পুসকাস : বিশ্বকাপ না জেতা এক আক্ষেপের নাম

পুসকাস : বিশ্বকাপ না জেতা এক আক্ষেপের নাম

ক্রীড়া বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসর ফুটবল বিশ্বকাপ। আসর শুরুর এক দুই মাস আগে থেকেই পাওয়া যায় উত্তেজনার আঁচ। মিডিয়া, খেলোয়াড়, সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সবার আলোচনার একমাত্র বিষয়েই যেন পরিণত হয় বিশ্বকাপ। সেই ১৯৩০ থেকে শুরু অদ্যাবধি আবেদনে সামান্য ঘাটতিও পড়েনি। বরং দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। বিশ্বকাপের খুব কম বিষয়ই আছে যা ফুটবলপ্রেমীদের জানা নেই। সেই জানা অধ্যায়গুলোই আরো একবার মনে করিয়ে দেয়া, আর অজানা বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে জানানোর চেষ্টা করছে জবান। তারই অংশ হিসেবে ‘বিশ্বকাপ না জেতা দশ তারকা যারা জিতলে থেমে যেতে পারত পেলে-মারাদোনার তর্কটা কিংবা পাশে বসতে পারতেন দুই মহাতারকার’; তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্বে আজ থাকছে হাঙ্গেরির ‘গ্যালোপিং মেজর ফেরেঙ্ক পুসকাস’র কথা।

৪ঠা জুলাই ১৯৫৪। ওয়াঙ্কডর্ফ স্টেডিয়াম, বার্ন, সুইজারল্যান্ড। অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের পঞ্চম আসরের ফাইনাল। মুখোমুখি হাঙ্গেরি বনাম পশ্চিম জার্মানি। সেই ম্যাচের আগে টানা পাঁচবছর অপরাজেয় ছিল হাঙ্গেরি। সেই ম্যাচের পরে নিজেদের যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না তারা নিজেরাই! এই জার্মানিকেই তো দিনকয়েক আগে উড়িয়ে দিয়েছে রীতিমত। পেলের আগে আরেকজন বিশ্বজয়ী বিশ্বসেরা পেতে পেতেও পাওয়া হয়নি ফুটবলের। উল্টো জন্ম নিয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আক্ষেপ,  “’ফেরেঙ্ক পুসকাস’ ফ্রম ‘হাঙ্গেরি’” !

ছবি: পুসকাস- নিচে মাঝে

পুসকাস কে? কেমন তিনি? কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছেন? আকাশছোঁয়ার দীর্ঘ পথে মেঘে মেঘে কত বেলা কাটিয়েছেন? প্রশ্নের শেষ হবে না। ক্রীড়া বিষয়ক সংস্থা ‘আইএফএফএইচএস’ এর জরিপে বিংশ শতাব্দীর টপ স্কোরার ‘ফেরেঙ্ক পার্জলড বিরু’ বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরিতে জন্ম নেন ১৯২৭ সালের পহেলা এপ্রিল। জাতীয় দলে ৮৫ ম্যাচে ৮৪ গোল, ক্লাব ক্যারিয়ারে ৫২৯ ম্যাচে ৫১৪ গোল! বুদাপেস্টের ক্লাব বুদাপেস্ট অনবিডে কাটিয়েছেন ১২ বছর (১৯৪৩-৫৬)। তারপর অপ্রতিরোধ্য রিয়ালের একজন হয়ে ছিলেন ১৯৫৮ থেকে ‘৬৬ পর্যন্ত। অনেকের মতে পুসকাস ফুটবল খেলতেন মস্তিষ্ক দিয়ে। ১৯৪৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেক মেজর পুসকাসের। ১৯৫০-১৯৫৪ পর্যন্ত অদম্য হাঙ্গেরির দুর্দম্য সদস্যরূপে বিশ্বদুয়ারে চিনিয়েছেন নিজেকে। পাঁচ বছরে খেলা ৩০ ম্যাচে কেউ হারাতে পারেনি তাদের। এরমধ্যে ১৯৫২র অলিম্পিক সোনা পকেটস্থ করেছেন। তবু আমৃত্যু হাহাকার নিয়ে বেঁচেছে হাঙ্গেরির সোনালি প্রজন্ম, বিশ্বকাপ ট্রফি ছুঁতে না পারার ‘এত কাছে তবু কত দূরের’ যন্ত্রণায়।

অথচ, ‘৫৪ বিশ্বকাপ জিততে চলেছে হাঙ্গেরি’ এমন খবর বাতাসে চাউড় হয়েছে কতদিন আগেই। চিবর, হিদেকুটি, ককসিসদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব ফুটবল তখন হাঙ্গেরিয়ানদের পদতলে। বিশ্বকাপের আগের বছর ওয়েম্বলিতে গিয়ে ৬-৩, বিশ্বকাপের আগে আগে বুদাপেস্ট নিয়ে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে ইংলিশদের। বিশ্বকাপে এসেও অব্যাহত থাকে গতিশীল ধারা। পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে খড়কুটোর মত উড়িয়ে দেয়া। ফাইনালের দর্শক নড়েচড়ে বসার আগেই ২-০তে এগিয়ে যাওয়া মেজর পুসকাসের হাঙ্গেরির বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরে চেঁচিয়ে পোডিয়াম কাঁপানো তখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ১৮তম মিনিটে ম্যাচের ফলাফল ২-২! গল্পে নতুন মোড়ের উদ্ভব সেখান থেকে। একের পর এক আক্রমণে জার্মান রক্ষণ তটস্থ। হিদেকুটি, ককসিসের শট বারে লেগে ফিরে, সাথে ভাগ্যটাও। এর মাঝে ৮৪ মিনিটে হেলমুট রানের দ্বিতীয় গোলে ৩-২ এ এগিয়ে যায় জার্মানি। পুসকাসের গোল বাতিল হয় বিতর্কিত অফসাইডে, জার্মান গোলপ্রহরী টনি তুরেকের অতিমানবীয় একাধিক সেইভে ককসিস, ফেরেঙ্করা বঞ্চিত হন আরো কয়েকবার।

৪ঠা জুলাই ১৯৫৪। ওয়াঙ্কডর্ফ স্টেডিয়াম, বার্ন, সুইজারল্যান্ড। বিশ্বশাসানো হাঙ্গেরির প্রথম শিরোপার আশা অধরাই থেকে যায়। ১৯৩৮ -এ ইতালি, এবার পশ্চিম জার্মানিতে স্বপ্নভঙ্গ। ভাঙ্গা সেই স্বপ্ন আর জোড়া লাগেনি। কেবল নেমেছে সাফল্যের রেখচিত্র। পুসকাস চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৪’র আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। গ্রুপ পর্বে জার্মানদের বিরুদ্ধে ম্যাচে ভেরনার ট্যাকলের শিকার হয়ে খেলতে পারেননি পরের দু’ম্যাচ। ফাইনালে ফিরে বিপক্ষের জালে বল পাঠালেও হাঙ্গেরিতে জুলে রিমে ট্রফি পাঠানো যায়নি। ১৭ই নভেম্বর ২০০৬ সালে বুদাপেস্টে মৃত্যুবরণ করা ‘ফিফার জুবিলি অ্যাওয়ার্ড’জয়ী গ্যালোপিং মেজর পুসকাস সর্বকালের সেরা ১০০ ফুটবলারের তালিকায় উপরের দিকে থাকলেও বিশ্বকাপ না জেতাদের দলে হয়ত আছেন সবার উপরে।