একজন মাহাথির মোহাম্মদের মহাকাব্যিক উত্থান

একজন মাহাথির মোহাম্মদের মহাকাব্যিক উত্থান

মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদের জয়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) জোটের ৬১ বছরের শাসনের অবসান ঘটলো। ১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাজ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এটি একটানা মালয়েশিয়ার শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ জোটের হয়েই ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য বিরোধীদলের হয়ে নির্বাচন করেন মাহাথির। আর তাতেই ভেলকি। বুড়ো মহারাজা আবার সিংহাসনে। জবানের পাঠকদের জন্য তাই মাহাথির মোহাম্মদের জীবনের কিছু উত্থান-পতনের হাইলাইটস।

একজন মাহাথির মোহাম্মদ

আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ ১৯২৫ সালে মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এ্যালোর সেটর-এ এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। তার পিতা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে একজন সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। তার মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।

স্কুলে যেতে অপরাগ

শৈশবে মালয় স্কুলে ও শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা গ্রহন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে জাপান কর্তৃক মালয়েশিয়া দখল হলে, জাপান ইংরেজি স্কুল বন্ধ করে দিয়ে জাপানি স্কুল খোলে। ষোলো বছর বয়েসী মাহাথির জাপানি স্কুলে যেতে অপরাগ হন এবং স্থানীয় বাজারে কলা বেচা শুরু করেন। পরে অবশ্য বাবার জন্য তাকে জাপানি স্কুলে ভর্তি হতে হয়।

কৈশোরের রাজনীতি

মাহাথিরের বয়স যখন বিশ বছরের মতো বা তার চেয়ে একটু বেশি তখন তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। সহপাঠীদের একত্র করে তিনি গোপনে ব্রিটিশ কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। মাহাথির ও তার বন্ধুরা রাতের অন্ধকারে রাজনৈতিক স্লোগান সম্বলিত পোস্টার লাগানোর কাজ করেছেন।

রাজনীতিতে সক্রিয়তা

রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে মালয়েশিয়া। ওই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ‘ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও)’ যোগ দেন তিনি। ওই দলের মূল আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করা মাহাথির জন্মভূমি কেদাহ রাজ্যে সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। মাহাথির ধীরে ধীরে ‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইউএমএনও দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

পার্লামেন্ট থেকে বহিস্কার

১৯৬৯ সালে মাহাথির মোহাম্মদকে বহিষ্কৃত হতে হয় পার্লামেন্ট থেকে। মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই ক্ষমতাসীন দলের রোষের মুখে পড়েন তিনি।

গ্রন্থপ্রণেতা মাহাথির মোহাম্মদ

রাজনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার পর বই লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। নিজের আদর্শ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে একটি বিতর্কিত বই লেখেন তিনি। বইটির নাম ছিল ‘দ্য মালয় ডিলেমা’ (১৯৭০)। ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই মালয় সম্প্রদায়কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছিল। আর এই বিষয়টি মেনে নিতে মালয় সম্প্রদায়কে বাধ্য করা হয়েছিল। লিখেছেন নিজের আত্মজীবনী ‘ডক্টর ইন দ্য হাউজ” সহ প্রায় পনেরটি নানা বিষয়ে বই।

দলে প্রত্যাবর্তন

‘দ্য মালয় ডিলেমা’ বইটি প্রকাশের পর ইউএমএনও-র তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মাহাথির মোহাম্মদ এবং ১৯৭৪ সালে দলে প্রবেশ করেই পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। এর পরপরই মন্ত্রীসভায় পা রাখেন মাহাথির। পান শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদ

শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর মাহাথিরের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে। চার বছরের মধ্যেই হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ। ১৯৭৬ সালে নির্বাচিত হন উপ-প্রধানমন্ত্রী। এবং ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেন। তিনি টানা ২২ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

সমালোচনার মুখে মাহাথির

মালয়েশিয়ার উন্নয়নের চাকা ঘুরালেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিলো। ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে সমালোচিত হন তিনি। মালয় সম্প্রদায় ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্যের স্রষ্টা মাহাথির মোহাম্মদ। তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতিবিদদের দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৮ মাহাথির মোহাম্মদ দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকেকে দল থেকে বহিস্কার করেন। এবং সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ডও দেন।

ভোট দেয়ার পর মাহাথির মোহাম্মদ


নাজিব বনাম মাহাথির

ক্ষমতা ছাড়ার পর দলের রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করতে থাকেন মাহাথির। এই নির্বাচনে তার বিরোধী নাজিব রাজাককে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। আর আজ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে হাত মিলিয়েছেন বিরোধীদলে। মাহাথির ঝানু রাজনীতিবিদই বটে।

কেন মাহাথির বিরোধীদলে?

২২ বছর যে দলের হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন আজ সেই দলের বিরুদ্ধেই জয়ের নিশান উড়াচ্ছেন ডাক্তার এম। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার বিরোধী দল ‘পাকাতান হারাপান’ মাহাথির মোহাম্মদকে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। এ সম্পর্কে তিনি জানান, মালয়েশিয়া এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এজন্য নাজিবকে পদত্যাগের আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু নাজিব পদত্যাগ না করায় তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অন্য উদ্দেশ্য নেই তো আবার?

ক্ষমতায় আসার আগে তিনি জানিয়েছিলেন, বেশিদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন না তিনি। আর তাই বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, ‘পুরনো শত্রু’ আনোয়ার ইব্রাহিমকে ডেকে পাঠাবেন ক্ষমতায় বসতে। এটা ধারণা করাটাও ভুল নয়, কেননা আনোয়ার ইব্রাহিমও জেল থেকে মাহাথিরকে নির্বাচিত করার জন্য অনুসারীদের আহ্বান করেছেন। আর জোট হিসেবে তো এটি মাহাথির-আনোয়ারেরই জোট!

জয়লাভের পর মাহাথির মোহাম্মদ


৯২ বছরের প্রধানমন্ত্রী! তারুণ্যের রহস্য কি?

মাহাথির মোহাম্মদ এবার যখন নির্বাচিত হলেন তার বয়স ৯২। এবছর সিঙ্গাপুরের দি স্ট্রেইট টাইমস-এর নির্বাহী সম্পাদক একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বয়সেও আপনাকে তরুণ তরুণ লাগে কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কম খাবেন। একবার শরীরে চর্বি জমে গেলে তা আর কমাতে পারবেন না”।

আগামী ১০০দিনে মাহাথির যা পরিকল্পনা করেছেন?

  • প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহীদের একই পদে দুবারের অধিক নির্বাচন বন্ধ করা
  • নির্বাচন কমিশনকে সংসদের অধীনে আনা
  • গুডস এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স সংস্কার
  • পার্লামেন্টে বিরোধী দলের এজেন্ডা আলোচনার জন্য সময় নির্দিষ্ট করা
  • আগামী তিন বছর উন্নয়ন বাজেটের অর্ধেক দরিদ্র ৫ অঞ্চলে ব্যয় করা
  • বিদেশিদের বরাদ্দ দেয়া বড় বড় প্রকল্পগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করা
  • দুর্নীতির তথ্যদাতাদের জন্য আইনি সুরক্ষা বাড়ানো
  • তথ্য স্বাধীনতা আইন কার্যকর করা
  • ৩৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য বিয়ে ভাতা চালু
  • ১০ লাখ নতুন হাউজিং
  • মহাসড়কে টোল ব্যবস্থা বাতিল করা
  • নূন্যতম মজুরি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি
  • স্বল্প ব্যবহারকারিদের জন্য পেট্রোল সাবসিডি
  • দরিদ্রদের চিকিৎসায় সাহায্য

মাহাথির মোহাম্মদ যে মালয়েশিয়ার স্বপ্ন দেখেন দেশের মানুষও হয়তো সে স্বপ্নই দেখেন। তাই আবারও তাকে নির্বাচিত করলেন। দেখা যাক, তিনি সেই দেশের মানুষের মেন্যুতে কি কি পরিবেশন করেন।