিনা এবং বোকা জুনিয়র্স গোলকিপার হুগো গাতিকে অনুসরণ করেছি। আমার মনে আছে শৈশবে স্টেডিয়াম যেয়ে গোলকিপারদের খেলা মন দিয়ে দেখতাম। তারা স্ট্রাইকারের পায়ে বল আসার আগেই দৌড়ে যেয়ে বল ক্লিয়ার করে দিত। তারা সবাই ভাল কিপার ছিল। কিন্ত আমি তখন ভাবতাম তারা বল ক্লিয়ার করে না দিয়ে নিজেদের পায়ে বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা। কারণ বল ক্লিয়ার করে দিলে সেটা বিপক্ষ দলের কাছে চলে যাবে কিন্ত যদি বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে আমাদের সুযোগ থাকবে গোল করার। তাহলে কেন আমরা বিপক্ষ দলকে বল দিয়ে দিব।
তাহলে বলের প্রতি দুর্বলতা থেকেই শুরু?
আমার কাছে বল ছিল একটা খেলনা, একটা উপহার যা আপনাকে প্রতি ক্রিসমাসে দেয়া হয় এবং আপনি চাননা এটা হারাতে। এবং যদি হাত থেকে ছুটেও যায় তাহলে আপনি লড়াই করবেন এর জন্যে। আমি বলের জন্যে লড়াই করতে চাইনা; আমি আমার বলটা পেতে চাই। এবং আমি চাইতাম আমার দলও আমার বল পাক। এভাবেই আমি খেলাটাকে দেখতাম এবং এভাবেই খেলার নিয়ম পরিবর্তন হয়।
বর্তমান প্রজন্মের কোন গোলকিপারকে আপনি পছন্দ করেন?
ম্যানুয়েল নয়ার। সে খুব সহজাতভাবে খেলে এবং তার দলকে জিতাতে সাহায্য করে। সে খুবই ভাল খেলে। বর্তমান সময়ে কিপারদের বল নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক বেগ পোহাতে হয়। এটা দরকারি। আমি বলতে পারি এক্ষেত্রে আমার অবদান অনেক। পরবর্তীতে সবাই এসেছে এবং এই স্টাইলই অনুকরণ করেছে। আমি যা করেছি তার জন্যে আমি খুশি, সব ভুল থাকা সত্ত্বেও। কিন্ত আমি মজা করার জন্যে বা আমার দলকে বিপদে ফেলার জন্যে এমনটা করতামনা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম দলকে জিতানোর জন্যে এটাই সবচেয়ে কার্যকরি উপায়।
কলম্বিয়া এবার রাশিয়া যাচ্ছে গত বিশ্বকাপের থেকেও ভাল করার আশা নিয়ে। তারা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবে বলে মনে করেন?
আপনি সবসময়ই সেরাটাই আশা করবেন। এবং এখন যেহেতু তারা বিশ্বকাপে আছে, আমি চাই তারা অপ্রত্যাশিত কিছু করে সবাইকে অবাক করে দিবে। প্রতিপক্ষের রাডারের নিচে থেকে শক্তভাবে দাঁড়াক। হামেস রদ্রিগেজ, ফ্যালকাওদের মত খেলোয়াড় রয়েছে। আমার ছেলেদের ওপর এবং কোচের ওপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।
হামেস কি হসে পেকারম্যানের দলের সহজাতভাবেই দলনেতা?
সে সহজাতভাবেই একজন নেতা, এই কারণেই সে দলনেতা হিসেবে আমাদের ফুটবল দল ও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে এবং এর জন্যে আমাদের কাছে তার আসন অনেক ওপরে। কৌশল, সক্ষমতা এবং পরিশ্রম দিয়ে সে অনেক কিছু অর্জন করেছে। সে একজন পূর্ণাঙ্গ খেলোয়াড়। সে গোল করতে জানে, সে জানে কখন একটা ভাল ক্রস দিতে হবে। সে বিশ্বের যেকোন দলে খেলার দাবীদার।
আপনার প্রজন্মের কারো সাথে হামেসের তুলনা করা যায়?
হ্যাঁ, এল পিবে (দ্য কিড, কারলোস ভালদারেমা)। মানুষ চায় হামেস যেন দ্রুতগতিতে খেলে। সে দ্রুতগতিরই কিন্ত সেটা তার মাথায়। সে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দ্রুত যার কারণে সে আমার দেশের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া তার অভিজ্ঞতাও বেশি। হামেসের কারণে কলম্বিয়ার ফুটবলারদের জন্যে দেশের বাইরের বাজারের দরজা খুলে যায়। আমি খুবি সন্তষ্ট বিভিন্ন দেশে কলম্বিয়ার খেলোয়ারদের খেলতে দেখে।
ড্যাভিড ওসপিনার কতটুক সামর্থ্য আছে দলকে কিছু দেয়ার?
হামেস এবং ফ্যালকাও এর মত ওসপিনাও দলের মেরুদন্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও দলের কৌশলগত কারণে বল নিয়ে তার বেশি খেলতে হয়না বা রিস্ক নিয়ে সামনে আগাতে হয়না কিন্ত বলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাই যখন প্রয়োজন পড়ে সে সামনে এগিয়ে আসে। হ্যাঁ যদি পরিস্থিতে এমন হয় যে আপনি সামনে এগিয়ে এসে বল নিয়ন্ত্রণ করে খেলা নিজেদের পায়ে রাখতে পারেন তাহলে ভাল। কিন্ত গোলরক্ষকের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে গোল সামলানোতেও ক্ষতি নেই। প্রতিপক্ষকে গোল করতে না দেয়াই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত শুধু মাত্র গোল ঠেকিয়েই গোল আটকানো যায়না। গোলবারকে নিরাপদ রাখতে আপনাকে রিস্ক নিতে হবে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের থেকে দলকে রক্ষা করার একাধিক উপায় রয়েছে এবং আমি নিজের মত করে রক্ষা করতাম।