দুনিয়া জুড়েই গেরিলা ওয়ারফেয়ার বা গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিঃসন্দেহে অন্য সকল যুদ্ধ থেকে আলাদা। বছরের পর বছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা প্রকৃত অর্থেই পরাজয় বরণ করেছিল। কোল্ড ওয়ারের সময়গুলিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় পুরো বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রেই বিশাল পরিবর্তন এনেছিল। সাথে সাথে ‘তৃতীয় বিশ্বে’ সাম্রাজ্যবাদ এবং শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন একটি ইশতেহারও ছিল এই যুদ্ধ। সেসময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কলাকৌশল এবং আক্রমণের ধরন শুধু অভিনবই ছিল না বরং তৎকালীন সময়ে এটি ছিল দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার দক্ষিণাংশের দেশসমুহের পরিবেশ এবং আবহওয়ার সাথে যথাযথ সামঞ্জ্যপূর্ণ। ফলে খুব দ্রুতই এইসব অঞ্চলের মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধ লড়াইয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ভিয়েত কং বাহিনীর যুদ্ধের সব স্ট্র্যাটেজি। এমনই একটি কৌশল হল ‘ট্যানেল ওয়ার’ বা সুরঙ্গ যুদ্ধ কৌশল। ভিয়েত কং গেরিলাদের হাতে আমেরিকান বাহিনীকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর পেছনে এই কৌশল ছিল সর্বাধিক কার্যকরী। তবে ট্যানেল ওয়ার বোঝার আগে আমরা আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে দেখব।
ভিয়েত কং আসলে কি?
ভিয়েত কং হল উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামিজ মুক্তিকামী গেরিলা দল। পোশাকি নাম ছিল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট। এ ছাড়াও তাদের আরেকটি নাম ছিল পিপলস লিবারেশন আর্মড ফোর্সেস অব সাউথ ভিয়েতনাম বা সংক্ষেপে পিএলএএফ। ভিয়েত কং শব্দের অর্থ ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী।
১৯৪১ সালে ভিয়েতনামের প্রবাদ প্রতিম নেতা হো চে মিন ‘ভিয়েত মিন’ বা ‘ভিয়েতনাম মুক্তি সংঘ’ গঠন করে ঔপনিবেশিক প্রথম ফ্রান্স ও জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। অদ্ভুত রণকৌশল এবং অসামান্য সাহসের জন্য বিজয়ও চলে আসে খুব দ্রুত। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসেই ভিয়েত মিন জেনারেল ভো নওগেন গিয়াপ ও তার যোদ্ধারা ভিয়েতনামের বিভিন্ন শহর দখল নিতে থাকেন, যা ইতিহাসে আগস্ট বিপ্লব নামে পরিচিত। অবশেষে একই বছর ২ সেপ্টেম্বর হো চে মিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ২০ দিনের মাথায় ফ্রান্সের সহায়তায় এই সরকারকে সায়গন সিটি থেকে উৎখাত করা হয়। কিন্তু তখনও ভিয়েত মিনের হাতে উত্তর ভিয়েত নাম বা হ্যানয় অংশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল। ফলে স্পষ্টভাবেই উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ভিয়েতনাম। উত্তর ভিয়েতনামের নেতৃত্বে ছিল স্বাধিনতাকামী গেরিলা বাহিনী। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামে ছিল ফ্রান্সের তাঁবেদার বাও দাই সরকার।
১৯৫০ সালে চীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলি উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন দেয় আর পুঁজিবাদী মার্কিন ব্লকের দেশগুলি সমর্থন দেয় দক্ষিণ ভিয়েতনামকে। ফলে দুই ভিয়েতনামের মধ্যে বিভক্তি রেখা আরো প্রকট হয়ে ওঠে, পাশাপাশি চলতে থাকে ঐক্যপন্থিদের লড়াই। এর কিছুদিন পরে বাও দাইকে সরিয়ে আমেরিকা গো দিন দিয়েম নামের প্রচন্ড কমিউনিস্ট বিদ্বেষীকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের শাসন ক্ষমতায় বসায়। পরিস্থিতি দিনকে দিন আরো খারাপ হতে থাকে। শেষমেষ ১৯৫৪ সালে মার্কিন মদদপুষ্ঠ দিয়েম সরকার জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে। এবং দুই ভিয়েতনামের ঐক্যপন্থি সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার শুরু করে। ফলে উত্তর ভিয়েতনামিজদের কাছে আবারো লড়াই যেন নিয়তি হয়ে ওঠে।
১৯৫৯ সালে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি ঐক্যবিরোধী মার্কিন মদদপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ঘোষণা দেয়। ১৯৬০ সাল নাগাদ উত্তর ভিয়েতনামিজ কমিউনিস্ট সৈনিকদের পাশাপাশি সাধারণ কৃষক যারা দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে এসেছিল তারাও যোগ দেন এই লড়াইয়ে। দ্রুতই তৈরি হয় লড়াইয়ের এক নতুন মঞ্চ। যার নাম দেন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএলএফ। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এই জোট আস্তে আস্তে ভারি হতে থাকে। যোগ দেয় ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব সাউদার্ন ভিয়েতনাম, প্রভিসিওনাল রেভলুশনারি গভর্নমেন্ট অফ দি রিপাবলিক অফ সাউদার্ন ভিয়েতনাম, এলায়েন্স অব ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এন্ড পিস ফোর্সসহ আরো অনেক ঐক্যপন্থি সংগঠন। এসব সংগঠনের অধিকাংশই দক্ষিণ ভিয়েতনামের অত্যাচারের ফলে পালিয়ে চলে আসা সাধারণ কৃষক। মুলত এইসব গেরিলাদেরই দক্ষিণ ভিয়েতনামের মার্কিনপন্থি মিডিয়া ব্যাঙ্গ করে নাম দেয় ‘ভিয়েত গিয়ান কং’ বা ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসঘাতক। পরে সংক্ষেপে তারা ভিয়েত কং নামেই পরিচিত হতে থাকে। এবং বলাই বাহুল্য নিজেদের সমাজতান্ত্রিক বলে পরিচয় দিতে গেরিলারা লজ্জা নয় গর্ব অনুভব করত।
যাইহোক, মার্কিন সরকার অবশ্য ভিয়েতনামের এই বিশৃঙ্খলার সুযোগেই ছিল। ফলে লড়াই শুরু হবার পরই ১৯৬১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্য প্রেরণের কথা জানান। এবং এর কিছুদিন পর সেখানে নেভাল কোরের সেনারা চলেও আসে। দেখা গেছে, ১৯৬২ সালের মাঝমাঝিতে এই সংখ্যাটা প্রায় ১২ হাজারে পৌছে যায়।
প্রাথমিক ভাবে মার্কিন সৈন্যদের সামনে ভিয়েত কং গেরিলারা সুবিধা করতে না পারলেও অদ্ভুত অথচ কার্যকরী গেরিলা কলাকৌশলে অচিরেই তারা মার্কিন সেনাদের তটস্থ করে ফেলে। এবং সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ এমন অনেক স্থান তারা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
ভিয়েত কং গেরিলা এবং টানেল যুদ্ধ
যুদ্ধ বিদ্যার ইতিহাসে টানেল কৌশল প্রথমত বিস্ময়করই নয় বরং যুদ্ধ বিদ্যার ইতিহাসে সর্বাধিক কার্যকরী এবং জনপ্রিয় কৌশলগুলির মধ্যে একটা। টানেল যুদ্ধ আসলে কি? মাটির নিচে টানেল খুঁড়ে সেই টানেলের ভেতর থেকে শত্রুর মোকাবেলা করা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ অন্য অনেক যুদ্ধের চাইতে আলাদা এই কারণে যে, এই যুদ্ধ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল সাধারণ কৃষক, কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়। তারা খুব অল্প খাবার আর যেকোন প্রতিকূল আবহওয়ায় দিনের পর দিন শত্রুর মোকাবেলা করতে পারত। কিন্তু আমেরিকান বাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় এই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। আমেরিকার ভারি অস্ত্রের আর নিয়মত বোমা বর্ষণের সামনে ভিয়েত কং এর কৃষক বাহিনীর টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। ফলে দ্রুতই তারা টানেলের অভ্যন্তরে থেকে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত হতে থাকে।
এসব টানেল ছিল কোনটা ২৫ থেকে ২৬ মিটার, কোন টা ১০০ মিটার আবার কোন কোনটা মাইলের পর মাইল প্রশস্ত। চওড়া ছিল দুই ফিট থেকে আড়াই ফিট। কোন কোন ক্ষেত্রে দুইজন মানুষ একসাথে হামাগুড়ি দিয়ে চলাচল করার মত। এই সব টানেল দিয়ে দ্রত গতিতে চলাচল করত ভিয়েতনামিজ গেরিলারা। প্রচন্ড অন্ধকারেও তারা চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র হিসাবে তাদের সাথে থাকত ছোট্ট নল কাটা পিস্তল, সালফিউরিক বোমা।
সব থেকে মজার দিক হল, শুধু যুদ্ধকালীন সময়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য নয় ভিয়েত কং গেরিলাদের মিটিং রুম পার্টি অফিস বিশ্রামাগার থেকে শুরু করে হাসপাতাল পর্যন্ত ছিল এইসব টানেলের ভেতরে। মোট কথা মাটির নিচেই একটি ভিন্ন শহর গড়ে তুলেছিল এই গেরিলারা। যেহেতু এসব গেরিলাদের বেশিরভাগ ছিল সাধারণ কৃষক সেহেতু এইসব কৃষকদের ভূমির সাথে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া প্রথমে ফরাসি ঔপনিবেশিক থেকে মুক্তির জন্য এবং পরে জাপানি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাবার ফলে তাদের নির্ভরযোগ্য একটি আত্মরক্ষা ব্যবস্থার দরকার ছিল যেখান থেকে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। মূলত এই প্রয়োজন থেকে তারা মাটির নিচের এই প্রশাসন ঘড়ে তোলে। তাই নিয়মিত যুদ্ধের পরে তারা টানেলের ভেতরে চলে যেত ফলে আমেরিকান বাহিনী তাদের কানাটিও খুঁজে পেত না। এমন হয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে, যেখানে আমেরিকান সৈন্যদের বিজয় প্রায় সুনিশ্চিত, দেখা যেত হটাৎ ভূমি ফুঁড়ে, সেখানে শত্রু ঘাঁটির সবচেয়ে নিরাপদ স্থান দিয়ে উঠে এসে আমেরিকাদের পেছন থেকে আক্রমণ করে মূহুর্তের মধ্যেই তছনছ করে দিত সব আনন্দ।
ফলে দিন দিন ভিয়েত কং গেরিলাদের এই প্রতিরোধ মার্কিনিদের আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে এই গেরিলাদের প্রতিরোধে মার্কিন বাহিনীরও একটি কাউন্টার গেরিলা জরুরত হয়ে পড়ে। ফলে এইসব টানেল ধ্বংস করার জন্য তারা টানেল র্যাট নামে এক নতুন বাহিনীর আবির্ভাব ঘটায়।
ট্যানেল র্যাট
আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন এই বাহিনীতে বেশিরভাগ সৈন্য সংখ্যা ছিল আমেরিকান। তবে এর বাহিরে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের সেনাসদস্যও ছিল বেশকিছু। টানেল র্যাটদের মুল কাজ ছিল ভিয়েত কং গেরিলাদের ট্যানেলগুলি খুঁজে বের করা এবং সেগুলো ধ্বংস করে দেয়া। এই কাজের জন্য টানেল র্যাটদের সরবরহ করা হতো একটি করে ৪৫ ক্যালিবার পিস্তল একটি টর্চ এবং একটি বেয়নেট সদৃশ ছুরি। এইসব মার্কিন সৈন্যরা বিভিন্ন ট্যানেলে প্রবেশ করে সেইসব ট্যানেল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আনতো যাতে তা ধ্বংস করতে সুবিধা হয়।
টানেল র্যাটদের নিয়ে সেলুলয়েডে অনেক চমৎকার সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত সিনেমা ফরেস্ট গ্যাম্পে টম হ্যাংস যে গ্যারি সিনিসের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে একজন টানেল র্যাট ছিলেন।
এসব টানেল র্যাটদের আরো একটি কাজ করতে হতো, তা হলো বুবি ট্র্যাপ খুজে বের করা। বুবি ট্র্যাপ হল জমিতে গর্ত করে নিচে সুঁচালো কিছু পুতে রেখে উপর থেকে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া। যাতে সেখান থেকে কেউ হেটে গেলেই নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে পড়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গেরিলাদের এইসব বুবি ট্র্যাপ ছিল আরেক ভয়ানক অস্ত্র। টানেল র্যাটরা মূলত এগুলো খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করতো।
কাঠামোগতভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল গত শতাব্দীর অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চীনের মহান নেতা মাও জে দঙয়ের কৌশলকে আরও বিকশিত করে গেরিলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে বিজয় অর্জন করে উদাহরণ স্থাপন করেছিল তা পরে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানেই চর্চা হতে থাকে। এই কৌশলের খুব কাছাকাছি একটি চর্চা হয়েছিল বাংলাদেশে কমরেড সিরাজ সিকদারের হাত ধরে। সে গল্পটি নাহয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।