রোজনামচার সাতকাহনেই আমাদের ঋতুযাপন। শীত, বসন্ত পেরিয়ে এখন গ্রীষ্ম। তার দীপ্ত তেজের ঝলক ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে আমাদের । আর সেই ফাঁকে ঘামাচি আর অ্যালার্জিরা তাদের দিনযাপনের তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের ত্বকে বসতি গড়তে শুরু করেছে। এসব দস্যিদের হাত থেকে বাঁচতে সতর্কতা আর টোটকার সন্ধান রইল এই পর্বে।
ঘামাচি
গরমকালে যেন বিব্রত করতেই ঘামাচির জন্ম। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে মিলিয়ারিয়া বলা হয়। এটি একটি ঘর্মগ্রন্থির রোগ। ক্রান্তীয় অঞ্চলে এর প্রকোপটা বেশি। এই মওসুমে শরীর থেকে প্রচুর পরিমানে ঘাম বের হয়। অতিরিক্ত ঘাম ত্বকের নিচে এসে জমা হতে থাকে। কিছু সময় পর তা ছোট ছোট ফুসকুড়িতে পরিণত হয়ে ফুলে ওঠে। শরীরের যে কোনো জায়গায় ঘামাচি হতে পারে। বিশেষত পিঠ, পেট, গলা, বুকের উপরিভাগ, উরু এবং শরীরের আবৃত অংশ যেখানে হাওয়া প্রবেশ করতে পারে না।
ঘামাচি থেকে সুরক্ষার জন্য কিছু ঘরোয়া টিপস:
১. ওটমিল: ঘামাচি সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে স্নানের জলে ওটমিল মেশান খুব ভালো করে। যতক্ষণ জলের রঙ দুধের মতো না হয়। এরপর ত্বকে লাগিয়ে রাখুন-৩০ মিনিট। শুকিয়ে গেলে নরম ভিজিয়ে তুলে ফেলুন।
২. বেকিং সোডা: ঘরোয়া জিনিসের মধ্যে বেকিং পাউডার ঘামাচি তাড়াতে ভীষণ কাজে দেয়। মৃত ত্বক, ধুলো এবং ত্বকের অন্যান্য সমস্যা দূর করতে এর জুড়ি মেলা মুশকিল। এক কাপ ঠাণ্ডা জলে এক চামচ বেকিং সোডা মেশান। এরপর টাওয়েল ভিজিয়ে অতিরিক্ত জল ফেলে ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ৫ থেকে ১০ মিনিট।
৩. মুলতানি মাটি: ত্বকচর্চার প্রধান উপাদান মুলতানি মাটি। ঘামাচি তাড়ানোর এক অসাধারণ টোটকা। একটি পাত্রে পাঁচ চামচ মুলতানি মাটি এবং গোলাপজল মিশিয়ে নিন। সপ্তাহে একবার মিশ্রণটি ক্ষতিগ্রস্থ জায়গায় লাগান। শুকিয়ে গেলে ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে ফেলুন।
৪. দই: ঠাণ্ডা দই ভীষণ উপকারী র্যাশ, ঘামাচি নির্মূলের জন্য। ১০ থেকে ১৫ মিনিট প্রদাহের ওপর লাগিয়ে রাখুন। তারপর সাধারণ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বকের জ্বালা কমে যাবে, ঘামাচিও হবে না।
৫. চন্দন গুঁড়ো: চন্দন গুঁড়ো ঘামাচি কমাতে সাহায্য করে। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে এর জুড়ি নেই। গোলাপজল ও চন্দনগুঁড়ো সমানভাবে মিশিয়ে সেইসব জায়গায় লাগান, যেখানে ঘামাচির সংখ্যা প্রচুর। শুকিয়ে যাওয়ার পর ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দু-বার ব্যবহার করলেই ভালো ফল পাবেন।
ফলিকিউলিটিস
রোমকূপের মধ্যে ব্রণ হলে তা ফলিকিউলিটিসে পরিণত হয়। শরীরের যে কোনো জায়গায় যেখানে যেখানে রোম থাকে। যেমন মুখ, স্কাল্প, পিঠ, বুক, গলা, উরুতে ফলিকিউলিটিস হতে পারে।
ফলিকিউলিটিস থেকে সুরক্ষার জন্য কিছু ঘরোয়া টিপস:
১. নিমপাতা: নিমপাতা মহৌষধি হিসেবে পরিচিত। কিছু নিমপাতা নিয়ে ২ লিটার জলে সেদ্ধ করুন। তারপর ঠাণ্ডা করে স্নানের সময় সেইসব জায়গাগুলোতে লাগিয়ে নিন। দিনে দু’বার করে লাগালে অনেক আরাম পাবেন।
২. বরফ: র্যাশ, চুলকানি সারাতে বরফ যেমন ভীষণ উপকারি, তেমনি রোমকূপের প্রদাহ রুখতেও বরফের অনেক কারিকুরি। একটি কাপড়ে বরফের টুকরো নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকে ৫ থেকে ১০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। প্রতি ছ-ঘন্টা অন্তর এই বরফ প্যাক ব্যবহার করলে র্যাশ কমে যাবে, আর ছড়িয়ে যাবে না। এছাড়াও ঠাণ্ডা জলে সুতির কাপড় ভিজিয়ে পাঁচ থেকে দশ মিনিট লাগাতে পারেন।
৩. রসুন: রসুন অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল। ত্বকের বিভিন্ন রোগে, রসুন থাকা সালফার ভীষন উপকার করে। রসুন থেতো করে এফেক্টেড জায়গায় লাগালে ফলিকিউলিটিস কমে যায়।
৪. নারকেল তেল: নারকেল তেল শরীর যেমন ঠাণ্ডা রাখে, তেমনি ত্বকের বিভিন্ন জ্বলুনি, চুলকানি, র্যাশ কমাতে সাহায্য করে। স্নানের আগে নারকেল তেল লাগাতে পারেন, কিম্বা ঘুমোনোর সময়। এতে প্রদাহ কমে গিয়ে র্যাশ হওয়া আটকে দেবে।
ব্রণ
ঘামের সঙ্গে ব্যাক্টেরিয়া মিশে গেলে তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ’র সমস্যা দেখা দেয়। ১৫-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে ব্রণর প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়।
ব্রণ থেকে মুক্তির ঘরোয়া উপায়:
১. মুলতানি মাটির সঙ্গে এক টেবিল চামচ অ্যাপেল সাইডার ভিনিগার মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিন। এরপর যেসব জায়গায় ব্রণ হয়েছে, সেখানে লাগিয়ে রাখুন। ১৫-২০ মিনিট পর হালকা গরম জলে একটি তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে মুছে ফেলুন। এই মাস্ক ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করার পাশাপাশি, ত্বক মসৃণও করে।
২. অ্যালোভেরা জেল অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল। ত্বকের প্রদাহ দূর করতে, চুলকানি কমাতে অ্যালোভেরা পাতা কেটে, তার থেকে জেল্টা বের করে নিয়ে ব্রণে লাগান। তারপর ১৫ মিনিট রাখুন। ব্রণ কমে যাবে।
মুখের পাশাপাশি পিঠেও ব্রণ হতে পারে। যা এই গরমের আর এক সমস্যা। খুব বেশি ঘাম এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্যে এই সমস্যা হয়। অনেক সময় ফেটে গিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে।
কি করবেন:
১. স্নানের জলে সামান্য সামুদ্রিক লবন মেশান। টাওয়েল নিয়ে পিঠে লাগিয়ে রাখুন ১৫-২০ মিনিট। তারপর সাধারন জলে ধুয়ে ফেলুন।
২. অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ক্লিনসারও ব্যবহার করতে পারেন। এতে থাকা সলিসাইলিক অ্যাসিড ত্বকের তৈলাক্তভাব দূর করে। যা ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন রুখতে সাহায্য করে।
ঘামের দুর্গন্ধ
ঘামের দুর্গন্ধ খুবই অস্বস্তিকর । ব্যাক্টেরিয়ার কারণে গায়ে দুর্গন্ধ হয়। এটি যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি লজ্জাজনকও বটে। ডিওড্রেন্ট সহজ সমাধান হলেও বিশেষজ্ঞদের দেওয়া ক্যান্সার সতর্কতার পর থেকে ডিওড্রেন্ট এড়িয়ে চলছেন অনেকেই।
ঘামের দুর্গন্ধ রুখতে কিছু ঘরোয়া টিপস:
১. ভিনেগার বা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বগলে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া জমতে দেয় না।
২. বেকিং সোডা শরীর থেকে ঘাম শুষে নিয়ে ত্বক শুষ্ক রাখে। ফলে ঘামের ব্যাক্টেরিয়া থেকে দুর্গন্ধ হয় না।
৩. নিয়মিত শেভ করুন। বগলে লোম থাকলে ঘাম ও ব্যাকটিরিয়া আটকে যায়। ফলে দুর্গন্ধ বেশি হয়।
৪. লেবুর মতো সাইট্রাস ফল ত্বকের অ্যাসিডিক মাত্রা বদলে দিতে পারে। এছাড়া লেবুর রসও দুর্গন্ধ থেকে রেহাই দেয়।
খুসকি
গরমের মাসগুলোতে সবথেকে অস্বস্তিদায়ক হল চুলের সমস্যা। আর চুলের সমস্যা মানেই খুসকি। শুধুমাত্র যে শীতকালেই এর দেখা পাওয়া যায় তা নয়। গরমেও এর সমান অস্তিত্ব। ঘাম, পলিউশন, ধুলো এ সব কিছুর ফলে খুসকি বেড়ে যায়।
খুসকি রুখতে কিছু ঘরোয়া টিপস:
১. নারকেল তেল এবং লেবু মাসাজ খুসকি সারিয়ে তোলার জন্য ভীষণ উপকারী। ২ চামচ নারকেল তেল গরম করে তাতে লেবু রস দিন। এরপর হালকা মাসাজ করে ২০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে নিন। খুসকি কমে যাবে।
২. অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার চুল পড়া এবং খুসকি কমানোর জন্য খুব কার্যকরী। সমান পরিমান জল ও অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার নিয়ে ভেজা চুলে লাগান। তারপর ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এতে চুলও স্বাস্থ্যজ্জ্বল হবে, খুসকিও কমবে।
৩. খুসকি সারানোর জন্য টক দইয়ের ভূমিকা অনেক। শুধুমাত্র টকদই সরাসরি স্ক্যাল্পে লাগান। এক ঘন্টার মতো রেখে শ্যাম্পু করে নিন।
পায়ে দুর্গন্ধ
গরমে পায়ের দুর্গন্ধ খুবই অস্বস্তিকর। তাই দুর্গন্ধযুক্ত জুতো আপনাকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলার আগে ব্যবস্থা করে ফেলুন কিছু।
পায়ের দুর্গন্ধ রোধ করার উপায়:
১. আমাদের পা মাঝে মাঝে খুব বেশি পরিমানে ঘামতে থাকে। যার ফলে দুর্গন্ধ হয়। তাই গরমে ফুট পাউডার, ল্যাভেন্ডার অয়েল, ভিনেগার এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে পারে।
২. পা পরিষ্কার করার সময় অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল সাবান ব্যবহার করুন। এরপর পা ভালো করে শুকিয়ে নিন। ফাঙ্গি এবং ব্যাক্টেরিয়া গোঁড়ালি এবং আঙ্গুলের মাঝে বাসা বাঁধে।
৩. মোজা পরিবর্তন করে করে পরুন প্রতি সপ্তাহে। কাছে রাখুন বেবি ওয়াইপস। কাজের ফাঁকে পা পরিষ্কার করে নিন এভাবেই।
৪. ল্যাভেন্ডার অয়েল অ্যান্টি ফাঙ্গালের কাজ করে। গরম জলে দু-তিন ফোঁটা ল্যাভেন্ডার অয়েল মেশান। তারপর ১৫-২০ মিনিট পা ডুবিয়ে রাখুন। দিনে দু-বার করুন আর ফল দেখুন।
এই তো গেল গরমের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার উপায়। শুধুমাত্র ত্বক পরিচর্যা করলেই হবে না। জল খান প্রচুর পরিমানে। দিনে অন্তত দু’বার ভালো করে স্নান করুন। সুতি পোশাক পরুন বিভিন্ন অকেশনে কিংবা অফিসে। আর ভালো থাকুন এই গরমে।