ইমরান খানের বিস্ময়কর উত্থান; ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির মাঠে

ইমরান খানের বিস্ময়কর উত্থান; ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির মাঠে

ক্রিকেট মাঠ

লাহোরের জামান পার্কের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর জন্ম নেন ইমরান খান। সরকারি চাকুরিজীবী প্রকৌশলী বাবার কনিষ্ঠ সন্তান ইমরান খান ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। চাচাতো ভাই মাজিদ খানের অনুপ্রেরণায় ক্রিকেটের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান ইমরান খান। তার পরে তার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সারা দুনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের মহানায়কদের কাতারে স্থান করে নেন এই দীর্ঘদেহী সুদর্শন খেলোয়াড়। অনেকের চোখেই ইমরান খান মানেই যেন এক ক্রিকেট নস্টালজিয়া।

৮১ তে জাতীয় ক্রিকেট দলের নেতৃত্বে এসে পুরো পাকিস্তান দলের কাঠামোই বদলে ফেলেন। ক্রিকেটে নিরপেক্ষ আম্পায়ার নিয়ে আসার প্রবক্তা হচ্ছেন ইমরান খান। ইমরান খানের যাদুকরী নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে পাকিস্তান।

সমাজ সেবা

দুরারোগ্য ক্যান্সারে মাকে তিলে তিলে মরতে দেখে ইমরান খান সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানে ক্যান্সার হসপিটাল তৈরি করবেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সহায়তায় পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে প্রতিষ্ঠা করলেন শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটাল। অনুরূপভাবে পেশোয়ারেও গড়ে তুললেন আরেকটি ক্যান্সার হসপিটাল। এসব হাসপাতালে ৭০ শতাংশ চিকিৎসা হয় অসহায় দরিদ্রদের যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। নিজ জেলা মিয়াওয়ালিতে গড়ে তুললেন নেমল নলেজ সিটি।

রাজনীতির মাঠ

এইভাবে সমাজ সেবা করে যে পোষাচ্ছিল না। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ইমরান বৃহৎ পরিসরে জনকল্যাণে কিছু করার তাগাদা অনুভব করেন। আর এই ধরণের কল্যাণের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগের পরিধিতে তিনি পেরে উঠছিলেন না যেন। তাই ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল গঠন করলেন পাকিস্তান তেহেরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির মূলোৎপাটনের স্লোগানকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে শুরু করলেন। রাজনীতিতে নেমে মুদ্রার ওপিঠও দেখতে লাগলেন। ১৯৯৭ এর জাতীয় নির্বাচনে নিজ জেলা মিয়াওয়ালি থেকে প্রার্থী হয়ে হেরে যান।

৯৯ তে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পর তৎকালীন সামরিক শাসক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার অভিপ্রায়ে কিংস পার্টি গঠন করলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাফ)। ইমরান খানকে মুসলিম লীগ (কাফ) এ আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ইমরান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এককভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০২ এর সেই নির্বাচনে ইমরান খান নিজ আসন ব্যাতীত অন্যকোন আসন থেকে দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। জেনারেল মোশারফের প্রো আমেরিকান নীতির তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন ইমরান খান। পাকিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন।

২০০৮ এর জাতীয় নির্বাচনকে পাতানো নির্বাচন আখ্যায়িত করে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি ইমরান খান। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির মূলোৎপাটনের স্লোগান পাকিস্তানের শিক্ষিত তরুণ সমাজ লুফে নেয়। ধীরে ধীরে সেদেশের শিক্ষিত ও তরুণ সমাজের মধ্যে ইমরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। সেদেশের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা তেহেরিক-ই-ইনসাফে যোগদান করেন। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরের মিনারে পাকিস্তান ময়দানে বিশাল জনসভার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ইমরান খানের তেহেরিক-ই-ইনসাফের। সেই জনসভার পর থেকে পাকিস্তানের মিডিয়া ও সুশীল সমাজে ইমরান খান গুরুত্ব পেতে শুরু করেন।

আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী অবস্থানের কারণে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা সেদেশের শিক্ষিত ও তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক এস্টাবলিশমেন্ট চাচ্ছিলেন না ইমরান খান পাকিস্তানের চীফ এক্সিকিউটিভ এর চেয়ারে বসুক। ২০১৩ এর জাতীয় নির্বাচনে ইমরানের দলের প্রার্থীদের ৮০ শতাংশ ছিল অনভিজ্ঞ ও তরুণ।

২০১৩ এর নির্বাচনকে ইমরান খান পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচে জঘন্য ও কারচুপির নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দেয়। নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে প্রায় ৮৪ লাখ ভোট পেয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের। বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে প্রধান বিরোধীদল ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

২০১৩ এর নির্বাচন কারচুপি হলেও দেশের স্বার্থে মেনে নিয়ে মাত্র ৪টি আসনের ব্যালট বাক্স পুনরায় গণনার আহবান জানান। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচনের এক বছর যেতে না যেতেই ৪ আসনের ব্যালট বাক্স খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের পাশে রেড জোনে দাবি আদায়ে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ইমরান খানের দল। সারাদেশে আন্দোলন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানে আবার সামরিক শাসনের গুঞ্জন উঠতে থাকে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহীল শরীফ সাক্ষাৎ করতে আসলে ইমরান খান কোন ধরনের সেনা হস্তক্ষেপকে সমর্থন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ১২৬ দিন অবস্থান কর্মসূচি চলার পর পাকিস্তানের পেশোয়ার আর্মি স্কুলে তালেবানের সশস্ত্র হামলায় ১৪৬ জন স্কুল ছাত্র নিহত হলে ইমরান খান অবস্থান কর্মসূচি বাতিল ঘোষণা করেন।

২০১৬ তে বিশ্বব্যাপি হৈ চৈ ফেলে দেয়া পানামা পেপারসে নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের অবৈধ সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ইমরানের হাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম হাতিয়ার চলে আসে। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও বেশিরভাগ মিডিয়া অনবরত এ সংবাদ প্রচার করে জবাবদিহিতার আহবান জানান নওয়াজ শরীফকে। ইমরান খান পার্লামেন্টে পানামা পেপার্সে উঠে আসা সম্পদের সঠিক হিসাব দেয়ার আহবান জানান। নওয়াজ শরীফ বিরোধীদের সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন- আদালত চাইলে আদালতকে তিনি জবাব দিবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ এ স্লোগানে পুরো পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন ইমরান খান। অবশেষে দেশের এ অরাজক পরিস্থিতিতে সেদেশের সুপ্রিমকোর্ট সুয়ো ম্যুটো জারি করেন।

পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস এ মামলা চলাকালে নওয়াজ ও তার সন্তানেরা পানামা পেপার্সে উঠে আসা সম্পদের পক্ষে কোন প্রমাণাদি উপস্থাপন করেননি। উক্ত সম্পদকে কাতারের আমীর উপহার হিসেবে দিয়েছেন মর্মে কাতারের আমীরের স্বাক্ষরিত চিঠি উপস্থাপন করে সুপ্রিমকোর্টে। পরবর্তীতে এ চিঠি ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধানের আর্টিকেল- ৬২(এফ) অনুচ্ছেদে জনগণের বিশ্বস্ত নন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন মর্মে সেদেশের সুপ্রিমকোর্ট নওয়াজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ও আজীবন রাজনৈতিক যেকোন পদের অযোগ্য ঘোষণা করেন। নওয়াজ শরীফের অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার এ মামলার বাদী ইমরান খানের এ প্রচেষ্টা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়।

আগামী আগস্টে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক ও সেদেশের মিডিয়ার নজরে এখন ইমরান খান। ইতিমধ্যে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছেন ইমরান খান, শরীফ খান্দানের শহর লাহোরের মিনারে পাকিস্তান ময়দানে বিশাল মহাসমাবেশের মাধ্যমে। মুসলিম লীগ (নওয়াজ) নুনের শক্ত ঘাটি লাহোরে এতবড় বিশাল গণজমায়েত করে ইমরান খান সেদেশের রাজনৈতিক বোদ্ধাদের হতবাক করে দিয়েছেন। গত ২৯ শে এপ্রিলের এ জনসমাগম পশ্চিমা গণমাধ্যম গুরুত্বের সাথে কাভারেজ দিয়েছে। সেদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের মতে ইমরান খানের এ জনসভায় প্রায় ৩-৫ লাখ লোকের উপস্থিতি ছিল। মুসলিম লীগ নুনের হোম টাউনে এতবড় জনসভা দেখে ইমরানের সমালোচকরাও বলতে শুরু করেছেন আগামী নির্বাচনে ইমরানই এক্স ফ্যাক্টর।

পাকিস্তানের ২৭২ আসনের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কে হবে তা আর কিছুদিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সৌদি রাজবংশের অপছন্দের পাত্র ইমরান খান কি পাকিস্তানের উজিরে আজমের চেয়ারে আরোহণ করতে পারবেন? ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিস্ময়কর একটি ঘটনা হিসেবেই উল্লেক থাকবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতেও দেখা দিতে পারে নতুন সম্ভাবনার হাতছনি।