অনুরাগ কাশ্যপ আবারো প্রমাণ করলেন তিনি কেন আলাদা। বলিউডে খেলোয়াড়দের বায়োপিক অনেক হচ্ছে, কিন্তু প্রায় সব বায়োপিকেই খেলোয়াড়দের জয়জয়কার দেখালেও এর পেছনের রাজনীতি খুব কম পরিচালকই দেখানোর সাহস করে। সরকারি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মধ্য দিয়ে যে প্রায় কোনও খেলোয়াড় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারেনা বা একজন খেলোয়াড় তৈরি হওয়ার পরিবর্তে খেলায় রাজনীতির পরোক্ষ হস্তক্ষেপে প্রতিভা ধ্বংস হয় তা-ই আনুরাগ কাশ্যপ নজরে এনেছেন তার পরিচালিত ‘মুক্কাবাজ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ভারতের ছোট শহরের এক বক্সারের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরী রোমান্টিক স্পোর্টস ফিল্ম মুক্কাবাজ মুক্তি পায় চলতি বছরের জানুয়ারির ১২ তারিখ। অনুরাগের সাথে সাক্ষাৎকারটা রয়টার্সে ১০ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। জবান পাঠকদের জন্য চমৎকার এই আলাপচারিতাটি অনুবাদ করেছেন দেওয়ান মারুফ শুভ।
প্রশ্নঃ ‘মুক্কাবাজ’ কে স্পোর্টস ফিল্ম বলবেন?
অনুরাগঃ হ্যা ফিল্মটা স্পোর্টস সম্পর্কিত, কিন্ত একটা সৎ স্পোর্টস ফিল্ম।
এর মানে?
অনুরাগঃ এর মানে হচ্ছে আমরা সবকিছুকে একটা ফর্মুলা বানিয়ে ফেলি। এমনকি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বায়োপিক গুলাও অসৎ। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের হওয়া ফিল্ম গুলা দেখেন… স্পোর্টস ফিল্ম একটা ফর্মুলায় পরিণত হয়েছে। একটামাত্র অর্জন রয়েছে এমন মানুষের বায়োপিক গুলাও বানানো হচ্ছে। অথবা যেই মানুষগুলার জীবন এখনো শেষ হয়ে যায় নাই তাদের বায়োপিক। এবং সব বায়োপিকগুলোতেই কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেম দেখানো হয় এবং ছবির দৃশ্যায়ন শেষ হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে। এই বিষয়টা আমাকে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করে। তারা যেন জন্ম থেকেই নায়ক, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। আমার কাছে এটাকে অত্যন্ত ধাপ্পাবাজি মনে হয় এবং এর বেশিরভাগই আমি পছন্দ করিনা।
জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেম কেন সিনেমাতে যাচ্ছে?
অনুরাগঃ মানুষ সব সময়ই দেশপ্রেমকে গিলেছে।পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই খুব উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন জীবন যাপন করে। কিন্তু যখন তারা দেশপ্রেম দেখে তখন তাদের মনে হয় তাদের জীবনের একটা অর্থ বা উদ্দেশ্য রয়েছে। এবং এই কারণেই তাদের কাছে দেশপ্রেম বিক্রি করা যায়। ভারতের বেশির ভাগ সিনেমাতেই আর্ট কম বরং ব্যবসা বেশি। পরিচালকরা সবসময়ই সিনেমাতে এটা ওটা যোগ করতে বলে। তারা বলে, “আমাদের উচিৎ জাতীয় সংগীত দিয়ে সিনেমাটা শেষ করা”। যেন জাতীয় সংগীত দেয়া মানে হচ্ছে কোন কোন খাবারে রান্না শেষে জিরা ছিটিয়ে দেয়া। তারা দেশপ্রেমকে এই অবস্থায় নামিয়ে এনেছে। এটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে এবং এই বিষয়টাই আমি আমার সিনেমাতে নজরে আনতে চেয়েছি।
পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই খুব উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন জীবন যাপন করে। কিন্তু যখন তারা দেশপ্রেম দেখে তখন তাদের মনে হয় তাদের জীবনের একটা অর্থ বা উদ্দেশ্য রয়েছে। এবং এই কারণেই তাদের কাছে দেশপ্রেম বিক্রি করা যায়।
প্রশঃ আপনার ফিল্মে খেলার সাথে রাজনীতি মিশে আছে…
অনুরাগঃ কোন খেলায় রাজনীতি নাই? আপনার কি মনে হয়? কেন প্রত্যেকটা খেলায় রাজনীতিবিদগণই কর্তাব্যক্তির আসনে? খেলায় পরোক্ষভাবে রাজনীতির প্রয়োগ থাকে।
প্রশ্নঃ আপনি কেন এই সিনেমায় আনান্দ রাই এর সাথে কাজ করতে চেয়েছেন?
অনুরাগঃ এটা আপনাই হয়ে গেছে। আমাদের কাছে একটা ভাল স্ক্রিপ্ট ছিল এবং আমি বিনিয়োগের খোজে ছিলাম। ভিনিত কুমার সিং (মুক্কাবাজে সিনেমায় শাভান) অনেকদিন যাবত ইন্ডাস্ট্রিতে আছে কিন্তু কখনোই মুখ্য কোন চরিত্রে কাজ করে নাই। সবাই স্ক্রিপ্ট পছন্দ করলেও বলতে শুরু করল সিনেমার কাস্টিং থেকে ভিনিত’কে সরিয়ে নিতে। আমার যত দরকার বাজেট দেয়া হবে কিন্ত মুখ্য চরিত্রে কোন বড় তারকা আনতে হবে। জয়া হুসেইন (সুন্যায়না) কে নিয়ে তাদের কোন সমস্যা ছিলনা কারণ “নায়িকা একজন হলেই হয়”। কিন্তু আমি ভিনিত কে বাদ দিতে না চাওয়ায় প্রযোজকদের কাছ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। আনান্দ রাই আমাকে ডাকেন কারণ সে চেয়েছিল আমি যেন ‘মানমারজিয়া’ সিনেমার কাজ আগে করি, কিন্তু আমি আগে ‘মুক্কাবাজ’ই করতে চেয়েছিলাম। তারপর সে বললো, চল দুইটাই একসাথে করি।
ফ্যান্টম (প্রোডাকশন হাউস) এর সাথে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলছেন?
অনুরাগঃ ফ্যান্টম এখন বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করছে এবং আমি ছোট কাজ করতে চাই। তাই আমরা একসাথে কাজ করার একটা পথ বের করে নিয়েছি। নেটফ্লিক্সের কারণে গতবছর ফ্যান্টম খুবই ব্যস্ত সময় পার করেছে। ভিক্রম (ভিক্রম মুতওয়ানি, ফ্যান্টম এর সহপ্রতিষ্ঠাতা) এবং আমি দুইজনই এটা দিয়েই চলেছি। এছাড়া ২০১৮তে আমাদের দুইটা বড় প্রজেক্ট রয়েছে। একটা ‘সুপার থার্টি’ এবং আরেকটা ‘1983’, দুইটাই বিশাল প্রজেক্ট।
ফ্যান্টম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ছোট ফিল্ম মেকারদের জন্যে, কিন্ত আপনাদের সিনেমাতে হৃত্তিক রওশান, রানভির সিংদের মত তারকাদের নিয়ে কাজ করছে। এটা কীভাবে হল?
অনুরাগঃ হ্যাঁ ঠিক তাই। আমারও এটাই প্রশ্ন।
আপনার কি এই বিষয়ে কোন উত্তর নাই?
অনুরাগঃ আমার কাছে কোন উত্তর নাই। আমাদের সবার কাছে আমার একই প্রশ্ন। যখন আমরা একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করি, আমাদের নিজস্ব একটা চাপ থাকে এবং নিজস্ব কর্মীদের চাপ। আমার প্রতিনিয়ত প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কত বড় হয়েছি? আমরা কি এতই বড় হয়ে যাই যে, আমরা একটা নির্দিষ্ট ধরণের কাজ ছেড়ে অন্য কিছু নির্দিষ্ট কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ি। এটা আমাদের প্রতিনিয়তই ডিল করতে হয়। আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠান একটা পরিচালক চালিত প্রতিষ্ঠান। তাই আমি যদি একটা নির্দিষ্ট কাজ করতে চাই তাহলে এর দায়ভার আমার, প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই। কি ধরণের সিনেমা বানানো হবে, এই প্রশ্নে আমাদের চারজনের ভিন্ন ধারনা থাকে, এবং আমরা তাই করে আসছি।
তাহলে এটা কীভাবে একটা সংযোজক প্রতিষ্ঠান?
অনুরাগঃ এটা একটা সংযোজক প্রতিষ্ঠান কারণ আমি জানি কীভাবে একটা সিনেমার বাজেট করতে হয়, কীভাবে বাজেটকে কাজে লাগাতে হয়, কিন্তু আমি ফিন্যান্স বুঝিনা। আমি বাকিদের ওপর এই বিষয়ে নির্ভর করি। আমি এই সিনেমা আনান্দ রাই এর সাথে করছি, কিন্ত আমি বাজেট নিয়ে আনান্দের সাথে বসিনা। এটা তাদের কাজ। আমি আনান্দ বা ফ্যান্টম কারো সাথেই ডিল করিনা। আমি বের হই এবং নিজের মনমত সিনেমা বানাই।
প্রশ্নঃ ফ্যান্টমের এই তারকাদের প্রতি ঝোঁক কি এটাই প্রমাণ করে যে বড় তারকা ছাড়া সিনেমা বানানো যায়না?
অনুরাগঃ না, আমি এটা বিশ্বাস করিনা। আমি মোটেও এটা বিশ্বাস করিনা।
আপনি বলেছে প্রতিষ্ঠানে কর্মী থাকলে চাপ আসে। এই চাপ কমানোর উত্তর কি বড় তারকা নিয়ে নির্মান করা?
অনুরাগঃ এটা খুবই সহজ উত্তর।
তাহলে সবাই সহজ রাস্তা ধরে এগোতে চাচ্ছে?
অনুরাগঃ আমরা দুইটাই করছি।
কীভাবে? ছোট সিনেমাগুলো কোথায়?
অনুরাগঃ ধরুন চারজন মানুষ এক ঘরে রয়েছে… এবং তারা চব্বিশ ঘন্টাই একসাথে কাজ করছে, বোরিং না? আমাদের মধ্যে সব সময়ই বিবাদ থাকবে এবং ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্ত এসবকিছুর পরও আমরা সব সময় ঐক্যবদ্ধ। আমরা হয় দ্বন্দ্বে জড়াব কিন্তু সব সময়ই একত্রে থাকব। আমার দৃষ্টিভঙ্গিই আপনার প্রশ্নের উওর। বড় কাজ করাই কি মুক্তির উপায়? হ্যাঁ ঠিক তাই। আমরা কি সহজ পথ বেছে নিয়েছি? হ্যাঁ আমরা নিয়েছি। আমি বিপরীতে হাঁটতে বিশ্বাস করি এবং আমি বিপরীতেই হাঁটছি। তারা আমাকে সাহায্য করছে এই বিষয়ে। তারা আমার পাশে আছে এবং আমি তাদের।
আপনি কি বিশ্বাস করেন ফ্যান্টম তার নিজস্ব দর্শন থেকে সরে পড়েছে?
অনুরাগঃ না ফ্যান্টম এখনো তার লক্ষেই আছে। ফ্যান্টম “মুক্কাবাজ” এর সাথে জড়িত আছে।