প্রাচীন রোম সম্রাটদের ঘোষণাপত্রগুলো ‘অ্যাক্টা দিউরমা’ নামে প্রকাশিত হতো। সেই ঘোষণাপত্রগুলো ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনগণের পড়ার সুবিধার্থে নির্দিষ্ট স্থানে টাঙিয়ে দেওয়া হতো। উক্ত ঘোষণাপত্রগুলোকে সংবাদপত্রের আদি উৎস বলে মনে করা হয়।
তবে দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম প্রকাশ ঘটে চীনে। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘কাইয়ুয়ান ঝা বাও’ বা আদালতের বার্তা। অষ্টম শতাব্দীর দিকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত বলে অনুমান করা হয়। এটি মূলত সিল্কের উপর হাতে লেখা পত্রিকা ছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় মোঘল আমলে। মোঘলরা সাংবাদিকদের ‘ওয়াকিয়া নবিশ’ নামে অভিহিত করত। ‘ওয়াকিয়া’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ঘটনা এবং ‘নবিশ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে- লেখক। অর্থাৎ যিনি সংঘটিত ঘটনার বিবরণ লিখতেন তাকে ওয়াকিয়া নবিশ বলা হত। মোগল আমলে সম্রাট আকবরই প্রথম সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রদেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক অংশে কেন্দ্রের অনুরূপ ওয়াকিয়া নবিশ নিয়োগের প্রচলন করেন। এই সময়ে বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ওয়াকিয়া নবিশদের নিযুক্ত করা হতো। এ প্রথা মোগল আমলের শেষ অব্দি চালু ছিল। যদিও সময়ের ব্যবধানে এ বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের দক্ষতার তারতম্য ঘটতো।
মোঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আদলেই প্রাদেশিক শাসন কাঠামো নির্ধারণ করা হতো। সুবাদার ছাড়াও প্রত্যেক প্রদেশের নির্দিষ্ট বিভাগের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা নিযুক্ত হতেন। যেমন, দীউয়ান, মীর-আদল, সদর প্রমুখ। তাদের মধ্যে ওয়াকিয়া নবিশ সরকারের সংবাদ লেখক অথবা রাজকীয় দফতরের লেখক হিসেবে কাজ করতেন। মোঘল প্রশাসন পূর্ববর্তী সুলতানি প্রশাসনের গোপনীয় বিভাগের কর্মকর্তা বা তাদের গোপন তথ্য সংগ্রহকারীদের দপ্তর কাঠামো পুনর্গঠন করেন এবং দাপ্তরিক রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য পৃথক শাখা গঠন করে। ফলে মুঘল প্রশাসনিক কাঠামোতে চার জন দায়িত্বশীল ব্যক্তি দ্বারা দফতর সৃষ্টি করা হয় যারা লিখিত এবং মৌখিক এ দুই ধরণের সংবাদ পরিবেশন করার জন্য তৈরি থাকত। এ সময়ে তিন প্রকারের লিখিত এবং এক ধরনের মৌখিক সংবাদদাতা ছিলেন। লিখিতভাবে সংবাদ পরিবেশনের জন্য নিয়োজিত ছিলেন: (১) ওয়াকিয়া নবিশ বা ওয়কিয়া নিগার, একাধারে ঘটনার লেখক বা ঘটনার পর্যবেক্ষণ; (২) সাওয়ানিহ নবিশ বা সাওয়ানিহ নিগার, ঘটনার বিররনীর ধারক; (৩) খুফিয়া নবিশ বা গোপন লেখক।
সম্রাট আকবরের সময় তার নওরতন সভার সদস্য আল্লামা আবুল ফজল কর্তৃক প্রণীত ‘আইন-ই-আকবরি’ নামক গ্রন্থের ১০ নং আইনে ‘Regulations Regarding the Waqia Nawis’ শিরোনামে ওয়াকিয়া নবিশ তথা সাংবাদিকদের বিস্তৃত কর্মপরিধির আলোচনা রয়েছে। আইনটির ভুমিকায় বলা হয়েছে–
“Keeping record is an Excellent thing for a government; it is even necessary for every rank of society. Though a trace of this office may have existed in ancient times, its higher objects were but recognized in the present reign.”
সে সময়ে সাংবাদিকদের জন্য আইন প্রণয়নের পেছনে সম্রাটের উদ্দেশ্য কী তা বর্ণনার পাশাপাশি সাংবাদিকের গুণাবলিও উল্লেখ করা হয়েছে। আইনটিতে বলা হয়েছে–
“His majesty’s object is, that every duty be properly performed; that there be no undue increase, or decrease in any department; that dishonest people be removed, and trustworthy people be held in esteem; and that active servants may work without fear, and negligent and forgetful men be held in check.”
ওয়াকিয়া নবিশ তার ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছিলেন স্বাধীন। তবে সরকারি কোনো বিবরণ সুবাদারের কাছে প্রকাশ করার ব্যাপারে তার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারা সম্রাট ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো কর্মকর্তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। ব্যক্তিগত সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা বন্ধ করার বিষয়ে তাদের উপর নির্দেশ ছিল এবং সে কারণেই এই পদটি অর্জন করা ছিল নাজুক ও দুঃসাধ্য।
ওয়াকিয়া নবিশকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কাজেই নয়, সামরিক কাজেও সম্পৃক্ত করা হত। তারা সাধারণত সব ধরণের সামরিক অভিযান এবং বিদেশে পাঠানো দূতের সফর সঙ্গী হতেন। তারা যুদ্ধরত সেনা দলের সংবাদ সংগ্রহ করে তা সম্রাটের কাছে পাঠানোর আগে সেনাপ্রধানের কাছে পাঠাতেন।
মূলত একজন ওয়াকিয়া নবিশ প্রদেশ সমূহের যাবতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিহিত করার দায়িত্ব পালন করতেন। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের আদি উৎস হিসাবে মোঘলদের এই ওয়াকিয়ানবিশ প্রথা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুদ্রিত সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি জেমস আগাস্টাস হিকি ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘ক্যালকাটা জেনারেল এডভারটাইজার’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে মুদ্রিত সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু করেন। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে হিকির হাত ধরে। ইংরেজিতে পত্রিকাটির নাম ছিল নিম্নরূপ–
H I C K Y SÕ
BENGAL GAZETTE
OR THE ORIGINAL
Calcutta General Advertiser.
ইংরেজ কোম্পানির শাসন পরিচালনা সম্পর্কিত তথ্য, পরিবহণ ব্যবস্থা, ইংল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ ও বিকাশমান বাণিজ্য বাজারের প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের চাহদা তৈরি হয়। তাছাড়া মুদ্রণশিল্পের বিকাশ ও বসবাসরত ইংরেজদের জন্য সংবাদপত্র প্রকাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
১৬৯০ সালে কলকাতা নগরের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৭৫০ সাল থেকে ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সি নাম নিয়ে কলকাতায় ব্রিটিশদের মোটামুটি একটি স্বাধীন এলাকা চালু হয়। ১৭২৭ সালে ইংরেজরা কলকাতায় একটি মেয়র আদালতও প্রতিষ্ঠা করে।
পলাশীর যুদ্ধের পর ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। ফলে কলকাতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কলকাতা শহরকে আরও আধুনিকায়ন করা হয়। কলকাতায় সুপ্রিমকোর্ট, থিয়েটার, এশিয়াটিক সোসাইটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতায় এক ধরণের উপনিবেশিক সংস্কৃতির চেতনা তৈরি হতে থাকে।
১৯৮০ সালের মধ্যে কলকাতা পুরোপুরি ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়। তখন নতুন নতুন ব্রিটিশ চাকুরিজীবী ও নাগরিকরা কলকাতায় আসতে থাকে। এমনকি স্বামী সন্ধানের জন্য কিছু কিছু ইংরেজ কন্যারাও জাহাজে করে কলকাতা বন্দরে এসে ভিড় জমাতে থাকে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সে সময়ে বাণিজ্যিক কাজের জন্য প্রায় ১২২৫ জনের মত ইউরোপীয় নাগরিক বসবাস করত। কলকাতার এই বাণিজ্যিক গুরুত্বও এখানে সংবাদপত্র প্রকাশের জরুরত বাড়িয়ে দেয়।
মার্গারিট বার্নস তার ‘ইন্ডিয়ান প্রেস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কোম্পানি শাসন ও একচেটিয়া অধিকারে অসন্তুষ্টরাই ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেন’। বাস্তবতা হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কখনোই সংবাদপত্র প্রকাশের পক্ষে ছিল না। তাদের ভয় ছিল পত্র-পত্রিকা কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রকাশ করে দেবে। ফলে তখন যারাই পত্রিকা প্রকাশ করতে চাইতো তাদের দমন করে দেয়া হতো।
এসব প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও ১৭৮০ সালে হিকি ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। এর কারণ হচ্ছে, তার পিছনে সহায়তা করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিলর সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস।
কিন্তু হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের চার বছর আগেই তথা ১৭৭৬ সালে ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চানান উইলিয়াম বোল্টস। জন্মসূত্রে ওলন্দাজ বোল্টস ১৭৫৬ সালে ভারতবর্ষে আসেন। প্রথমে তিনি ক্লাইভের সঙ্গে ১১ বছর কাজ করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার থেকে তিনি ক্রমান্বয়ে কুঠিয়াল ও কাউন্সিলরের সহকারী প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। তারপরেও কোম্পানি তাকে ভাল নজরে দেখতো না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তিনি কোম্পানির স্বার্থ না দেখে ব্যক্তিগত উপার্জনে বেশি মনযোগী এবং ওলন্দাজ কোম্পানির কাছে তিনি তথ্য পাচার করেন। এসব অভিযোগে শেষ পর্যন্ত চাকরি থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়।
ভারতে এসেই বোল্টস বাংলা ভাষা রপ্ত করেছিলেন। চাকরি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পরে তিনি ছাপাখানা স্থাপন ও পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করেন। ১৭৭৬ সালে তিনি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে কলকাতার কাউন্সিল হাউসের দেওয়ালে নোটিশ লটকে দেন। কিন্তু তখনও ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ভিত খুব মজবুত হয়নি। বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্টে ক্লাইভ সবেমাত্র দিল্লীর সম্রাটের কাছ থেকে প্রতিবছর ২৬ লাখ টাকা কর দানের শর্তে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করেছেন।
এই নতুন দায়িত্ব গ্রহণের মুহূর্তে সরকারের এমন বৈরি ব্যক্তির হাতে মুদ্রণযন্ত্রের মত শক্তিশালী একটি প্রচারযন্ত্র তুলে দিতে রাজি হননি ক্লাইভ। বরং ক্লাইভ উল্ট এই পরিকল্পনা বা ইচ্ছা প্রকাশের কারণে বোল্টসকে ভারতবর্ষ থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বোল্টসকে জোরপূর্বক ইউরোপগামী একটি জাহাজে তুলে দেয়া হয়। আর সেই সাথেই ভেস্তে যায় ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ। ফলশ্রুতিতে এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের ওপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের যে উদ্যোগ, তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। এই অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা এখনো সেই উপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রতি শনিবার প্রকাশিত হত। পত্রিকার সিংহভাগ জুড়ে থাকত বিজ্ঞাপন। পাশাপাশি বিদেশি পত্রিকার কিছু উদ্ধৃতি, স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকদের লেখা, সম্পাদক হিকির লেখা, কবিতা কর্নার ও কলকাতায় বসবাসরত ইউরোপীয়দের জীবনাচরণ নিয়ে কিছু আলোচনা পর্যালোচনা প্রকাশিত হত। ১২ ইঞ্চি লম্বা, ৮ ইঞ্চি চওড়া ‘বেঙ্গল গেজেট’ মোট ৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতো। প্রতি পৃষ্ঠার থাকতো ৩টি করে কলাম। অঙ্গসজ্জা ছিল খুবই সাধারণ মানের। বিষয়বস্তুর মধ্যেও তেমন কোন সমন্বয় ছিল না।
হিকির সাংবাদিকতার রুচি উন্নত ছিল না। তিনি প্রায়ই ওয়ারেন হেস্টিংস, হেস্টিংসের স্ত্রী আনা মারিয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইমপে প্রমুখকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক লেখালেখি প্রকাশ করতেন। এমন সময়ে আবার হিকিকে সহায়তা দানকারী ফিলিপ ফ্রান্সিস ভারত থেকে স্থানান্তরিত হন। ফলে ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর দুর্দিন শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া পত্রিকার চালাতে গিয়ে হিকি ঋণেও জর্জরিত হয়ে পড়েন। এমনকি ঋণের দায়ে জেলও খাটেন বহুদিন।
১৪ নভেম্বর ১৭৮০ সালে সরকারি নির্দেশ জারির মাধ্যমে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ‘বেঙ্গল গেজেট’ বিলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। গভর্নর জেনারেলের পক্ষ থেকে হিকির বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। উক্ত মামলায় ১৭৮১ সালের জুন মাসে হিকিকে গ্রেফতার করা হয়। তারপরেও হিকি জেলখানায় বসেই পত্রিকার সম্পাদনা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে তার লেখনীর ভাষা আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। ফলে পত্রিকার চাহিদা আরও বেড়ে যায়। বিচারে হিকির ২ বছরের কারাদণ্ড এবং ২ হাজার রূপি জরিমানা করা হয়। এছাড়া, মানহানির অভিযোগে হিকিকে হেস্টিংসের নিকট ৫ হাজার রূপি ক্ষতিপূরণও দিতে বলা হয়।
এখানেই শেষ নয়, ১৭৮২ সালে হিকির ছাপাখানা সরকার আটক করে এবং তা বিক্রি করে দেয়। এভাবে ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর কন্ঠরোধ করা হয়।
উইলিয়াম বোল্টসের ব্যর্থ প্রচেষ্টা এবং হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর অভিজ্ঞতাও সুখকর হয়নি। কিন্তু এই প্রচেষ্টাই অত্র অঞ্চলে সংবাদপত্রের ধারণাকে বিকশিত করে। হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই মেসিঙ্ক নামক এক ব্যবসায়ী ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৭৮০ সালের নভেম্বর মাসে এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
১৭৮০ থেকে ১৭৯৯ সালের মধ্যে কলকাতা থেকে কমপক্ষে আরও ১০টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলি হচ্ছে–
১. বেঙ্গল জার্নাল (১৭৮৫)
২. দি ক্যালকাটা ক্রনিকল (১৭৮০)
৩. দি ক্যালকাটা গেজেট (১৭৮৪)
৪. অরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন অব ক্যালকাটা এমিউজমেন্ট (১৭৮৫)
৫. ক্যালকাটা ম্যাগাজিন (১৭৯১)
৬. ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড (১৭৯৪)
৭. ক্যালকাটা কুরিয়র (১৭৯৫)
৮. ইন্ডিয়া এপোলো (১৭৯৫)
৯. বেঙ্গল হরকরা (১৭৯৮)
১০. দি রিলেটর (১৭৯৯)
ব্রিটিশ সরকারের সংবাদপত্র দমননীতি অব্যহত থাকে। ‘বেঙ্গল জার্নাল’-এর সম্পাদক ছিলেন আমেরিকান আইরিশ উইলিয়াম ডুয়েন। তিনি ছিলেন মূলত একজন মুদ্রণ ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে ভুল সংবাদ ছাপানোর অভিযোগ আনে। শাস্তি হিসাবে সরকার তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলে। ডুয়েন এতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে সরকার তাকে ভারত থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ভারতে অবস্থিত একজন ফরাসি কর্মকর্তা ফুমেরনের হস্তক্ষেপে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু বেঙ্গল গেজেটের সম্পাদক পদ থেকে তাকে সরে দাড়াতে হয়।
তবে এতে দমে যাননি ডুয়েন। ১৭৯৪ সালে তিনি ফের ‘ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ৩ বছরের মাথায় তিনি আবারো সরকারি রোষানলে পড়েন। তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ব্রিটিশ সরকারের চাপে পাঠক ও বিজ্ঞাপন দাতারা ‘ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড’ বয়কট শুরু করে। বাধ্য হয়ে ডুয়েন পত্রিকা বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৯৫ সালের ১ জানুয়ারি পত্রিকার মালিকানা হস্তান্তরের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু ঠিক তার আগের দিন তাকে গ্রেফতার করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়। সেখান থেকে তাকে জোরপূর্বক ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেয়া হয়। এভাবে তাকে নেক্কারজনক ভাবে ভারত থেকে বিতাড়িত করা হয়।
ব্রিটিশ শাসকদের সংবাদপত্র দমনের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ১৭৯৮ সালে ড. চার্লস ম্যাকলিন ‘বেঙ্গল হরকরা’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় একবার ডাক বিভাগের এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সমালোচনা করা হয়। এতে সরকারের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। সরকার তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলে। তিনি তাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। ফলে ব্রিটিশ সরকার প্রথমে ম্যাকলিনকে গ্রেফতার করে এবং পরে তাকে ভারত থেকে বহিষ্কার করে দেয়।
এরপর ‘এশিয়াটিক মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক চার্লস কে ব্রুক-এর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। ব্রুক মহীশুরের যুদ্ধ নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান তার পত্রিকায় তুলে ধরেন। এতে ব্রিটিশ সরকার ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। সরকার সংবাদমাধ্যমের ওপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাই ১৭৯৯ সালের মে মাসে ব্রিটিশ সরকার ৫ দফা রেগুলেশন আইন প্রবর্তন করে। উক্ত ৫ দফা হচ্ছে–
১. প্রত্যেক পত্রিকার শেষে পৃষ্ঠার নিচের দিকে মুদ্রকের নাম ছাপতে হবে।
২. সরকারের প্রধান সচিবের কাছে প্রতিটি পত্রিকার সম্পাদক, সত্ত্বাধিকারীর নাম পাঠাতে হবে।
৩. রোববার কোন পত্রিকা প্রকাশ করা যাবে না।
৪. সরকারের প্রধান সচিবের অজান্তে কোন পত্রিকা প্রকাশ করা যাবে না।
৫. উল্লিখিত ৪টি নির্দেশের যে কোন একটি অগ্রাহ্য করলে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সবাইকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের হাতে যে ৫ দফা রেগুলেশনের গোড়াপত্তন হয়েছিল, আজকের বাংলাদেশের মিডিয়ার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ তার ধারাবাহিকতা মাত্র।
এরপর থেকে ব্রিটিশ সরকার ৫ দফাকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়ার ওপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অব্যহত রাখে। কিন্তু এই ৫ দফাতেও কিছু ফাঁক ফোঁকর রয়ে যায়। ঠিক সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগান মর্নিং পোষ্টের মালিক ও সম্পাদক হিটলী। তৎকালীন মুখ্য সচিব উইলিয়াম বাটারওয়ার্থ বেইলির কাছে সম্পাদক হিটলী একটি নিবন্ধ পাঠান। বেইলি ওই নিবন্ধের বিশেষ কিছু অংশ বাদ দিয়ে তা প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু সম্পাদক হিটলী উক্ত নির্দেশ অমান্য করেন। এই অপরাধে সরকার হিটলীকে ভারত থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। তখন হিটলী জানান যে, তার বাবা ইউরোপীয়, কিন্তু মা ভারতীয়। অতএব সরকার তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না। অর্থাৎ সরকার চাইলেই তাকে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দিতে পারবে না। এতে ৫ দফা সেন্সরশিপের অসারত্ব ও ফাঁক ফোঁকর প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আইন বাতিল করে দেয়।
কিন্তু ৫ দফা বাতিলে সংবাদপত্রের কোন স্বাধীনতা আসে না। বরং এর বিকল্প হিসাবে সরকার আরও কঠিন ও নিয়ন্ত্রণমূলক ‘৪ দফা আইন’ প্রবর্তন করে। উক্ত ৪ দফা হচ্ছে–
১. সরকার সম্পর্কিত, কোম্পানির ডাইরেক্টর বা অন্য কোন সরকারি কতৃপক্ষের কর্মপদ্ধতি বা তাদের নেয়া কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন সমালোচনা; স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে কোন প্রবন্ধ, অথবা কাউন্সিল সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, অথবা কলকাতার বিশপের আচরণ সম্পর্কে কোন আপত্তিকর মন্তব্য ছাপা যাবে না।
২. স্থানীয় অধিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণে হস্তক্ষেপ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এমন কোন আলোচনা প্রকাশ করা যাবে না।
৩. ভারতে ব্রিটিশ শক্তি বা তার মর্যাদার ক্ষতি করে এমন কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না। অন্যত্র থেকেও এমন কোন উদ্ধৃতি নেয়া যাবে না, যা সরকারের জন্য ক্ষতিকর।
৪. সমাজে শালীনতা নষ্ট করে এমন কোন ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি বা মন্তব্য প্রকাশ করা যাবে না।
আগের ৫ দফা বাতিল করে, এই নতুন ৪ দফা প্রণয়ন করা হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি এরপর থেকে পত্রিকাসমূহের উপরে চলতে থাকে সরকারের কড়া নজরদারি।
এ পর্যন্ত যতগুলো পত্রিকার বিবরণ দেয়া হল তা সবই ছিল ইংরেজি ভাষার পত্রিকা। কলকাতায় বসবাসরত ইংরেজরাই ছিল এর গ্রাহক। প্রধানত কলকাতা শহর থেকে এসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। আর সব পত্রিকাই প্রকাশিত হয় হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর অন্ধ অনুকরণে। এসব পত্রিকায় স্থানীয় তথা ভারতবর্ষের মানুষের কোন সংবাদ ছাপা হতো না। এ অঞ্চলের মানুষেরা এসকল পত্রিকা পাঠও করতো না। কিন্তু এই পত্রিকগুলোই পরবর্তীতে এই অঞ্চলে নতুন নতুন সংবাদপত্র প্রকাশের পেছনে উৎসাহদাতা হিসাবে ভূমিকা পালন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৮১৮ সালে অত্র অঞ্চলে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। বাংলা সংবাদপত্র শুরুর ইতিহাসটা আমরা আলাদা ভাবে আলোচনা করব।
সূত্র
১. জুলফিকার হায়দার, বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা, নবযুগ প্রকাশনী
২. বাংলাপিডিয়া
৩. সোলায়মান আহসান, হিকি থেকে বর্তমান কাল (১৭৮০-২০১৫) সংবাদপত্রের বন্ধুর যাত্রার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৪. রাজসাংবাদিক খাজা ইয়াঘমা ইস্পাহানি, দৈনিক ঢাকার ডাক, ০৩-০৩-২০১৮
৫. IH Qureshi, The Administration of the Mughal Empire, University of Karachi, 1966
৬. The Memoirs of William Hickey Vol.II (1775-1782), London: Hurst & Blackett, 1918