আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক ও সংকটময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ হলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র একটি প্রতিকৃতি রয়েছে। যেটি এখন দেশের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করেই জাতীয়তাবাদী টেলিভিশন চ্যানেল, হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী গ্রুপ, সরকারের প্রতিনিধিত্বকারীরাসহ সবাই এই প্রতিকৃতির বিতর্ককে উস্কে দিচ্ছেন। এই প্রতিকৃতিটি এখানে গত কয়েক দশক ধরেই আছে। জিন্নাহ কি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইকন? যিনি ভারতকে বিভক্ত করেছেন, তাকে কী করা উচিৎ? এখন কি জিন্নাহকে ছুড়ে ফেলে দেবার সময় নয়? টেলিভিশনের পর্দার প্রধান প্রধান সংবাদে এখন এ ধরণের প্রশ্ন করা হচ্ছে।
এই প্রশ্নের উত্তর আসলে পরিস্কার। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন এ ধরণের কর্কশ ‘বার্নিং কোশ্চেন’র আড়ালে প্রতিদিন আসল ইস্যুগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।রাজনীতিবিদদের আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলো ক্ষমতাশালী ঘৃণার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই ধরনের প্রশ্ন বাড়তেই থাকবে এবং দেশের মুসলিমদেরকে জাতিয়তাবাদ-বিরোধী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চলতে থাকবে।প্রথমত, এই বিতর্কটাই বিতর্কিত। গত আশি বছর ধরে ওই কেন্দ্রে এক সারি ছবির মধ্যে জিন্নাহর প্রতিকৃতিটি রয়েছে। জিন্নাহকে ১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ আজীবনের জন্য সদস্যপদ প্রদান করে। সেই থেকে জিন্নাহর প্রতিকৃতিটি সেখানে সাঁটানো রয়েছে। এছাড়াও আরও অনেকের ছবি সেখানে রয়েছে যেমন, মহাত্মা গান্ধী, বিআর আম্বেদকারসহ আরও অনেকে। তাদেরকেও এভাবে সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল এবং তাদের প্রতিকৃতিও একই হলের দেয়ালা সাঁটানো রয়েছে।
এখন ২০১৮ সালে, আলীগড়ের বিজেপি এমপি সতীশ গৌতম এই প্রতিকৃতিটি আবিস্কার করলেন এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করলেন। কারণটা কি?
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত বিতর্ক উসকে দেয়ার ঘটনা মি. গৌতম কতৃক এটাই প্রথম নয়। নির্বাচিত হওয়ার পর পরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশ্ন করেন যে, কেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শুরুর দিকের অন্যতম ডোনার রাজা মাহেন্দ্রা প্রতাপের জন্মদিন পালন করে না। এই একই ভঙ্গিতে, প্রায় সব সময়েই, কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রসঙ্গ আসলেই বিজেপি বা আরএসএস এ ধরনের আচরন করে থাকে । তারা একটু মাথা খাটিয়ে যাচাই করে দেখার চেষ্টাও করলো না যে, রাজা মাহেন্দ্রা প্রতাপের নীতি, আদর্শ বা দর্শন কী? অথচ রাজা মাহেন্দ্রা প্রতাপ ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী, যিনি তার সারা জীবন জন সঙ্ঘের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। ২০১৪ সালে এই বিজেপি এমপি রাজা মাহেন্দ্রাকে শুধুই একজন হিন্দু হিসেবে তুলে ধরেন। তার অভিযোগ রাজা মাহেন্দ্রাকে অবহেলা করেছে এই মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়টি।
২০১৬ সালে বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্টকে যুক্তি দেয় যে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না, কেননা এটি সরকারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মুসলিমদের দ্বারা নয়।
গত বছর, কিছু ডানপন্থী গ্রুপ এবং বিজেপি নেতারা এই সংবাদ ছড়িয়ে দেয় যে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে অমুসলিম ছাত্রদের রমজান মাসে সকালের নাস্তা ও দুপরের খাবার দেয়া হয় না। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল, তাদের দাবীর কোন প্রকারের সত্যতা যাচাই না করেই উস্কানীমূলক শিরোনাম দিয়ে তা প্রচার করে। যেমন শিরোনাম দেয়, “আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কি অমুসলিম শিক্ষার্থীদের অভুক্ত রাখা হচ্ছে?” বিজেপির এই ধাপ্পাবাজি সহসাই প্রকাশিত হয়ে পড়ে, বিশেষত যখন সেখানকার অমুসলিম শিক্ষার্থীরাই বলে যে, এই অপপ্রচার তাদের প্রতিষ্ঠান ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্যই করা হচ্ছে।
এখনকার সর্বশেষ বিতর্কের কিছুদিন আগেও, আমরা একই অবস্থা দেখলাম, সেই জাতীয়তাবাদীরা বা যারা টেলিভিশনে ঘৃণা প্রচারকে সাধারণ ঘটনায় পরিণত করেছে, তারাই বিতর্ক তুলেছে যে, কেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেন আরএসএস-এর শাখা চালু করতে দেয়া হয়নি। সর্বাত্মক আগ্রাসী ভঙ্গিতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি এই প্রশ্ন রাখা হয়।
আমি এই সব ঘটনাগুলোর তালিকা করেছি। বাস্তবটা দেখে বিস্মিত হয়েছি যে, কিভাবে জেএনইউ-এর মতো আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কেও পরিকল্পিতভাবে ও ধারাবাহিকভাবে টার্গেট করা হয়েছে। এতেও জড়িত রয়েছে সেই একই ঘৃণা প্রচারকারী গ্রুপ ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো, যারা প্রচারণাকে আরও রং লাগিয়ে প্রধান সংবাদ হিসাবে প্রচারের জন্য সবসময়ে প্রস্তুত হয়ে থেকেছে। তাদের এজেন্ডা খুব সাধারণ: জেএনইউ জাতীয়তাবাদ বিরোধী এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানপন্থী। এবং এই দেশ বা হিন্দুরা বিপদের মধ্যে রয়েছে।
জিন্নাহর প্রতিকৃতি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যদি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ তার প্রতিকৃতি রেখে দেয়, আমিই তার প্রথম প্রতিবাদকারী হব এবং কতৃপক্ষকে এটা সরিয়ে ফেলতে বলব। কিন্তু এটি গত ৮০ বছর যাবত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের একটি ঐতিহাসিক ইভেন্টের চিহ্ন হিসাবে সেখানে ছিল। এখন প্রতিকৃতিটি সেখানে থাকায় ঠিক কি কি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল? এটা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মনে এবং হৃদয়ে কি কোন প্রভাব বিস্তার করেছিল? অথবা তাকে সেলিব্রেটি করার জন্য কখনো তাকে ফুলের মালা বা বিশেষ কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে? উত্তর হচ্ছে- না।
এটি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেড়ে ওঠার জটিল ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র। যে প্রতিষ্ঠানটি সকল মতের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল। জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট, ইসলামপন্থীসহ সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষায় প্রসার ঘটানো।
অবশ্য, মি. গৌতমের মত ম্যাট্রিক পাশ রাজনীতিবিদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। আমরা কী তার কাছ থেকে এই জটিল ইতিহাসের প্রশংসা আশা করতে পারি? যেখানে সে এবং তার দল ভারতের এমন পরিচ্ছন্ন ইতিহাসকে সহ্য করতে পারেছেন না। তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতের এমন ভালোবাসাপূর্ণ, বহুমুখী ও জটিল ইতিহাস অসহনীয়, যা সবার জন্য উপযুক্ত ছিল।
এটি এমন একটি প্রেক্ষিত, যেখানে বিজেপির এই এমপি ৮০ বছর আগের একটি প্রতিকৃতির উচ্ছেদ চাইছেন, যেটি সমসাময়িক রাজনীতির জন্য অশুভ সংকেত। এই প্রতিকৃতিটি ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার সর্বশেষ হাতিয়ার।
এখন এই প্রতিকৃতিটি থাকা বা না থাকা আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। উদ্দেশ্য যা ছিল তা পূর্ণ হয়ে গেছে। ঘৃণা প্রচারের যন্ত্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও মুসলমানদেরকে জিন্নাহ প্রেমিক প্রমাণ করার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। ব্যাপার হচ্ছে, জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রথম বিরোধিতাকারীদের অধিকাংশই যে মুসলিম ছিল এবং তারা একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রেই যে বসবাস করতে চেয়েছিল তা বলা হচ্ছে না। তারা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের চেয়ে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার অধীনে থাকতে বেশি পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু জাতিবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে তা আর সম্ভবপর হচ্ছে না।
কয়েকদিন পরেই টেলিভিশনের হেডলাইনগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে। ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ঘৃণা প্রচারকারী মিডিয়া নতুন কোন বিভেদ সৃষ্টিকারী ইস্যু আবিষ্কার করবে। যাতে দেশে যতটুকু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অবশিষ্ট আছে, সেটুকুও শেষ করে দেয়া যায়। কিন্তু এই প্রতিকৃতিটি ভারতীয় মুসলমানদের গলায় কুখ্যাত আলবাট্রোস মত ঝুলতেই থাকবে।
এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, আমরা এখন নির্বাচনের মওসুমে আছি। হ্যাঁ, অবশ্যই!
এনডিটিভি-র সিনিয়র নিউজ এডিটর এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মোহদ অসিম-এর লেখাটি গত ৪ মে ২০১৮ এনডিটিভি -এর মতামত পাতায় ছাপা হয়।