দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্ষমতাবান একটি সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠে। পাকিস্তানে বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে ভারসাম্যের বিষয়টি বেশ জটিল এবং সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলেও সামরিক বাহিনীর সেখানে অবস্থান সবসময় উচ্চতর। পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে বেসামরিক সরকার কোন সময়ই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারে না।
যেখানে পাকিস্তানের বেসামরিক পক্ষ আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং অযোগ্যতার দরুন দুর্বল, সেখানে সামরিক বাহিনী তাদের সুশৃঙ্খলতার দরুন সব সময় সফলভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ উত্থান, পতন, আর কন্ট্রোলেও সামরিক বাহিনী বিশাল ভূমিকা পালন করে। যদিও ওয়েস্টার্ন গণতন্ত্রের সে ধারণা উপমহাদেশসহ দুনিয়াতে জনপ্রিয় তাতে সেনা বাহিনীর এমন তৎপরতাকে বেশ নিন্দনীয় হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের মতো একটি দেশের বাস্তবতায় এইসব কাগুজে যুক্তি তেমন টেকসই বলে মনে হয় না। কারণ আজন্ম শত্রু ভারতকে হিসেবের মধ্যে রেখেই রাষ্ট্রটিকে টিকে থাকতে হচ্ছে। বলতে গেল জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের সাথে কোন না কোন প্রক্রিয়ায় দেশটির যুদ্ধ লেগেই আছে। কাশ্মির সমস্যার কথা তো সবারই জানা। এমন পরিস্থিতিতে বেসামরিক সরকারের উপর দেশটির জনগনও একচেটিয়া ভরসা করতে পারে না। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরাট শক্তি নিয়ে টিকে থাকার বিষয়টি সেই দেশের জনগনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটছে এমনটি বলা যাবে না। কাজেই অন্যান্য দেশের মতো পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক অবস্থানের বিষয়টি এতো সরল ভাবে দেখার সুযোগ নাই।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায়নের প্রধান কারণ স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত পাকিস্তানের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। যার কারণে পাকিস্তান তার রাষ্ট্রীয় সব ব্যাপারের মাঝে প্রতিরক্ষা বিষয়কে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। অর্থাৎ আগে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা তারপর বাদবাকি সব। এই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হলে দেখতে হবে ব্রিটিশরা কিভাবে ভারত উপমহাদেশ ত্যাগ করে। নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগে,বেশ কিছু প্রিন্সলি স্টেট, বিশেষত কাশ্মীর আর হায়দারাবাদকে অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে, পাকিস্তান আর ভারতের মাঝে দ্বন্দ্বের বীজ পুতে, হিন্দু মুসলমানের মাঝে রায়ট শুরু হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। এতে করে জন্মলগ্নেই দুই দেশের মাঝে বিরোধ শুরু হয়।
পাকিস্তানের জন্ম বছর ১৯৪৭, আর ১৯৪৭-১৯৪৮ এ কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সাথে প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। এর কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মনে নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বাড়তি সচেতনতার সঞ্চার হয়, এবং শুরুতেই রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় ৭০% সামরিক খাতে বরাদ্দ রাখে। শুধু তাই নয়, ভারত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষায় পাকিস্তান সরকার তার সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয় এবং সামরিক বাহিনীর আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা রক্ষায় তার সামরিক বাহিনীকে যে কোন ডিসিশান নেয়ার ক্ষমতা দিয়ে দেয়।( ১৯৭১ এর যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের জনগনকে তেমন ভাবে নিরাশ করে নাই।)
যদিও এটাকে বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ হিসেবে পাকিস্তান কখনও দেখে না। তাদের কাছে বিষয়টা ভারতের মদদে পূর্ব-পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে প্রবেশ করে। তাছাড়া এই যুদ্ধে পাকিস্তানের তরফে পূর্ন সামরিক শক্তি প্রয়োগের সুযোগ ছিল না। যুদ্ধ তাতিয়ে ওঠার আগেই সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ঘটে। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। যার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের ন্যাক্কারজনক রাজনৈতিক ক্ষমতাকেই দায়ি করা হয়। অন্যায় ভাবে একটি সাধারণ জনগোষ্ঠির উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পুরো সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছে -এমনটাই মনে করেন পাকিস্তানের বিশ্লেষকগন। কাজেই এটা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবে দেখার সুযোগ কম। ৭১ এর ভূমিকার কারণে আমাদের দেশে আজও পাকিস্তান নিয়ে এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ওঠেনি। আমরা পাকিস্তানকে ৭১ -এর ইমোশনের আলোকে দেখলে আজকের দিনে পারমানবিক শক্তিধর এবং বিশ্ব যুদ্ধবাণিজ্যের অন্যতম ফ্যাক্টর রাষ্ট্র পাকিস্তানকে আমরা বুঝতে পারব না।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরাজয় আর নৃশংসতা পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক অধ্যায়। এই পরাজয়ের পর পাকিস্তানের নিজ জনগনের কাছে সামরিক বাহিনীর অবস্থান আর আগের মতো থাকেনি। তবে মাত্র ৬ বছর পরেই সামরিক বাহিনী আবার আগের সম্মানজনক জায়গায় ফিরে আসে। ১৯৭৭ সালে, জেনারেল জিয়াউল হক সামরিক ক্যু করে ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে আবারও তার পূর্ববর্তী ড্রাইভিং সিটে নিয়ে যান, এবং এরপর থেকে কোন বেসামরিক সরকারকে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযোগ আর দেয়া হয় নাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যেই হিংস্রতা আর নৃশংসতা দেখিয়েছিল তা একদিকে যেমন ঘৃণিত এবং অপরাধ। সেটা নিয়ে কোন বিতর্ক করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে এর পরে বাহিনীটির সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে বিপুল প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল। তার ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, স্পেশালি সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত এর সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের নেতৃত্ব আর একটিভ অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।
‘র’ বনাম ‘আইএসআই’ এর প্রছন্ন আর প্রক্সি যুদ্ধে দুই দেশ একে অপরের ভূমিতে ক্রমাগত একের পর এক অপারেশান চালিয়ে যাচ্ছে। ভুগছে দেশের মানুষ, কিন্তু তাতে দুই রাষ্ট্রের তেমন মাথা ব্যাথা নেই, কারণ এটা অস্তিত্বের লড়াই। আর বাকি সব কিছুকে তারা কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসাবে গন্য করছে। একই ভাবে হিসাব করে বিশ্বের সব ইন্টালিজেন্স এজেন্সি। সাধারণ মানুষ মারা তাদের কাছে জাস্ট কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। যেখানে মোরালিটি আর এথিক্স টেইকস এ ব্যাক সিট। আর এটাই রিয়েলিটি।
বর্তমানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে পরম বন্ধু হল চীন, যার সাথে যৌথ ভেঞ্চারে পাকিস্তান মেইন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে যুদ্ধ বিমান, ট্রেইনিং বিমান, সাবমেরিন, বিভিন্ন সামরিক বাহন নির্মাণ করে থাকে। এছাড়াও পাকিস্তান ড্রোন, মিসাইল, বিশেষত আইসিবিএম, আর্মস এন্ড এম্যুনিশান, যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদি নিজেরাই নির্মাণ করে। মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান হচ্ছে একমাত্র নিউক্লিয়ার পাওয়ার কান্ট্রি। তার উপর তেলের দাম কমার পর গালফ দেশসমুহ এখন আমেরিকার চাইতেও পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা আর ট্রেইনিং এর উপর ভালো জোর দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের ডিফেন্স একাডেমীর অধ্যাপক জনাব আন্দ্রিয়েস ক্রিয়েগ’র ভাষ্য মতে, “পশ্চিমা কন্ট্রাক্টর বা কোম্পানীসমূহের সাথে ডিল করাটা ব্যয়বহুল হওয়ায় আরব দেশগুলো [জিসিসি] চীন, পাকিস্তান বা তুর্কির সাশ্রয়ী কন্ট্রাক্টরদের দ্বারে ধরনা দিবে আর এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।”
পাকিস্তান গালফ দেশসমুহের সশস্ত্র বাহিনীকে শুধু যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে তাই নয়, বরং হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতেও নিয়োজিত, যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হল, সৌদি সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানি সেনাদের পূর্ণ ব্যাটেলিয়ান নিয়োগ। সৌদি সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাজেটের একাংশ আসে সৌদি আরব থেকে।
পাকিস্তানের বানানো অস্ত্র-সরঞ্জাম অধুনা পুরা মধ্যপ্রাচ্যে ভালো বাজার পেতে যাচ্ছে। যার কারণে সম্প্রতি পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি দুবাইতে তাদের অফিস খুলেছে। সামরিক খাতে পুরা মধ্যপ্রাচ্য চীনের দিকেও হাত বাড়িয়েছে আর সেক্ষেত্রে পাকিস্তান হতে যাচ্ছে একটি মহান ‘গেটওয়ে টু চায়না’।
সৌদি আরবের উদ্যোগে ৪০ টি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে যে ইসলামিক মিলিটারি এলায়েন্স গঠিত হয়েছে তার নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন সদ্য রিটায়ার করা পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসের জানজুয়ার ভাষ্যমতে, “মুসলিম বিশ্বের বিরোধ নিরসনে জনাব শরীফ তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবেন। ইরানসহ জোটবিরোধী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও তিনি জরুরি ভূমিকা রাখবেন।
মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান হচ্ছে একমাত্র নিউক্লিয়ার পাওয়ার কান্ট্রি। তার উপর তেলের দাম কমার পর গালফ দেশসমুহ এখন আমেরিকার চাইতেও পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা আর ট্রেইনিং এর উপর ভালো জোর দিচ্ছে।
যেখানে পুরাতন বন্ধুপ্রতিম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের ভাটা পড়েছে সেখানে পাকিস্তান ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। পাকিস্তান বুদ্ধিমত্তার সাথে ইরান আর আফগানিস্তানের সাথেও তার উঁচু লেভেলের কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বালুচিস্তানে ইরান-বিরোধী বালুচ বিদ্রোহীদের কারণে ইরান-পাক সম্পর্ক বেশ নাজুক, তবুও পাকিস্তান চাচ্ছে ইরানের সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে, আর সেখানেও পাক সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বেশ কিছু মাস আগে খবরের কাগজ ডন এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া দেশটিতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত জনাব হারুনদুস্তকে বলেছেন, “উভয় দেশের মধ্যকার সামরিক সম্পর্ক আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সামনের দিনে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে।”
তিনি আরো বলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুই দেশের মধ্যেকার ঐতিহাসিক ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এবং যে কোন মূল্যে এটা অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর।”
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যা পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়।
খ.
এই অংশে আমরা আলোচনা করব পাকিস্তানের আর একটি শক্তিশালি প্রতিষ্ঠান আইএসআই নিয়ে। যার ভূমিকা দুনিয়ার যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি থেকে শুরু করে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে তো আইএস আই আর ‘র’ এর ভূমিকা নিয়ে প্রতিনিয়ত চায়ের টেবিলে ঝড় ওঠতে দেখা যায়। খোস গল্পে যতটা তাদের নিয়ে আমরা মেতে থাকি ততটা সিরিয়াসলি এই সব প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা আলোচনা করি না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আজ যে এতো শক্তিশালি হতে পেরেছে তার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণাও কম হয়। এখানে সংক্ষেপে কিছু দিক নিয়ে কথা বলব।
বলা হয়, ভারতের সিক্রেট সার্ভিস ‘র’ এর জন্ম হয়েছিল পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার জন্য, তারা সেই কাজে সফল হয়েছে। আর সফল হয়েছে সিকিমে। এরপর শুধু বাংলাদেশেই যা করার করতে পারছে তার বিবেচনায় বাকি সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রে তুলনামুলক ভাবে বিফল বলতে হবে। বাংলাদেশে ‘র’ এর সাফল্যের প্রধান কারণ হিসেবে আওয়ামীলীগকে দায়ী করা হয়। ভারতের ইনফ্লুয়েন্স দিন কে দিন কমছে মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকায়। আর এই সব দেশ এখন চীনা বলয়ে চলে আসছে। ‘আইএসআই’ এর সহায়তায় পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকার সুবিধা নিয়ে চীনের প্রভাব বাড়ছে এইসব এলাকায়। বলা হয় আমেরিকার সাথে ইসরায়েলের যেরকম সম্পর্ক, তেমন সম্পর্ক চীন আর পাকিস্তানের মাঝে। চীন তো পকিস্তানকে তাদের ইসরায়েল বলে ডাকে।
ভারতের সাথে পাকিস্তানের আজীবনের শত্রুতা। উপরে উপরে ব্যবসা বাণিজ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন এই দুই রাষ্ট্র কোনদিন একে অপরকে বিশ্বাস করে না, আর করবেও না। ‘র’ বনাম ‘আইএসআই’ এর প্রচ্ছন্ন আর প্রক্সি যুদ্ধে দুই দেশ একে অপরের ভূমিতে ক্রমাগত একের পর এক অপারেশান চালিয়ে যাচ্ছে। ভুগছে দেশের মানুষ, কিন্তু তাতে দুই রাষ্ট্রের তেমন মাথা ব্যাথা নেই, কারণ এটা অস্তিত্বের লড়াই। আর বাকি সব কিছুকে তারা কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসাবে গণ্য করছে। একই ভাবে হিসাব করে বিশ্বের সব ইন্টালিজেন্স এজেন্সি। সাধারণ মানুষ মারা তাদের কাছে জাস্ট কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। যেখানে মোরালিটি আর এথিক্স টেইকস এ ব্যাক সিট। আর এটাই রিয়েলিটি।
আফগান যুদ্ধে আইএসআই সিআইএ কে অনেকবার ডাবল ক্রস করেছে, সোজা বাংলায় যাকে বলে বেকুব বানিয়েছে। একই কাজ করেছে ওসামা বিন লাদেনকে এবোটাবাদে লুকিয়ে রেখে। যার কারণে আমেরিকা পাকিস্তানকে তেমন আগের মতন বিশ্বাস করে না। না করলেও আল কায়দার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার পাকিস্তানের আর্মি আর ইন্টালিজেন্স এজেন্সিকে ডিঙ্গানোর কোন উপায় নাই। পাকিস্তান এখন ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেছে রাশিয়া আর ইরানের সাথেও। তারা এখন এই অঞ্চলের দুর্দান্ত এক শক্তি, যা এই মুহূর্তে ভারতের ঈর্ষার অন্যতম কারণ। আর সেই কারণেই ভারত চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে পুরাপুরি নিজ আয়ত্তে নিয়ে তার দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে চীনের এক্সেস কমাতে। আর যেথায় চীন সেখানেই পাকিস্তান।
আফগানিস্তানের বিগ গেইম এর অন্যতম ইঞ্জিনিয়ার ছিল ‘আইএসআই’। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিপুল সংখ্যক ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার, সেনা পাঠায়, তখন ‘আইএসআই’ আফগানিস্তান থেকে কমিউনিস্টদের তাড়াতে ‘সিআইএ’ কে ডেকে আনে। আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধের হারের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকেই দায়ী করে, ফলত তারা প্রতিশোধের এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করে নাই। ফলাফল, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের হার, পরিশেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া। কিন্তু এর জন্য যতটা কৃতিত্ব সিআইএ কে দেয়া হয় তার চাইতে অনেক বেশি কৃতিত্বের হকদার আইএসআই। যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
আফগান যুদ্ধে আইএসআই সিআইএ কে অনেকবার ডাবল ক্রস করেছে, সোজা বাংলায় যাকে বলে বেকুব বানিয়েছে। একই কাজ করেছে ওসামা বিন লাদেনকে এবোটাবাদে লুকিয়ে রেখে। যার কারণে আমেরিকা পাকিস্তানকে তেমন আগের মতন বিশ্বাস করে না। না করলেও আল কায়দার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার পাকিস্তানের আর্মি আর ইন্টালিজেন্স এজেন্সিকে ডিঙ্গানোর কোন উপায় নাই। পাকিস্তান এখন ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেছে রাশিয়া আর ইরানের সাথেও। তারা এখন এই অঞ্চলের দুর্দান্ত এক শক্তি, যা এই মুহূর্তে ভারতের ঈর্ষার অন্যতম কারণ। আর সেই কারণেই ভারত চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে পুরাপুরি নিজ আয়ত্তে নিয়ে তার দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে চীনের এক্সেস কমাতে। আর যেথায় চীন সেখানেই পাকিস্তান।
আইএসআই যত বেশি প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে তা আর কোন সিক্রেট সার্ভিসকে করতে হয় বলে মনে হয় না। এক আফগানিস্তানের মাটিতে এখন আইএসআইকে একসাথে মোকাবেলা করতে হচ্ছে সিআইএ, মোসাদ, ‘র’, এমআই৬, এমন কি এসভিআর (সাবেক কেজিবি)। দ্যাটস এ লং লিস্ট। বাট একই সাথে আইএসআই আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে তদের অভিজ্ঞতার কারণে।
আন্তর্জাতিকভাবে আইএসআই এর খ্যাতি একটি দুধর্ষ, প্রাণঘাতী, আর ধূর্ত শক্তি হিসাবে। আধুনিক দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে এছাড়া আর উপায় নাই, আর পাকিস্তান তা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে করে আসছে। আইএসআই এর বেশ কিছু ভুলও আছে, তবে তাদের সারভাইভালের জন্য তাদের যা করা দরকার তা করতে তারা বদ্ধপরিকর, এবং যার ফলে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান কারো করদ রাজ্যে পরিণত হয়নি। যার জন্য প্রধানত কৃতিত্ব পাকিস্তানের আইএসআই আর আর্মির। যদিও সংবিধান অনুযায়ী আইএসআই পাকিস্তান সরকারের অধীনে থাকার কথা কিন্তু কার্যত আইএসআই অটোনোমাস। সেজন্য আইএসআই কে বলা হয় ‘এ স্টেট উইদিন এ স্টেট’।
প্রাক্তন ‘র’ অফিসার রাজেন্দ্র কুমার সিং ২০১৩ সালে এক ভাষণে বলেন, “প্রতিটি দেশ এখন রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতিতে ইন্টালিজেন্স এজেন্সির মাধ্যমে প্রক্সি ওয়ার লড়ছে। প্রক্সি ওয়ার মানে হচ্ছে ইন্টালিজেন্স ওয়ার। আর এই প্রক্সি ওয়ারে পাকিস্তানের আইএসআই অনেক বেশি দক্ষতা লাভ করে ফেলেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে আইএসআই প্রক্সি ওয়ারকে কিভাবে রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক ভাবে ম্যানেজ করতে হয়, আর একই সাথে কিভাবে আমেরিকাকে বেকুব বানানো যায় তার দক্ষতা লাভ করেছে। পাকিস্তানের আইএসআই এর এই দক্ষতার ফলে ভুগছে ভারত। পাকিস্তান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভারতের সিবিআই আর আইবি এর মতন এজেন্সিগুলোর মধ্যে অন্তঃকলহ লাগিয়ে তাদের কার্য সিদ্ধি করছে। যা ভারত সরকার এখনও সমাধা করতে সক্ষম হয় নি।”
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভারতপ্রীতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতির কারণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিআইএ’ এবং ভারতীয় ‘র’ এর চাপে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাটি তেমন সুবিধা করতে পারছে না। অন্যদিকে জনগণের মনে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর বদলে গোটা জনগোষ্ঠীর প্রতি অমূলক ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার ফলে শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। একসময়ে ডানপন্থি ও জামায়াতের রাজনীতিতে আইএসআই এর প্রভাবের কথা শোনা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দুরাবস্থার পরিস্থিতিতেও এইসব সংস্থার পক্ষ থেকে তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ বাদে অন্য দেশগুলোতে ভারতের ‘র’ যেখানে ব্যর্থ ঠিক সেসব দেশগুলোতে পাকিস্তানি আইএসআই সফল হলেও বাংলাদেশে তারা মোটামুটি ব্যর্থ।
এই দুটি দেশের সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার আলোকে বাংলাদেশের চিত্রকে বেশ হতাশাজনকই বলতে হয়। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে নিজ দেশের জনগণের ব্যাপারে তৎপর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুগত হিসাবে দেখা গেলেও আশপাশের দেশগুলোতে তাদের ভূমিকা প্রায় জিরো বলতে হবে। ভারতের পাশে নিজ স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে টিকে থাকার জন্য আমাদেরও দরকার ছিল একটি ইন্টালিজেন্স এজেন্সি আর অত্যন্ত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কিছুতেই অন্যের হাতে তুলে দিবে না। এর জন্যে দরকার একটা প্রচন্ড ধাক্কা বা শুদ্ধি অভিযান। একটি শক্তিশালি ও দেশপ্রেমিক শাসন ক্ষমতার উত্থান। যেই অভিযানে আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কূটনীতিবিদদের দেশবিরোধী অংশ ছিটকে পড়বে। আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্নরাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে। পাশ্ববর্তী দেশগুলো যেই ডেঞ্জারাস গেইমে এগিয়ে যাচ্ছে; তার থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশকে বিরাট একটি স্যাক্রিফাইস করতে হতে পারে। জানি না, আমাদের দেশের মানুষ তা করতে এখনও প্রস্তুত কি না।