এপ্রিল মাসের শেষটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সুখবর দিয়েই শেষ হয়েছে। টেস্ট পরিবারের অংশ হবার পর প্রথমবারের মত র্যাঙ্কিংয়ে আটে উঠে এলো টাইগাররা। জবান বরাবরই চেষ্টা করেছে ক্রিকেটের শূণ্য অবস্থান থেকে আজকের জায়গায় আসার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের সম্পর্কে মানুষকে জানাবার, প্রাপ্য সম্মান দেবার। সে লক্ষ্যেই জবান মুখোমুখি হয়েছিল জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও বিসিবির সাবেক নির্বাচক দীপু রায় চৌধুরীর। বাংলাদেশের ক্রিকেট জগত বদলে যাওয়া শুরু যে টুর্নামেন্ট; ‘৯৭ এর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দলটির নির্বাচক ছিলেন যিনি। খেলোয়াড় দীপু রায় চৌধুরীও ছিলেন নিজের সময়ের অন্যতম দাপুটে অল-রাউন্ডার। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে ৮ ম্যাচে ৩৮ উইকেট, একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাট্রিক করা প্রথম বাংলাদেশি, রয়েছে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরিও। এক ওভারে ত্রিশ রান নেয়ার রেকর্ডও রয়েছে তার। সহযোগী সদস্য হিসাবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার অভিজ্ঞতাসহ বর্তমান ক্রিকেট এবং সে সময়ের অজানা বেশ কিছু অধ্যায় নিয়ে কথা বলেছেন এই গুণী ক্রিকেটার। আলাপচারিতায় ছিলেন আহনাফ জে নাসিফ
আহনাফ জে নাসিফ : আপনি যে সময়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন সেসময়টা তো আসলে ফুটবলের ভরা জোয়ার, এমন সময়ে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মালো কিভাবে?
দীপু রায় চৌধুরী : আমার বাবা তৎকালীন মিনিস্ট্রি অব ফাইনান্সে জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। আমার বড় বোনের বয়স যখন এক মাস, তখনই বাবা করাচীতে বদলি হয়ে যান। আমার বাকি ভাইবোনদের জন্ম কিন্ত করাচিতে যা সেসময়ে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল। তার পোস্টিং সেখানে হওয়াতেই আমাদেরও সেখানেই যেতে হয়েছিল, ফলে আমার স্কুল কলেজ জীবন সেখানেই কেটেছে। জাভেদ মিয়াদাদ, ওয়াসিম বারীর মতো ক্রিকেটারদের সাথেই আমি একই স্কুলে বেড়ে উঠেছি। আমাদের ক্রিকেটের প্রতি ইন্টারেস্টটা সেখান থেকেই গ্রো করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে এসে ক্রিকেটের সাথে জড়ালেন কি করে?
চৌধুরী : দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আমরা দেশে আসি। আসার পরে কার্ডিয়াকের ডাক্তার ইব্রাহিম; উনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তখন আমরা থাকতাম মিন্টু রোডে। উনার ছেলে কবির ভাই একদিন দেখা করতে আসলেন। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন খেলছি না কেন, তখন আমি বললাম আমি তো কাউকে চিনি না। তিনি বললেন ‘আচ্ছা কাল তৈরি থেকো তোমাকে নিয়ে যাবো’। তো তার পরেরদিন সোজা নিয়ে গেলেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে। মাজু ভাই ছিলেন তখন ক্লাবের সম্পাদক। তাহের নামে একজন ক্রিকেটার ছিলেন যিনি দারুণ ব্যাটসম্যান ছিলেন। তিনি পরে পাকিস্তানে চলে যান। তো আমাকে বল দেওয়ার পর ২য় বা ৩য় বলে হি গট হিট। ওই সময়ে আমার পেস ও অনেক ছিল। আমাকে বললেন ঠিক আছে, তুমি আজকে রেজিস্ট্রেশন করো; ফটো আছে? আমি বললাম ফটো তো নাই। তখন ফটো তুলে আমাকে রেজিস্ট্রেশন করালেন। সে সময়ে আমি ৮ ম্যাচ খেলে ৩৮টি উইকেট পেয়েছিলাম। নেওয়ার পরে সবারই আমার ওপরে একটা চোখ ছিল যে এই প্লেয়ারটা কোথায়? আমার সাথে ওয়াহিদুল গণিও ছিলেন যিনি কিনা লাহোর থেকে এসেছিলেন। সে সময় হি ওয়াজ মোর নোন এজ এ ব্যাটসম্যান। আমাদের দলের অধিনায়ক ছিলেন মাকসুদ ভাই। সেসময়ে তারও একটা সমর্থন ছিল আমার প্রতি। তিনি জানতে চাইতেন আমি কতক্ষণ বোলিং করতে চাই। তিনি আমাকে সবসময়ই দিক-নির্দেশনা দিতেন। আমি বলবো যে তিনিই আমার প্রথম মেন্টর।
এরপরে তো আপনি আবাহনীতে খেলেছেন, আবাহনীতে যোগ দিলেন কি মনে করে?
চৌধুরী : তো ৩৮টা উইকেট নেওয়ার পরে লিগ শেষ হয়ে যায়। ওই সময়ে স্টার সামার ক্রিকেট হচ্ছিল। দেখি যে সিলেটে খেলা, চট্টগ্রামেও খেলা। প্লেনে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে আবার ১০০ করে টাকাও দেবে। আমাকে প্রস্তাব দিল সিলেটে যাব নাকি? আমি বললাম অবশ্যই যাব। ওখানে পাইওনিয়ার ক্লাব বলে একটা ক্লাব ছিল, ওখানে গেলাম। আমার অনুপস্থিতিতে ওয়ান্ডারার্সের খেলা ছিল নক আউট বেসিসে। তাতে ওয়ান্ডারার্স হেরে গেল। ফলে তারা আউট হয়ে গেল। আউট হয়ে যাওয়াতে আমি ফ্রি হয়ে গেলাম। ওই আমলে ইয়াং পেগাসাস ভাল টিম ছিল। ইয়াং পেগাসাসের কোচ ছিলেন জালাল ভাই, যিনি সাংবাদিকও ছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘দীপু তুমি খেলবা ইয়াং পেগাসাসে?’ ‘আমি বললাম, ‘হ্যাঁ খেলব’। আমি চিন্তা করলাম একটা ভাল টিমে সুযোগ পাইলাম, খেলব।
সে সময়ে ধানমন্ডি ২১ এ থাকতাম। আগামীকাল খেলা, আজ বিকালে আমি বাসায়ই আছি। ঠিক বিকালে দেখি কামাল ভাই (শেখ কামাল), তারপরে তানভীর হায়দারের ভাই নাভিদ হায়দার ও জিয়া এই ৩ জন আমার বাসায় আসলেন। আমি শেখ কামালের নাম শুনেছি, কিন্ত কোনদিন দেখিনি। উনি আসছেন যখন আমি নিজেই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। কামাল ভাই খুব নরমভাবে আমাকে বললেন, “দীপু তুমি খেলবা আমার টিমে? দেখো জিয়ার তো কাল পরীক্ষা আছে, আর জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ তো ফুটবলও খেলে। উইলিয়াম হার্ট যে ফরেন কোচ ছিল ফুটবলের সে ওদিন খেলতে দেবে না। এদিকে আমার বোলারও নাই।” আমি খুব ভেবেচিন্তে কামাল ভাইকে বললাম, ‘কামাল ভাই, আমার খেলতে আপত্তি নাই। কিন্ত আমি তো জালাল ভাইরে কথা দিসি’। আমাকে সুন্দরভাবে কামাল ভাই বললেন, ‘আচ্ছা জালাল যদি বলে তাহলে তুমি খেলবা?’ আমি বললাম তাহলে আমার আপত্তি নাই। তারপর তিনি বললেন ‘তুমি রেডি থেকো, আমি সকাল বেলা নিয়ে যাব’। ঠিক সকালবেলা তার একটা ব্লু কালারের টয়োটা গাড়ি ছিল সেটাতে আমাকে নিয়ে ৩ নাম্বার মাঠে নিয়ে গেলেন। সেখানে নেমেই দেখি ইয়াং পেগাসাস দাড়ানো, আবাহনীর সাথে তাদের খেলা। জালাল ভাইকে উনি (কামাল ভাই) বললেন, ‘জালাল, দীপু আমার টিমে খেললে তোমার আপত্তি আছে?’ জালাল ভাই ওখান থেকে বললেন কোন আপত্তি নাই। আর সেটাই আবাহনীর হয়ে আমার ডেব্যু ম্যাচ ছিল। ওই ম্যাচেই আমি ২২ রান দিয়ে ৮টা উইকেট নিলাম ইয়াং পেগাসাসের বিরুদ্ধে।
এরপর আবাহনীর সাথে দীর্ঘ পথচলা কিভাবে আগালো?
চৌধুরী : তখন আবাহনী ক্লাবটা ছিল উল্টোদিকে, আনোয়ারা কেবিএইচ প্রোপার্টির ওই বিল্ডিংয়ে। তো ওখানে একটা ফাইনাল ছিল। স্টার ক্লাব ভার্সেস আবেদীন, যেটা নান্নুদের টিম ছিল। নান্নুরা আবাহনী ক্লাবের জন্য খেলে। তখন কামাল ভাইসহ আমরা সবাই গেলাম। একটা জিনিস বলতে চাই কামাল ভাই একজন ভাল বোলার ছিলেন, ভাল পেস বোলার ছিলেন। ওই ফাইনালে এতো প্লেয়ারের মধ্যে তিনি ৫ উইকেট নিয়েছিলেন যেখানে আমি ছিলাম, কামাল ভাই ছিলেন, জিন্নাহ বলে একজন ভাল বোলার ছিলেন সেসময়ে আর আবাহনী টিমের বাকি বোলাররা তো ছিলই। আর প্রতিপক্ষ দলে ইউসুফ বাবু, পান্না, দৌলত জামান, তানভীর হায়দার এরা সবাই ছিলেন। কিন্ত কামাল ভাইয়ের মধ্যে যা দেখেছি, কোনদিন কমান্ড বা এ ধরনের কিছু করতেন না। আমাদের দলে ক্যাপ্টেন ছিলেন আলিউল ইসলাম, যিনি আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক ছিলেন। আমি গর্বিত তার অধীনে খেলতে পেরে। তিনি বিভিন্ন ডিসিশন নিলেও কামাল ভাই কোনদিন টু শব্দ করতেন না যে একটা ওভার আমাকে দাও বা এ ধরনের কিছু যা অনেক প্লেয়ারের মধ্যেই দেখি। তিনি একজন স্পোর্টস লাভার ছিলেন তার সাথে মিশে যতটুকু বুঝেছি, কিন্ত দূর্ভাগ্যবশত তার সাথে আমার একটা লিগ খেলা হয়নি ট্র্যাজেডির কারণে (১৯৭৫ এর তার হত্যার জন্য)। তার সাথেই মেশার কারণে কিনা ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক হারুন ভাই (বর্তমানে বাচ্চু) তাকে তার বাসা যেটা ধানমন্ডি ১৯ এ ছিল, গিয়ে বললাম, ‘আমি কিন্ত আবাহনীতেই খেলব, যা হয় হোক না কেন’। কেননা একটা অনুভূতি ভিতরে কাজ করেছিল, যার জন্যে তখন থেকেই ১৯৮৪ পর্যন্ত টানা আবাহনীতেই খেলেছি।
ফুটবলের জোয়ার চলাকালীন সময়ে ক্রিকেট খেলতে আসায় চ্যালেঞ্জগুলো কি ছিল?
চৌধুরী : হ্যাঁ, ফুটবল ওই সময়ে অনেক জনপ্রিয় ছিল। কিন্ত ওই আমলে আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ ক্রিকেট মানুষ খেলতো ভালোবাসা থেকে। আমাদের কিন্ত ওরকম কোন কোচ আমরা পাইনি যাকে কিনা আমরা অনুসরণ করব, আমাদের ভুল ধরিয়ে দেবে। আলতাফ ভাই ছিলেন, যিনি সেসময়ে খেলছিলেনও। ওই আমলে ১৯৭৪ বা ১৯৭৫ সালে আমরা কোন কোচ পাইনি। তাই আমরা দেখে দেখে, কমেন্ট্রি শুনে, ফলো করতাম। ভালো প্লেয়াররা যখন খেলত তাদের ফলো করতাম। এটা একটা জিনিশ ছিল। আর বাসা থেকে বলা হয়েছিল ‘বাবা, পড়াশোনা ঠিক করে তুমি খেলাধুলা করতে পারবা। কিন্ত রেজাল্ট খারাপ করলেই খেলা বন্ধ’। আমার ফ্যামিলিতে কেউ সেকেন্ড হয়নি, সবাই কিন্ত ফার্স্ট অলওয়েজ। সবাই যার যার জায়গায় বেশ প্রতিষ্ঠিত। কিন্ত আমি জীবনে পড়াশোনাতে প্রথম হতে পারিনি। কারণ আমার মন সবসময় খেলাতেই ছিল। কিন্ত গড়ে ২য় ডিভিশনে হলেও পাশ করে গেছি। তাই এটা ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসা সবসময়ই ছিল। কিন্ত পরিবেশটা এমন ছিল ফুটবল হকি বা ক্রিকেট, সবাই সবার সমর্থন করত। ইভেন আপনি দেখবেন অনেক ফুটবলার, যেমন নওশেদ, টিপু বা সালাউদ্দিন তারাও ক্রিকেট খেলেছেন এবং ভালো ক্রিকেট খেলেছেন। কোনদিন হয়তো এমন হয়েছে প্লেয়ার কম ছিল, তখন বললে তারা খেলতেন। একটা সম্পর্ক ছিল। এটা ছাড়াও আপনি যদি ফিরে তাকান প্রফেশনাল হলেও খেলায় হয়তো প্রফেশনালিজম ছিল না, কিন্ত ক্লাবে প্রফেশনালিজম ছিল। যার জন্য আপনি দেখবেন আগের অনেকেই সারাজীবন এক ক্লাবেই খেলছেন। যেমন ওয়াহিদের কথাই দেখুন, সে এক মোহামেডানে থেকেই তার ক্যারিয়ার শেষ করেছে।
ওই সময়ে একটা প্লেয়ার একটা ক্লাবেই ক্যারিয়ার কাটিয়ে দিত। কিন্ত এখন জিনিশটা ওরকম নেই। দর্শকদের মধ্যেও ব্যাপক আবেগ কাজ করত। আবাহনী-মোহামেডানের খেলা থাকলে ঢাকায় তো রীতিমত যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব লেগে থাকত, এর কারণ কী?
চৌধুরী : কারণ এখন টাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তখন ভালোবাসাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগে আমরা শুনতাম কিছু কিছু ফুটবলারও ছিল যারা টাকা না পেলে জুতার ফিতাও বাঁধবে না, এ ধরনের কথা শুনতাম। কিন্ত আমরা কখনো এভাবে ভাবিনি। এই জিনিশটা আমাদের মাথায় ছিল না। তখন ক্লাবের প্রতি একটা টান ছিল, অনুভূতি ছিল যে আমরা আমরাই তো। আমি সংগঠক ছিলাম, আমিই দল বানাতাম। সামিউর রহমান, সে কম পয়সার মধ্যে বিয়ে করে চলতে পারছে না। এখন কি করবে? তাই তার বাচ্চার দুধসহ বিভিন্ন জিনিস কিনে দিতাম, কারণ চাইতাম ভাল মুডে খেলুক। রফিকুল আলম সিগারেট খায়, তাই তাকে নিজ থেকে সিগারেট কিনে দিতাম আর বলতাম, তোর কোন কাজ নাই শুধু রান করবি বাকিটা আমি দেখব। বেলালের আবার খাওয়ার দিকে ঝোক ছিল, তাই ওকে বলতাম তুই আজকে ফিফটি মার তোকে খাওয়াব। আমার বাসায় বছরে ৩-৪ বার টিম ডিনার হতো, টিম স্পিরিট বাড়ানোর জন্য। তখন টাকা-পয়সাটা বিষয় ছিল না অতো। রকিবুল হাসান আমার ভালো বন্ধু, সে অনেকবার বলেছে মোহামেডানে খেলতে, কিন্ত আমি আবাহনীর প্রতি অনুগত ছিলাম। আপনি যদি দেখেন আমি প্লেয়ার হিসেবে শুরুটা করেছি আবাহনীতে, আর কোচ হিসেবে শুরু করেছি কলাবাগানে। তাই অনুভূতিটা অনেক গভীর ছিল। এমনকি ফুটবলারদেরও তাই। অমলেশদাকে দেখেন, সব সময় আবাহনীতেই ছিলেন। তার কথাই চিন্তা করেন, তারাও পয়সা পেয়েছে কিন্ত তেমন আহামরি পায়নি, যেরকম পাওয়া উচিত ছিল প্রফেশনালিজম থেকে। কিন্ত তারপরও আনুগত্য ও ভালবাসা ছিল ক্লাবের প্রতি। কিন্ত এখন ওই ভালোবাসাটা নাই।
আমি মনে করি এটার পেছনে কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে আসাটাই মূল কারণ। কারণ আমাদের সময়ে কর্পোরেটদের কাজ ছিল ক্লাবকে টাকা দেওয়া। যেমন আলফা টোবাকো ওই আমলে এটা করত। কিন্ত এখন কর্পোরেট নিজে আসছে নিজের নামে টিম করতে। এটাই বড় পার্থক্য। আর আপনি বড় বড় কর্পোরেটের সাথে পারবেন না। ক্লাবের দর্শন হারিয়ে ফেলছে। কারণ ক্লাব ডোনেশন নিয়ে চলবে। আর তারা নিজেরা হলে কারো কাছে যেতে হবে না, তাদের নিজেদের ফান্ডেই চলে। এখন প্লেয়াররা কমফোর্ট ফিল করে কারণ তারা জানে অমুক তারিখে তারা ৫ লাখ টাকা পাবে মানে অমুক তারিখেই দেবে। কিন্ত এটা ক্লাবে অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার জন্য প্লেয়াররা কর্পোরেট টিমেই যেতে চাচ্ছে। যেমন শেখ জামালে এখন বসুন্ধরা, গাজী ট্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ব্যাকআপ দিচ্ছে, এরকম আর কি। তাদের মূল লক্ষ্য টাকা।
আমার এখনো মনে পড়ে, আমরা আবাহনীতে থাকাকালে মোহামেডানের সাথে একটা ম্যাচে হারলে ব্যথাটা ততক্ষণ পর্যন্ত থাকত যতক্ষণ না তাদেরকে হারাতে পারছি। যদি হারতাম তাহলে নেক্সট ৩ দিন পেটে ভাতই যেত না। খাওয়াই যেত না, এত আপসেট থাকতাম। হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে স্পোর্টসম্যানশিপ ছিল। আউট হলে চলে আসতাম। কিন্ত এই হারের ব্যাথার জায়গায় আমরা সিরিয়াস ছিলাম।
আর আমরা যখন একসাথে থাকতাম নিজেদেরকে একটা পরিবার ভাবতাম শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে না। বরং ক্রিকেটার, ফুটবলার, হকি কিংবা যেকোন সবাই পরিবারের মতো ছিলাম। সাব্বির ভাই, আজমল ভাই বা সাদিক ভাই সবার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল।
আপনি ‘৭৯ এবং ‘৮২ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দলের সদস্য ছিলেন। ‘৭৯, ‘৮২ সালে বাংলাদেশ যখন আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে আইসিসি ট্রফিতে খেলতে যান, তখন অনুভুতিটা কেমন ছিল?
চৌধুরী : তখন ইংল্যান্ড মানেই একটা বিরাট ব্যাপার। ক্রিকেট মানেই তখন ইংল্যান্ড। প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই তখন স্বপ্ন ছিল ইংল্যান্ডে খেলতে যাওয়া, ইংল্যান্ড দেখা ও ইংল্যান্ডে খেলা। যেখানে ওয়ানডে বিশ্বকাপও হবে, আবার বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইংয়ের জন্য আইসিসি ট্রফিও খেলবো একটা ভিন্ন কন্ডিশনে এটা তো একটা স্বপ্ন। আমার কাছে কোটি কোটি টাকা থাকলেও হয়ত জীবনে বোধ হয় এই সুযোগ পেতাম না। ১৯৭৯ সালে বাকিংহাম প্যালেসে রানী যখন ওয়ার্ল্ডের সব ক্রিকেটারকে রিসেপশনে কল করল, সেখানে গিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের ভেতর রানীর সাথে, মার্ক ফিলিপের সাথে কথা বলাটাও একটা সুযোগ ছিল। দুটো মজার ঘটনা ছিল, দৌলত জামান ছিলেন আমাদের দলের পেস বোলার। সে ইংল্যান্ডে নেমে বলে ‘ইয়ে ত হাম লোগো কা মুলক কা জ্যায়সাহি হ্যয়’। আবার সেখানে আমার বড় বোনের মেয়ে ছিল, যার জন্ম ওখানেই। তো তার ইংরেজি বলা দেখে দৌলত জামান বলে ‘ইয়ে ছোটা বাচ্চা ইতনা সাফ ইংরেজি বোলতা হ্যয়’। তো এরকম আমরা খুব মজা করতাম। শফিক ভাই গান গাইত, গান শুনতাম। হীরা ভাই, ফারুক ভাই ছিলেন। তারপর জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাও ছিলেন। আমরা খুব মজা করেছি সেখানে।
সেসময়ের খেলার মাঠের মজার কোন স্মৃতি থাকলে বলুন…
চৌধুরী : আমরা প্রথম ম্যাচে ফিজির সাথে হঠাৎ খারাপ অবস্থায় পড়লাম। তারপর মাসুদ ভাই আর আমি ধরলাম। আমি ২৭ রানে অপরাজিত ছিলাম। তারপরে বোলিং করে ১ উইকেট পেলাম, বেশি উইকেট পাইনি। কারণ স্পিনিং উইকেট ছিল। পরে দ্রুত আশরাফুল ভাই ৭ উইকেট নিয়ে নিল এবং আমরা ম্যাচ জিতলাম। সেটা আমাদের প্রথম ম্যাচই ছিল এবং সেটাই জিতলাম, তাই এটা বড় একটা স্মৃতি ছিল। আমরা অনেকগুলো ম্যাচই জিতেছিলাম, যদিও সে আমলে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারিনি। কারণ আমরা দুটো ম্যাচ হেরেছিলাম। প্রথমে হেরেছিলাম জিম্বাবুয়ের কাছে, পরে হেরেছিলাম শ্রীলঙ্কার কাছে। আমরা সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলাম, কিন্ত ওখানে হেরেই বাদ পড়ি যেটা দূর্ভাগ্যজনক ছিল। কিন্ত নাভিদ, শিলাজিত, ইউসুফ বাবু, রফিকুল আলম, বিলালসহ অনেক অনেক প্লেয়ার, যেমন আকরাম এসেছিল। কিন্ত আমরা প্রতিযোগিতার ওই জায়গা থেকে বের হতে পারিনি। কিন্ত হ্যাঁ, সবার মাঝে এটা ছিল যে আমরা যেভাবে সংগ্রাম করেছি এ জায়গায় আসার, আমাদের তো আসার কথাই ছিল না। তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ছিলেন এনএসসিবিতে। আমাদের যাওয়ার টাকা ছিল না। আর এনএসসিবি না করে দিয়েছিল। পরে আমরা তার কাছে গেলাম। তখন তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা যাবা’। তখন গুহ সাহেব ছিলেন ওখানের হাই কমিশনার। তখন তাকে বললেন, ‘আমার টিম যাচ্ছে,তাদের একটু দেখো’। ওটাই ছিল যাত্রা। কারণ ক্রিকেটে কোন টাকাই ছিল না দেওয়ার মতো। বাংলাদেশেও এমন ছিল না। ইভেন ১৯৮০ সালের কথা বলছি, যখন চিটাগাংয়ে স্টার সামার খেলতে যাব। তখন আমি অধিনায়ক ছিলাম, বললাম আমাদের আসা যাওয়ার ভাড়া দেন, খেলে আসব। তখন চিটাগাং আবাহনী বলল আপনাদের এখানে এসে থাকতে হবে। আমাদের ক্লাব বলল আমাদের ত সে টাকা নেই। তখন পরে ইস্পাহানী থেকে ট্রেনের একটা বগি নিয়ে গেলাম, খেললাম আর চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসলাম।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতল, যা দেশের ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেখানে আপনি নির্বাচক কমিটির সদস্য ছিলেন। সে টিম নিয়ে কিছু যদি কিছু বলতেন…
চৌধুরী : অনেক ভেবেচিন্তে দল তৈরি করেছি আমরা। কারণ সেসময় সেই ভাবার পথটা ছিল। সেই ট্রফি কিন্ত খেলা হয়েছিল অ্যাস্ট্রো টার্ফে। তাই অ্যাস্ট্রো টার্ফ এনে লিগগুলোতে খেলিয়েছি। আর সেসময় লক্ষ্য করলাম অ্যাস্ট্রো টার্ফে বাহাতি স্পিনারদের খেলা কঠিন, তারা কিন্ত খুবই প্রভাব রাখে। তো যখন দল নির্বাচন করি সেই নির্বাচক কমিটিতে সিনিয়ররাও ছিলেন। মাসুম ভাই ছিলেন, রেজা ভাই ছিলেন। আবার জুনিয়র হিসেবে ছিলাম আমি, ওয়াহিদ ও জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা। এক জায়গায় একটা প্রশ্ন উঠছে। তখন তাদের মত ছিল যে একটা বাহাতি স্পিনার থাকবে, একটা ডানহাতি স্পিনার থাকবে, একটা ডানহাতি পেসার থাকবে ও একটা বাহাতি পেসার থাকবে। আমার যুক্তি ছিল, আমার সময়ে আমি, বুলু আর জালাল ৩ জন বাহাতি পেসার একসাথে আবাহনীতে খেলেছি। আমার কথা হল, আমার টিমে যদি দুটো ওয়াসিম আকরাম থাকে তাহলে কি আমি নেব না? ওখানে একটা প্রশ্ন ছিল যে এনামুল হক মনি নাকি মোহাম্মদ রফিক কাকে দলে নেবো? আমি বলেছিলাম দুজনকেই নেওয়া হোক। কারণ একজনকে নিলে সে যতই ভালো করুক তার স্পেল পুরণ করবে না, রেখে দেবে। তাহলে কেন দুজনকেই নেওয়া হবে না? কিন্ত চেয়ারম্যান আর সিনিয়র নির্বাচকরা আগ্রহ দেখাননি, কারণ তারা চাচ্ছিলেন পেসার নিতে হবে। অথবা শেখ সালাউদ্দিনকে নিতে হবে, যে অফ স্পিনার। তখন আমি বলেছিলাম, এখানে অফ স্পিনারে কাজ হবে না। আর তার জন্যে দূর্জয় আছে, বুলবুল আছে। তারা চালিয়ে দিতে পারবে সে কাজটা। কিন্ত বাহাতি অফ স্পিনারে তো কেউ নেই। তখন তারা তা করতে না চাওয়ায় আমরা চলে যেতে চেয়েছিলাম। এক পর্যায়ে আমি বললাম, ভোট করেন, দেখেন কি হয়। তখন তারা বুঝেছে যে হ্যাঁ, আমরা জুনিয়র নির্বাচকরা একমত এতে। তারপর থেকেই বাহাতি দুটো স্পিনার খেলানোর ট্রেন্ড চালু হয়। তাই নিজেকে গর্বিত মনে হয়। আর তারপরই তো বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসল। আর সেটাই বাংলাদেশ ক্রিকেতের টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
ওই সময় যে পরিস্থিতি ছিল, তখন যে আমরা ৩ বছর পর টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে যাচ্ছি, তেমনটি ভাবারও সুযোগ ছিল না?
চৌধুরী : না, দেখেন এডি বারলো যখন দেশে আসলেন, তখন সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট এত দারূনভাবে ফেরার পেছনে ওর অবদান ছিল। আমাকে বললেন, ‘তুমি বিসিবিতে জয়েন করো’। তখন সাবের হোসেন চৌধুরী ছিলেন বিসিবির প্রেসিডেন্ট। আর যখন আমি কোচিং করি, তখন উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার আগে যখন দেখা হয় তিনি আমাকে, তানিমকে আর ওয়াহিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘এক্স প্লেয়াররা কোচিংয়ে আসছে না কেন?’ তখন বললাম মতিঝিলে সাপ্লাই কাজ করে যদি ১০০ টাকা কামাতে পারি আর এখানে আপনারা ৫০ টাকা দেন। তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কোথায়? তখন সাবের ভাই বললেন, ‘তোমরা থাকো, ডোন্ট ওরি’। তখন থেকেই এনএসসিবিতে যারা চাকরি করত যেমন আলতাফ ভাই, এজাজ ভাই এরা ৫০ টাকা পেত। আর আমরা পেতাম ১০০ টাকা। যেহেতু তানিমের বড় ব্যবসা ছিল। তাই সে নিয়মিত কোচিং করল না। কিন্ত আমি আর ওয়াহিদ চালিয়ে গেলাম। আর বিসিবিতে চাকরি করা সম্পর্কে বললাম, ‘এদিকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কি লাভ? তখন এডি বারলো আস্বস্ত করলে আমি রাজি হলাম।
এক সময়ে খেলোয়াড়রা বলা শুরু করল যে তারা ক্লাবে খেলবে, ন্যাশনাল টিমে খেলবে না। স্ট্রাইকও করল। প্রেসক্লাবেও গেল। এডি, আমি ও বুলবুল অনেক অনেক বুঝালাম খেলোয়াড়দের। কিন্ত তাও তারা ন্যাশনাল টিমে খেলবে না। তখন সে তাদের বোঝাতে শুরু করল, ‘ন্যাশনাল টিমে খেলো অমুক পাবা তমুক পাবা’। এটাও বোঝানো শুরু করল যে ভবিষ্যতে আমরা কি সুবিধা পাব। এটা একটা বিরাট মোটিভেশন ছিল। আর তিনি একজন দারুণ মোটিভেটর ছিলেন। বিরাট অবদান রেখেছিলেন বারলো। ইভেন তার থাকা অবস্থায় যখন ইংল্যান্ড ‘এ’ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দল আসে তখন আমি কোচ ছিলাম টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে। আমি বললাম, আমি এ টিমের কোচিং করব? উনি বললেন, ‘ডোন্ট ওরি, আই উইল বি বিহাইন্ড ইউ। আই ওয়ান্ট বাংলা কোচ। আমরা আছি, আজকে আছি কাল হয়তো চলে যাব। বাট ইউ উইল গোয়িং টু স্টে হেয়ার’। বারলো গেম ডেভেলপমেন্টের কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান না, আমি ওই জায়গাটা গুছাই’। সে কোচদের সেন্ট্রালাইজড করাসহ তাদের গ্রাসরুটে যাওয়া, ট্রেইনার, টিমের সাথে ট্রেইনার-ফিজিওদের ঠিক করার কাজগুলো করতেন। এসব স্ট্রাকচার আমরা তখন বুঝতাম না, কিন্ত উনিই আমাদের মধ্যে এই চেঞ্জ এনেছিলেন। সেটাই আস্তে আস্তে বাড়ছে। আজ গেম ডেভেলপমেন্ট একটা বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এটার রুপকার ছিলেন এডি বারলো, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি এমন একটা মানুষ, তিনি যখন ডার্বিশায়ারের হয়ে খেলতেন তখন মানুষ ওয়ার্ম-আপ করত না। কিন্ত তিনি ওয়ার্মআপ করতেন। তখন মানুষ হাসত আর বলত, আরে এটা কি পাগল নাকি, দৌড়াচ্ছে খেলার আগে। বারলো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আজকের জায়গাটাতে কিন্ত আমাদের ধাপে ধাপে আসতে হয়েছে, অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে। ইভেন আপনি যদি প্রতিবন্ধকতাগুলো দেখেন। প্রথম আমরা এমসিসির সাথে খেলবো অথচ স্পাইক অর্থাৎ জুতা নেই। আমি আর দৌলাত ওল্ড টাউনে গিয়ে স্পাইক বানালাম। সে জুতা আবার নেভির সাদা জুতার মতো হয়েছিল। পরে ওটা দিয়ে খেললাম। খেলার পরে তো এমসিসির প্লেয়াররা দেখে অবাক, এটা কি পরে আমরা বোলিং করছি। পরে তারা তাদের জুতাগুলো দিয়ে গেল। দৌলাতের বেশি লাভ হল। কারণ ওর পা বড় তাই ৫ জোড়া জুতা পেল। আর আমি এক জোড়াই পেলাম, ওদের স্পিনার এলেন টাফেরটা আমার পায়ে লেগেছিল। কারণ আমার সাইজ ছিল ৮। ইভেন তখন আমাদের হেলমেট ছিল না, কিছুই তো ছিল না। থাইপ্যাডও ছিল না। অনেক সময় দেখা যেত তারের টিউব দিয়ে থাইপ্যাড বানাতাম। এভাবে আমরা যাত্রা শুরু করেছি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে।
যার জন্য আমরা যখন ইংল্যান্ডে গেলাম আমরা আমাদের খাওয়ার টাকা বাচিয়ে ব্যাট, প্যাড এসব কিছু কিনেছি। আমরা যে টাকাই পেয়েছি তার ৭৫ শতাংশ কিটসের পেছনে ব্যয় করেছি। আমি ৩ জোড়া জুতা কিনেছিলাম, যার মধ্যে এক জোড়া জালাল নিয়ে গেছে। বলল, ‘না, আমাকে দিতে হবে’। তাই জালাল নিয়ে ফেলছে। কারণ আমাদের আসক্তি ছিল ক্রিকেট। তাই ওটার সাথে কোন ছাড় দেইনি। আর আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গভীর। এখনো যদি দেখেন, পুরান মানুষের সাথে যখন দেখা হয়, অনেক কথা হয়। অনেক সাংবাদিক আছেন। যেমন জালাল ভাই, এদের সাথে দেখা হলে পুরনো অনেক কথা হয়। আমাকে দেখলেই বলে ‘এই তোর পকেটে আরেকটা ফটো রাখ’। আমি বলি ‘কেন জালাল ভাই?’ বলে যে ‘আবার তো তুই আরেকটা হান্ড্রেড মারবি’। আমার জীবনে বোলার হিসেবে খেলেও আমি ৭টা হান্ড্রেড করেছি, যা অনেক ব্যাটসম্যান জীবনেও করে নাই। আমি ভাগ্যবান যে প্রত্যেক বছর একটা দুটো করে হান্ড্রেড হতো।
আপনি তো ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি ও করেছিলেন?
চৌধুরী : হ্যা,সেটা ছিলো ডিভিশনের ফাইনাল। খুলনা বিভাগ বনাম রাজশাহী বিভাগের খেলা। আমি খুলনা বিভাগে খেলেছিলাম। সে আমলে আমি বরিশাল জেলার ক্যাপ্টেন ছিলাম। আর বরিশাল জেলা তখন খুলনা বিভাগের অধীনে ছিলো। আমার বিপক্ষ দলের দুটো প্লেয়ারকে আপনারা চিনবেন। একজন হলেন সাদ,যিনি বাংলাদেশ টিমের ম্যানেজার ও বিপক্ষ দলের বোলার ছিলেন। আরেকজন হলেন এখনকার আম্পায়ার নাদির শাহ। আমি যে দলের বিপক্ষে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করেছি সেই বিপক্ষ দলের এরা বোলার ছিলেন। “
একটু বর্তমানে আসি। বাংলাদেশ দলের বর্তমান ওয়ান ডে অধিনায়ক মাশরাফি একজন পেসার। আপনিও পেসার ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সে অর্থে ভাল পেসার উঠে আসছে না কেন?
চৌধুরী : একটা জিনিস হল কি, এখন গেমটা হয়ে গেছে অন্যরকম। আগে উইকেট ফিফটি ফিফটি থাকত। ব্যাটসম্যানদের জন্যও সুবিধা থাকত, বোলারও সুবিধা পেত। কিন্ত এখন হয়ে গিয়েছে ব্যাটসম্যানদের খেলা। এখন উইকেট এত ফ্ল্যাট করে দেয়, আর প্রায় সব নিয়মই বোলারদের বিপক্ষে। তাই পেস বোলিং করা মানেই সে তার বুদ্ধি খাটাবে, তার পেস থাকবে। অনেক কিছু মিলেই সে সফল হবে। এছাড়া এটা কঠিন। আর আমাদের খেলা এত হচ্ছে যে একটা পেস বোলার রিকভারির সুযোগ পাচ্ছে না। যে কেউ; যারা প্রফেশনাল, তারা চাইবে সবসময় খেলতে। ঠিক আছে, কিন্ত আমি এই সিরিজ খেললাম, ওই সিরিজ খেললাম না। আরেকজন খেলল। এমন হলেই ভাল। কারণ নিয়মিত খেলা হচ্ছে। তাই রিকভারি হচ্ছে না। আর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, যদিও কারো সঙ্গে কারো তুলনা করা যায় না। আমার দৃষ্টিতে ১৯৭০ এ একটা দশক গেছে। যদি অভিনয়ের কথা বলেন, আমাদের ছবির অভিনেতাদের কথাই বলুন বা হকি প্লেয়ার, ক্রিকেট প্লেয়ার, ফুটবল প্লেয়ার বা রাজনীতিবিদ। ওটা একটা যুগ ছিল বলে আমি মনে করি। কিন্ত আমি কারো সাথে কারো তুলনা করতে চাই না। আপনি যদি দেখেন ডন ব্র্যাডম্যান এক সময়ের। আবার ব্রায়ান লারা, রিকি পন্টিং, টেন্ডুলকার তারা আরেক সময়ের। এখন আবার বিরাট কোহলি। কারো সাথে তুলনা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্ত হ্যাঁ, প্রতিভা সব যুগেই আছে। ক্রিকেটে কিছুটা ভাগ্যও লাগে। আপনি দেখুন আশরাফুল প্রথম ম্যাচেই হান্ড্রেড মারল, তারপর ৩টাতে নো রান। কিন্ত ও যদি প্রথমটাতে রান না পাইত তারপর ম্যাচ খেলত নাকি সন্দেহ আছে। তাই ভাগ্যও কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হ্যাঁ, আগে প্লেয়ার কম ছিল। কিন্ত তারা মারাত্মক প্রতিভাধারী ছিলেন।
খেলার যে ব্যাপারে বললেন তা নিয়ে জিজ্ঞাস করি। মোস্তাফিজ একটা ট্যালেন্ট তাতে সন্দেহ নেই। কিন্ত সে যে হারে খেলছে তা মনে হচ্ছে নেগেটিভ হতে যাচ্ছে তার জন্য। কারণ সে যে রেস্টটা দরকার তা পাচ্ছে না। টানাই খেলছে এবং বোলিংয়ে যে ধার আমরা শুরুতে দেখছিলাম তা এখন নাই। আইপিএলেই দেখলাম, বোঝাই যাচ্ছে সে ক্লান্ত, কিন্ত সে খেলেই যাচ্ছে। এটা কি নেগেটিভ না আমাদের জন্য?
চৌধুরী : এটা আমি একটু আবার আসি, পড়াশোনায়। স্পোর্টসের ওপর এদের কোনো নলেজ কম। একটা প্লেয়ার যখন যাবে সে জানবে তার জন্য নিউট্রেশনটা কি, কি খেতে হবে। ফিটনেস কতটুকু রিকভারি লাগবে। কারণ প্রত্যেকেই আলাদা। আপনি আমি বা সে। তার ওরকম ট্রেনিং, আমার এক রকম আবার আপনার এক রকম। বডি আলাদা রিয়েক্ট করে, আলাদা এক্সেপ্টেন্স আছে। এরা জানে না তাদের কতটুকু অন্যের ওপর নির্ভর করছে। কিছুটা ট্রেনার নেয়, আবার কিছুটা নিজেই ডিসিশন নিয়ে নেয়। যেমন আমার টাকার দরকার আছে, আমি খেলব। হয়ত ব্যাথা আছে, ওটা দেখাল না। ওটা নিয়েই খেলছে। সমস্যাটা হয়ত বেশি হচ্ছে, তখন সে ফিজিও কে জানাচ্ছে। কারণ টাকার জন্য, বা নামযশ, সব কিছু মিলিয়ে। তাই এই জায়গায় যখন সে জানবে, তখন সে বুঝবে। আমার যদি দীর্ঘসময় খেলতে হয় তবে এগুলো অনুসরণ করতে হবে। যেমন, পেস বোলারের ওপর গবেষণা শুরু হয়েছে ডেনিস লিলির মাধ্যমে। যখন সে ইঞ্জুর্ড হয়েছে তার কারণ কি ছিল, রিহ্যাবিলিটেশন কীভাবে হবে, ইঞ্জুরির প্রধান কারণ কি। তখন বলে যে ফিটনেসই ইঞ্জুরির মূল কারণ। আপনি ফিট না হলেই ইঞ্জুর্ড হবেন। এখন খেলা সংক্রান্ত বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে। তাই এটাই সঠিক সময় প্লেয়ারদের খেলা সংক্রান্ত বিজ্ঞানের দরকারি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার।
তার মানে খেলোয়াড়ের নিজের ওপরেই নির্ভর করছে পুরো বিষয়টা আসলে?
চৌধুরী : হ্যাঁ, যেমন নিদাহাস ট্রফিতে যে শেষ ম্যাচে আমরা হারলাম। বোলার ভীত ছিল। তার মাথা কাজ করছিল না যে আমি যদি এদিকে বল করি তাহলে আমার সুইপার ব্যাক থাকতে হবে। আমার পেছনে প্লেয়ার রেখে তো লাভ নেই। কারণ ছয় হলেই জিতবে। পেছন দিয়ে যদি ছয় মারে, পারলে মারুক। কিন্ত মাথা তো কাজে লাগাতে হবে। কিন্ত হাই-পারফরমেন্স ধরে রাখার জন্য যে মাথাটা কাজে লাগাতে হবে এই জায়গাটায় আমি মনে করি যে যদি তারা খেলা সংক্রান্ত বিজ্ঞান বোঝে, তাহলে তারা আরো ভালো ক্রিকেট খেলবে। খারাপ ফর্ম কাটিয়ে কীভাবে ফিরবে তারা তখন শিখবে। হতাশ হবে না।
শেষ প্রশ্ন, আমাদের দেশে লেভেল ওয়ান, লেভেল টু লেভেল থ্রিসহ সবধরণের কোচই আছে। তারপরও বারবার আমরা বিদেশিদের দিকেই ঝুকি। ব্যাটিং কোচ হোক, বোলিং কোচ হোক, মূল কোচ হোক। আমাদের নিজেদের কোচদের ব্যাপারে এত অনীহা কেন?
চৌধুরী : আমার এনালাইসিসে যা মনে হয় আমাদের বাংলাদেশি কোচরা এমনকি বিদেশেও যারা আছেন তারা ভালোই। বাংলাদেশিরা যেখানে কোচিং করেছে ভালোই করেছে এখন পর্যন্ত যদি বিশ্লেষণ করেন। আমি মনে করি দেশেও পরিবর্তন আসবে। অনেক সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিভিন্ন চাপ থাকে, এটা করো প্লেয়ারের সেটা করো। তবে হ্যা, সেটা নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। পাইপলাইনে যে নেই, তা নয়। বরং পাইপালাইনে আছে। যদি দেখেন আমাদের ডিস্ট্রিক্ট কোচ আছে, হাই-পারফরমেন্সের কোচ আছে। বোলিং কোচ, স্পিন বোলিং কোচ, ব্যাটিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, কিপিং কোচ সবই আছেন। এবং প্রত্যেক জেলাতেই ১৪, ১৬ ও ১৮ বয়সীদের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে, নড়াইলেই ওই গলিতে একটা প্লেয়ার আছে কিন্ত কেউ দেখে না। এটা বললে ভুল হবে। কারণ সব জেলারই কোচ আছেন, তাদের দল নিয়ে তারা খেলবেন। যেমন উদাহরণ দেই, খুলনার হলো ৮টা জেলা। এই ৮টা জেলারই অনুর্ধ্ব ১৪ টুর্নামেন্ট হবে নিজেদের ভেতর। সেখান থেকে ১৩ জন ছেলে সিলেক্ট হবে। ওদের ক্যাম্প হবার পর খুলনা ডিভিশন টিম হবে। যেহেতু বিভাগ ৮টা, আবার ঢাকা বিভাগ উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ হবে। আর খেলবে বিকেএসপি এবং ঢাকা মেট্রো। ওখান থেকে টপ ১৩টি ছেলে অনুর্ধ্ব ১৪ থেকে অনুর্ধ্ব ১৫ এর কোচ মানে আমার কাছে দেওয়া হবে। আমার হাতে ১ বছর সময় থাকবে এদের গড়ে তোলার। আমি ২ সপ্তাহের ট্রেনিং করে এদের ছেড়ে দেব কন্ডিশনিং ক্যাম্পের জন্য। দিনশেষে ১ বছর পর এরাই অনুর্ধ্ব ১৫ জাতীয় দল হবে। এইজন্যেই ক্রিকেট ফুটবল থেকে এগিয়ে গেছে। গেম ডেভেলপমেন্ট এতে ভূমিকা রেখেছে। তাই এখানেই বসেই কোচ বলে দিবে আমাদের অনুর্ধ্বতে যে ৫০-৬০ জন আছে তাতে কার পরে কে আছে।
আপনার মূলব্যান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ
চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ