এ বছরের প্রথম চারমাসে ভারতে মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ সময় পার করছে। বিশেষ করে কিছুদিন ধরে মুসলিম বিদ্বেষী সন্ত্রাসের কোন ধরনের বিচার না হওয়ায় এই ভয় দিন দিন বেড়ে চলেছে।
এমনকি যেকোনো পর্যবেক্ষক পর্যন্ত মুসলিমদের এ রকম সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটাকে খুব সরল চোখেই দেখতে পারবেন।
গত জানুয়ারিতে জম্মু ও কাশ্মিরের কাঠুয়া জেলায় ৮ বছর বয়সী শিশু আসিফাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এই মেয়ে শিশুটি মূলত বাকারওয়াল যাযাবর মুসলিম সম্প্রদায়ের। বলা হচ্ছে, শিশুটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পেছনে আছে ৮ জন হিন্দু। প্রাথমিক অভিযোগে বলা হয়, অপরাধীদের মধ্যে একজন আছেন রাজস্ব কর্মকর্তা আরেকজন পুলিশের অফিসার।
নিরীহ শিশুটির গুম হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর যখন তার লাশ বনের ভেতরে এক মন্দিরে পাওয়া গেল, তখন বাকরওয়ালের জনগণ এর বিশেষ তদন্ত দাবি করল। পরবর্তীতে কোর্টের পর্যবেক্ষণে এসেছে এই হত্যা ছিল উদ্দেশয়প্রণোদিত এবং পরিকল্পনা মাফিক। এই হত্যার দুরবর্তী লক্ষ্য ছিল কাঠুয়া জেলা থেকে বাকরওয়াল সম্প্রদায়ের লোকজনদের উচ্ছেদ করা।
গত মাসে, যখন হিন্দু পন্ডিত এবং মুসলিমদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্তকারীদের বিশেষ দল সেখানে পৌছায়, সেখানের আইনজীবিদের বার সমিতির লোকজনের বাদ –প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয় তাদের।
তারা সেই তদন্ত দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ র্যালি করেন এবং এই তদন্ত দলকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করেন। তারা সে নিহত শিশুর হত্যাকারীদের বিচার চায়, তবে তারা এই তদন্ত দলের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করে। তারা কেন্দ্রীয় সিবিআই’র অধীনে তদন্তের দাবি তোলে।
অথচ বার সমিতির আইনজীবিদের কিছু দাবি ছিল, যার সরল মুসলিম-বিদ্বেষ। যেমন, সেখানের ভূমি বিষয়ক নীতিতে আছে, যাযাবর সম্প্রদায়ের যেসব জমি তারা নানা কারণে হারিয়েছিল, সেসব তারা চাইলে ফিরে পেতে পারে। এছাড়া সে প্রতিবাদ র্যালিতে সেখানকার হিন্দুদের সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের লোকজন ছিল, তারা ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোরও দাবি জানায়। অথচ এই দুটি দাবির একটিও সে মাসুম শিশুটির ইনসাফ পাওয়ার সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। এবং এভাবেই তারা সংগঠিত হয়ে মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডার জানান দিচ্ছে।
ফলে আজ পর্যন্ত সকল প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা মনে করছে, এই হত্যার সাথে কোনভাবেই হিন্দু জড়িত নয়। উল্টা তারা মনে করে, এই হত্যাকাণ্ড আসলে রোহিঙ্গা বা খোদ বাকরওয়াল জনগোষ্ঠীরই কাজ। তারা বিশ্বাস করে এসব আসলে হিন্দুদের ছোট করতে কাশ্মিরী-মুসলিমদের ষড়যন্ত্র।
তাদের প্রতিবাদের শুরুটা নিরপেক্ষ তদন্তের পক্ষে হলেও এখন সেটি মুসলিম বিদ্বেষের দিকে মোড় নিয়েছে। এমনকি এই হত্যার সাথে হিন্দু লোকজন জড়িত আছে, প্রাথমিক তদন্তের এই ব্যাপারটিকেও তারা বেমালুম অস্বীকার করছে। শুধু এই মুসলিম-বিরোধী এই মানসিকতা যে কাঠুয়ার আইনজীবীদের কেবল আছে, তেমনটা নয়। আজ এই বিদ্বেষ ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দল ছাড়াও সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে।
তদন্ত দলের চার্জশীট দেওয়াকে প্রত্যাখান করে আইনজীবীদের এই আন্দোলন সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। এর ফলে সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে ভারতের কেন্দ্রীয় বার কাউন্সিলকে ঘটনাস্থলে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি পাঠানোর আদেশ দেয় সুপ্রীম কোর্ট।
পরবর্তীতে সেই রিপোর্টে এসেছে যে, সেই নতুন দলের তদন্তে তারা আগের দলকে কাজ করতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে সেখানকার আইনজীবীদের কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই, এটি বরং মিডিয়ার সৃষ্টি বলেই তারা দাবি করে। এবং এই দলটিও সেই আইনজীবীদের সুরে সুর মিলিয়ে সিবিআই এর অধীনে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তোলে।
সেই ঘটনার পর বিজেপির অনেক নেতাই প্রকাশ্যে সেই হত্যাকারীদের পক্ষে গলাবাজি করেছেন, এবং তদন্তকাজের সমালোচনাও করেছেন। জম্মু ও কাশ্মিরের দুজন বিজেপি মন্ত্রী অভিযুক্ত ধর্ষক-হত্যাকারীদের পক্ষে মিছিলও করেছেন। এবং অবশ্য একারণে তাদের মন্ত্রীত্বের আসন থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে।
বিজেপি মন্ত্রীদের পদত্যাগের পর সব শেষ হয়ে যায়নি। নতুন মন্ত্রিসভায়ও পাওয়া গেল একজনকে, যিনি ধর্ষকের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নতুন এই ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাঠুয়ার ঘটনাটি খুবই সাধারণ ঘটনা, শুধুশুধু এ নিয়ে উচ্চাবাচ্য হয়েছে।
নমুনা হিসেবে কাঠুয়া নয়, এরকম অনেক ঘটনা আছে যা বলে দেয় মুসলিমরা কেন আজ সেখানের সরকার বা বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছে না।
মার্চের রাম-নবমীতে ভারতের অনেকগুলো প্রদেশে সহিংসতা হয়েছে। বিহার-পশ্চিম বাংলাসহ নানা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা হয়েছে। অনেক জায়গায় মুসলমানদের বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত চার বছর ধরেই আমরা এসব দেখে আসছি, কিন্তু ২০১৮ অতীতের সকল কিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবং এক্ষেত্রে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত এপ্রিলে গুজরাটে ২০০২ সালের ঘটনায় ৯৭ জনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মায়া কোদনানির ২৮ বছরের জেল হওয়া সত্ত্বেও সেই রায় ঘুরে যায়। তার সহযোগী বাউ বজরংগীকেও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই রায়ই প্রমাণ করে বিচারিক দায়িত্বশীলরা এই বিচারের ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে চাননি। দুজনের এই দায়মুক্তি মুসলিমদের বীতশ্রদ্ধ করেছে, যারা সেই গুজরাটের দাঙ্গার চিহ্ন-স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এপ্রিলের আরেকটি ঘটনা, ২০০৭ সালে মক্কামসজিদে বোমা হামলায় ৯ জনকে হত্যায় অভিযুক্তদেরও মুক্তি দেওয়া হয়। লক্ষ্যণীয় যে, এই ছাড়া পাওয়া অভিযুক্তরা হিন্দুত্ববাদের একাগ্র পূজারী।
এই মামলার ক্ষেত্রেই বোঝা গেছে কিভাবে এসব সংগঠন মুসলিম হত্যায় ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে। সেই মামলার মূল কৌসুলী রোহিণী সালিয়ানের জবানিতে আমরা জানতে পারি, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ কিভাবে তাকে অভিযুক্তদের ব্যাপারে ‘নরম’ হওয়ার জন্যে জবরদস্তি করছিল। কিছুদিন আগেও এক সাক্ষাৎকারে পুনরায় সে এই দাবি করেছে।
তার আগে, উত্তরপ্রদেশ সরকার হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে করা ১৩১ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়, যার মধ্যে ১৩টি হত্যা মামলা এবং ১১টি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। আছে ২০১৩ সালের মুজাফফরগর এবং শামলির মত বর্বর ঘটনার মামলাগুলোও।
এপ্রিলের শেষের দিকে, দিল্লির গুরুগ্রাম থেকে ছয় হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ ছিল, তারা নানাভাবে জুম্মা নামাজে বিশৃখংলা সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তাদেরও পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
আরো উদ্বেগের কথা হল, ৫০০ এর অধিক মানুষ নানা হিন্দুয়ানী পোশাকে এই ৬ জনের পক্ষে নেমে এসেছিল। এই মিছিল থেকে অভিযুক্তদের মুক্তিসহ প্রকাশ্যে বা সরকারি জায়গায় ধর্মীয় প্রার্থনায় নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানায়।
আজ ভারতের মুসলিমরা মনে করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং স্নায়ুবিক যুদ্ধ চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম-বিদ্বেষীদের সরকার সহযোগিতা না করলেও উপরে আমি দেখিয়েছি কিভাবে রাষ্ট্র এসব কিভাবে বেমালুম চোখ বন্ধ করে থাকে। যেহেতু সাধারণ নির্বাচনের দিনকাল ঘনিয়ে আসছে, তাই মুসলিম-বিদ্বেষ দিন দিন বাড়বে বলেই সবার আশঙ্কা। এটিই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটারকে আন্দোলিত করার সবচেয়ে ভাল এবং বৈধ কায়দা।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাহিত্য সমালোচক অপুর্বানন্দ এর লেখাটি আলজাজিরার মতামত পাতায় ৩ মে ২০১৮ প্রকাশিত হয়।