টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি : বাস্তবতা, শঙ্কা এবং করণীয়

টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি : বাস্তবতা, শঙ্কা এবং করণীয়

টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে একধাপ এগিয়ে নিজেদের ইতিহাসের সেরা অবস্থানে বাংলাদেশ। বিশ্ব ক্রিকেটের এক সময়ের পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেছনে ফেলে এ অবস্থানে এসেছে টাইগাররা। অর্জনটা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।

এটাকে ঠিক অর্জন বলা যায় কিনা সেটি নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। এখন যেটি আমরা দেখতে চাই সেটি হল নয় থেকে আটে উঠে আসার পথ পরিক্রমা, সামনের পথের শঙ্কা এবং করণীয় বিষয়গুলোর দিকে।

বাস্তবতা

নিকট অতীতে বাংলাদেশের টেস্টে যেটুকু সাফল্য তার সিংহভাগই এসেছে দেশের মাটিতে। ঘরের বাইরে বাংলাদেশ সাফল্য বলতে শ্রীলঙ্কার সাথে সিরিজ ড্র। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০০রও বেশি রান করেও ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে কথা না বলাই বেহতার। ঘরের মাঠে যা সাফল্য সেটি স্পিনে দুর্বল উপমহাদেশের বাইরের দেশগুলোর বিপক্ষে। একই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার সাথে হালত কি হয়েছিল সেটি তো সবাই দেখেছে। সুতরাং, আত্মশ্লাঘায় ভোগার সুযোগটা সেই অর্থে কম।

আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় হল, সাফল্য যা এসেছে তাতে ব্যাটসম্যানদের ভূমিকা বেশি। তামিম-মুশফিক-সাকিব-রিয়াদরা ইতোমধ্যেই নিজেদের বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে তুলনায় টেস্টে বলার মত এখনো কোন বোলার বাংলাদেশের নেই। যে কথাটা আফ্রিকা সিরিজে বেশ স্পষ্টভাবেই মুশফিক বলেছিলেন। মিরাজের চমক দেখানো বোলিং বা মোস্তাফিজের সাফল্য কিন্তু ঘরের মাঠেই। সুবিধাজনক পিচ না পেলেই নির্বিষ হয়ে যায় বাংলাদেশের বোলিং। এখনো টেস্টে ভরসা করার মতন তিনজন পেসারও নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যেকোনো দলই বাংলাদেশের বিপক্ষে অনায়াসে চারশো থেকে সাড়ে চারশো প্লাস স্কোর করছে। ব্যাটসম্যানদের সাফল্যের কারণে অনেক সময় যেটি চোখে পড়ছে না। শুধু যদি লঙ্কা সিরিজের কথাই ধরি, মুমিনুল-মুশফিকদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পরেও বাংলাদেশকে রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে টেস্ট ড্র করার জন্য। বোর্ডে পাঁচশোর মতো স্কোর থাকার পরেও এটি অস্বাভাবিক।

আফ্রিকা সিরিজে উপমহাদেশের দলগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাস নতুন না। কিন্তু এটি বলেও বাংলাদেশ নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে পারবে না, কারণ আফ্রিকান কন্ডিশন বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয় সেটিরই মুখোমুখিই হতে হয়নি বাংলাদেশের। নিরেট ফ্ল্যাট উইকেটে যেভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল গোটা দল সেটি ছিল বিস্ময়কর। যেকোনো বিষয় বড় করে দেখানো আমাদের স্বহজাত স্বভাব। এখন এ র‌্যাঙ্কিংয়ের বিষয়টিকেও যদি সেভাবে দেখে আত্মশ্লাঘায় ভোগা হয়, বিষয়টি আখেরে বিপদজনকই হবে।

শঙ্কা

দেশের বাইরে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কথা আগেই বলা হয়েছে। দেশেও যদি দেখা যায়, সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে তামিম-সাকিব-মুশফিকদের সাফল্যের ওপর। সিনিয়ররা কেউ ব্যর্থ হলেই খাবি খেতে দেখা যায় গোটা দলকে। বোলিংয়ে এখনো সাকিব ছাড়া ভরসা করার মত একজনও নেই। টেস্টে জিততে হলে আপনাকে প্রতিপক্ষের বিশটি উইকেট নিতেই হবে। বিশটি তো দূর, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিপক্ষ ইনিংস ঘোষণা করছে। টেস্টের জন্য উপযুক্ত বোলিং ইউনিট তৈরি করা না গেলে এ সুসময় যে ক্ষণস্থায়ী হবে তা নিশ্চিত। একই সাথে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশ এখনো টেস্টের জন্য উপযোগী পেসার তৈরির ক্ষেত্রে উদাসীন। যার ফলে বাইরের দেশে গিয়ে ফায়দাটা সে অর্থে কখনোই নেয়া যায় না। এদিকটায় নজর দেয়া অত্যাবশ্যক। অার ব্যাটিং যে বিষয়টি, তামিম-মুমিনুল-মুশফিক বা সাকিকদের কেউ ব্যর্থ হলে দায়িত্ব নেয়ার তাগিদ কারো মধ্যেই দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বহুটা সময় কাটিয়ে দিলেও এখনো চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ইমরুল। সৌম্য-সাব্বিরের অাদৌ ভুল থেকে শেখার কোনো আগ্রহ আছে কিনা সেটি নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

হালত খারাপ ফিল্ডিংয়েরও। ম্যাচ প্রতি ক্যাচ ড্রপে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষের দিকে। এখনো নেই বিশেষজ্ঞ স্লিপ ফিল্ডার। অথচ, ক্রিকেটে ফিল্ডিং একটি গুরুত্বপূর্ণই শুধু না ম্যাচ জয়ের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। অথচ, এই দিকটায় আশ্চর্য রকমের উদাসীন বাংলাদেশ দল।

করণীয়

তামিম-সাকিব-মুশফিকরা আজকে যে জায়গায় গিয়েছেন সেটি নিজেদের তাগিদেই, নিজেদের প্রচেষ্টাতেই। বাকিরা কেন সেটি পারছেন, বিশেষ করে বোলাররা সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বোর্ডের। কোর্টনি ওয়ালশের মত বোলার বোলিং কোচ হবার পরেও পেসাররা কেন ব্যর্থ বিশ্লেষণ করা উচিত সেটি নিয়েও। এখন যদি বাংলাদেশ ম্যাচ জয়ের জন্য খেলতে চায়, তাকাতে হবে টিম কম্বিনেশনের দিকেও। বহুদিন ধরেই আট ব্যাটসম্যান তিন বোলার নিয়ে খেলছে বাংলাদেশ দল। এমন কম্বিনেশন ড্র করার মতন হলেও জিতে আসার জন্য যথেষ্ট না। সাকিবকে যেখানে বাড়তি অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো যায়, সেখানে তাকেই পালন করতে হচ্ছে মূল বোলারের ভূমিকা। বিশ্ব ক্রিকেটে সমীহা জাগানিয়া শক্তিতে পরিণত হতে হলে দেশের সাথে দেশের বাইরেও সমান তালে পারফর্ম করতে হবে। আর সেটি করতে গেলে ঘরের মাঠে ভাঙ্গা পিচের বদলে স্পোর্টিং উইকেট আবশ্যক। নতুবা বাইরে গিয়ে ফ্ল্যাট উইকেটেও খাবি খাওয়া লাগবে। যেমনটা হয়েছে আফ্রিকায়। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, জাতি হিসাবে যেকোনো বিষয়ই রঙ্গচঙ্গ মাখিয়ে জাহির করার বদলে বাস্তবতা অনুধাবন করা। এটি সাফল্যের একটি ধাপ। কিন্তু এটিকে নিয়ে মাততে গিয়ে যেন পথ ভুল না হয় সেদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে বোর্ডেরই।

বোর্ড বিগত দিনগুলোতে যে কাজ করছে তার একটি সফলতা এটি। এখন দেখার বিষয় যে, এই সাফল্যে আত্নশ্লাঘায় ভুগে দল পথ হারায় নাকি আরো সাফল্যের জন্য বুভুক্ষ হয়ে ওঠে। এবং বোর্ড ঠিক কি করে সামনে দিনগুলোতে সাফল্য ধরের রাখার জন্য।