‘মানুষ’ কে? নাক-কান, চোখ-মুখ, হাত-পায়ের সমন্বয়ে যাকে আমরা ‘মানুষ’ বলি সেটি তো মূলত দেহ। তাহলে মানুষটা কই? বহু বিজ্ঞজন বহুভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমি যা বুঝি তা হলো মানুষ সেই যার ‘মন’ আছে। যার ভেতর মনুষত্ব্য আছে, আছে আবেগ, রাগ, ক্ষোভ, স্বাধীনতা পাবার আকাঙ্খা; আমার চোখে সেই মানুষ।
‘দাস’ কে? মানুষের অবয়বয়েই সৃষ্টি হলেও যে আরেকজনের ইচ্ছার অধীন। যার স্বাধীনতা নাই। নাই নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। দাসবৃত্তি ‘সভ্যতা’ নামক সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। দাসত্ব এক ধরণের অভিশাপ। মানুষ নামধারী মনুষত্ব্যহীন কিছু অবয়ব যুগে যুগে মানুষকে বাধ্য করেছে দাসত্ব্য গ্রহণ করতে। আদি থেকে অদ্যাবধি স্বেচ্ছায় কেউ দাসত্ব গ্রহণ করেছেনে এমন ঘটনা বিরল। অথচ ইদানিং আমরা সেটিই দেখতে পাচ্ছি।
খেলার পাতায় মানুষ এবং দাসের উপস্থিতি অবাক করার জন্য যথেষ্ট। কেন আচমকা এই বিষয়ে অবতারনা করা হল, সেটি ব্যাখ্যার আগে একটু ঢু মারব ‘ক্লাব’ এর অন্দরে। যা মানুষেরই সৃষ্টি। এরপরে যাব ‘ফ্রাঞ্চাইজি’তে যেটিও মানুষেরই সৃষ্টি, তবে সেটি অপ-সৃষ্টি।
উপমহাদেশেরই অনত্যম প্রাচীন ক্লাব ওয়ারী ক্লাব। ১৮৯৮ সালে বিলুপ্ত ওয়েলিংটন ক্লাবে কিছু সদস্যের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটি। ওয়ারী ক্লাব প্রতিষ্ঠার পিছনে রায় বাহাদুর সুরেন্দ্রনাথ রায়ে ভূমিকা অসামান্য। তাই তাকেই ওয়ারী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। ১৯১০ সালে ওয়ারী ক্লাব ব্রিটিশ রাজকীয় প্রাসাদ দলকে হারিয়ে চমকে দেয় সবাইকে। যা পরবর্তী ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট সবার মনেই বিশেষ অনুপ্রেরণা যোগায়। এ সাফল্যের সুবাদে ওয়ারী সুযোগ পায় কোলকাতা ফুটবল ক্লাব এবং ডালহৌসি অ্যাথলেটিক্স এর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলার। আর সে সেব ম্যাচের সাফল্যে অণুপ্রানিত হয়ে ১৯৪৫ পর্যন্ত নিয়মিত আইএফএ শিল্ডে অংশ নেয়। ১৯১৭ সালে শিল্ডের তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন লিংকোলিন ক্লাবকে হারিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ক্লাবটি এবং উপমহাদেশের ফুটবল বোদ্ধাদের আলাদা করে নজর কাড়তে সক্ষম হয়। ১৯৩৭ সালে উপমহাদেশ সফররত বিখ্যাত ক্লাব ইস্টিংটন কোরিনথিয়ানকে মাটিতে নামিয়ে আনা ঢাকা একাদশের দশজন সদস্যই ছিল এই ওয়ারী ক্লাবের। বাংলাদেশে ফুটবলে প্রচার, প্রসার এবং জনপ্রিয়তা এনে দেয়ার ক্ষেত্রে এ ক্লাবটির অবদান অসামান্য।
বৃটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে যখন মুসলিমরা সবদিকেই কোণঠাসা; শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, ক্রীড়ায়, তখনই আবির্ভূত হয় মোহামেডান ক্লাব। মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দ্যেশ্য। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবটি মূলত কোলকাতা মোহামেডানের একটি অংশ। ১৯২৭ সালে কোলকাতা মোহামেডানের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য বিখ্যাত খাজা পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকা মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে ঢাকা মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবই পরিণত হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। সেটি ১৯৩৭ সালের ঘটনা। যদিও স্পষ্ট দিন তারিখ সম্পর্কে জানা যায় না। তবে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, মুসলিমরা এই ক্লাবটিকে নিজেদের ক্লাব মনে করত; এবং মুসলিম সমাজে এর বেশ প্রভাব ছিল।
আরো একটি প্রাচীন ক্লাব ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। ব্রিটিশ শাসনামলে রাণী ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে এ ক্লাবটির নামকরণ করা হয়। বাবু সুরেশ চন্দ্র ধাম, বাবু নৃপেন রায় চৌধুরী, রায় বাহাদুর কেশব চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, দীনেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং বাবু সুনীল কুমার ঘোষের প্রচেষ্টায় জন্ম নেয় এ ক্লাবটি। পাকিস্তানের জন্মের পর আরো অনেক ক্লাবের মতো ভিক্টোরিয়াও মুখোমুখি হয় অস্তিত্ব সংকটের। কিন্তু বাবু সুরেষ চন্দ্র ধামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং শাহাদাত আলী ভূইঞা, ননী গোপাল বসাক, ফরিদ আহমেদ, শামসুদ্দিন চাকলাদার এবং আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় আবার প্রাণ ফিরে পায় ক্লাবটি। ১৯৭৩ সালে ভিক্টোরিয়া ক্লাব দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফুটবল উৎসাহীদের খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটিই ছিল এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ।
চাইলে আবাহনী, ব্রাদার্স, ওয়ান্ডারার্সসহ আরো বেশ কিছু ক্লাবের কথা বলা যেত, বাহুল্য বৃদ্ধির শংকায় সে পথে এগুলাম না। মানুষ থেকে ক্লাব, ক্লাব থেকে ইতিহাসের পথে কেন এগুলাম এবার সেটি ব্যাখ্যা করব। তার আগে আরেকটি আবিষ্কারের সাথে; সঠিক শব্দ ব্যবহার করলে অপ-আবিষ্কারের নাম উল্লেখ করেই সে পথে এগুই। ফ্রাঞ্জাইজি! এখন ক্রিকেটের বহুল পরিচিত এক নাম। যার হাত ধরে পচন ধরেছে ক্রিকেটের প্রাচীন বৃক্ষের।
ক্নাবগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পটভূমিতে গড়ে উঠেছিল আলাদা আলাদা সময়ে। সময়ের দাবি মেনে ভূমিকা রেখেছে ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোর জন্ম ফুটবলের হাত ধরে হলেও সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের তারা যুক্ত করেছে ক্রিকেটের সাথে। আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটি যে একটি শক্ত জামিন এর উপর দাড়ায়ে আছে এর পিছনের মূল কৃতিত্ব এই ক্লাবগুলোরই।
আপনি এখনো আবাহনী, মোহামেডান বা যে কোন ক্লাব প্রাঙ্গনে যান, দেখবেন কিশোরেরা নিজেদের ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত। ব্যস্ত তাদের গুরু। ক্রিকেটটা একটি গুরুমুখী বিদ্যা। অার এই গুরুরাই নিরলস, নিঃস্বার্থভাবে শ্রম বিনিয়োগ করছেন উঠতি এই তরুণদের ওপর। জলিসুর রহিমের গল্প শুনিয়েছিলাম একবার। যিনি নিজের যৌবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ক্রিকেটার তুলে আনতে গিয়ে। এমন অনেক জলিসুর রহিমদের দেখা মিলবে বিভিন্ন ক্লাবের প্রাঙ্গনে।
শুরুতে যে মানুষ শব্দটার জিকির করেছিলাম, সেটির দিকে এবার একটু তাকান। মানুষ মাত্রই তো আবেগ, ভালোবাসা, রাগ, ক্ষোভ। মানুষের মাঝে এই মানবিক পতিক্রিয়াগুলো কাজ করবেই। তাই ক্লাবগুলোর সাথে জড়িত এ মানুষগুলো দিনের পর দিন নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেন। বিনিময়ে যে পারিশ্রমিকটি তারা পান; সেটি বলবার মত কিছু না। বাংলাদেশে ক্রিকেটের জন্মলগ্নের অন্যতম সারথী দীপু রায় চৌধুরী কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, যে তারা ক্রিকেটটা খেলেছেন উপার্জনের জন্য না, বরং ভালোবেসে। তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়েছেন অাবাহনীর জার্সি গায়ে।
এমন অসংখ্য উদাহারণ রয়েছে। যারা শুধু ক্লাবকে ভালোবেসে পারিশ্রমিকের কথা না ভেবে একই তাবুর নিচে কাটিয়ে দিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময়। সূচনায় স্বাভাবিক সম্পর্কটি এক সময় হয়ে যেত আত্মার। যার প্রভাব সমর্থকদের ওপরও পড়ত। যার ফলে ঢাকার মাঠেই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ছিল যুদ্ধের ন্যায়।
তখন খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা ছিল নিজের মত দল বাছাই করার। কোনো দলেই থেকে যাওয়ার। বা কখনো মান-অভিমান ঘটলে ক্লাব বদলানোর। স্বাধীনতা ছিল নিজের পারিশ্রমক নিয়ে দরদাম করার, ন্যায্য মূল্য পাবার। মোদ্দাকথা, একজন সাধারণ মানুষ যে অধিকার ভোগ করে তার সব সুযোগই ছিল। অপ্রীতিকর কিছুই যে ঘটেনি তা না, কিন্তু সেটি ছিল বিচ্ছিন্ন।
বর্তমান এই ফ্রাঞ্জাইজির আগেই কিন্তু এর সৎ ভাইয়ের দেখা মিলেছিল ক্রিকেটাঙ্গনে। ‘কোটা’ প্রথা নামক সে প্রথা দিয়েই যাত্রা শুরু মনুষত্ব্য বিসর্জনের। খর্ব হল খেলোয়াড়দের দল বাছাইয়ের স্বাধীনতা। ভারসাম্য আনার নামে ভানুমতির যে চাল চালানো হল তাকেই আজকের আধুনিক ‘ফ্রাঞ্জাইজির’ জনক বলা যায়। যদিও তখনো কিছুটা মনুষত্ব্য বিদ্যমান ছিল। ভরা ময়দানে তুলে অন্তত খেলোয়াড়দের কেনা বেচা করা হয়নি। সে ধারা কিন্তু এখনো বহমান। প্লেয়ার্স বাই চয়েজ নামের যে কিম্ভুৎ পদ্ধতিটা চালু রয়েছে, তাতে কোনো খেলোয়াড়েরই স্বাধীনতা থাকছে না পছন্দসই ক্লাব বাছার। যার ফলে আবেগটা মারা যাচ্ছে শুরুতেই। নেহায়েতই যেন টাকার জন্য খেলা।
যদি বলা হয় এই কোটার রাওয়াইয়্যাত ধরেই ফ্রাঞ্চাইজির জন্ম, বোধয় খুব একটা ভুল বলা হবে না। পার্থক্য এইটুকুই যে, খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা খর্ব হলেও এখনো তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় তুলে আনা থেকে শুরু করে পরিচর্যার কাজটা ক্লাবই করে থাকে।
এখন দেখা যাক দাসত্বের জনমদাতা ফ্রাঞ্চাইজির ভূমিকা। আপনি শুধু বিপিএলকেই বিবেচনায় নেন। যে কয়টি দল মাসব্যাপি এ প্রতিযোগিতায় জি-জান লাগিয়ে ক্রিকেট প্রেমে গদগদ হয়ে থাকে, প্রতিযোগিতাটি শেষে তারা ক্রিকেট নিয়ে কতটুকু কাজ করে? বিপিএলে ঢাকা একাধিকবার শিরোপা জিতেছে। তারা শুধু একজন খেলোয়াড়ের নাম বলুক তো, যাকে তারা নিজেরাই আবিষ্কার করেছে, পরিচর্যা করেছে। একজনও পাবেন না।
এখানে আবার ফি বছর কোচ বদল হয়। যার ফলে কোচ-খেলোয়াড়ের যে সম্পর্ক সেটি বলতে গেলে কখনোই গড়ে ওঠে না। মাত্র একমাসের একসাথে থাকা, তাতে কতটুকুই বা গভীর হয় সম্পর্ক? অথচ, আয়োজনের বাহার দেখলে মনে হয় ক্রিকেটের পুরো উন্নতিই যেন এর ওপর নির্ভর করছে।
দাস প্রথার কথা এসেছিল শুরুতে। অনেকেই আপত্তি তুলবেন শব্দটা নিয়ে, কিন্তু এর চেয়ে সভ্য কোন শব্দটা আপনার কাছে মানানসই বলে মনে হয়? একজন ক্রিকেটারে দল বাছাই করার অধিকার নেই, পারিশ্রমিক নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই, দল বদলানোর অধিকার নেই! এটাকে ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের পর্যায়ে ফেলবেন? তার চেয়েও বিস্ময়কর হাটে তুলে দরদাম করা ক্রিকেটারে কেনা বেচা। টাকার প্রয়োজন আবশ্যক, সত্য। কিন্তু এতটাই? প্রাচীন দাসরা নিরুপায় হয়ে বিক্রি হতো। আধুনিক এই দাসরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে।
আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে মূল্য প্রকাশ করা হয়, তা খেলোয়াড়রা পায়? একটু তলিয়ে দেখুন, যে নগ্ন সত্যটা বের হয়ে আসবে তাতে হতবাক হবেন। মাঝে লাভ হচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজির মালিকদের। টাকার কুমিরেরা গিলে নিচ্ছে ক্রিকেট খেলাটাকেই।
আবেগ যখন মরে যায়, তখন সত্তার মৃত্যুও আবশ্যক। এই নিরাবেগ ক্রিকেট কিছুকাল হয়ত মাতিয়ে রাখবে বহুজনকে, কিন্তু আখেরে পরিণতিটা হবে করুণ। ইতোমধ্যেই পচন ধরেছে ক্রিকেট বৃক্ষে। করুণ এ আর্তনাদ তারাই শুনছেন যারা ভালোবেসে খেলাটা খেলেছিলেন, ভালোবেসে তারা ঠিকই শুনছেন এই আর্তনাদ।
আর, বাকিদের কথা বাদ দি, বিসিবির কাছে আবেদন এই প্লেয়ার্স বাই চয়েজ নামক অদ্ভুত প্রথাটা তুলে খেলোয়ড়দের মানুষ হিসাবে প্রাপ্য অধিকারটুকু ভোগ করার সুযোগ দিন। এমনিতেই বিপিএলের খড়্গ রয়েছে, তার ওপর যদি এটিও বহাল থাকে এক সময় বাংলাদেশেরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ হতে বেশিদিন লাগবে না, যখন খেলোয়াড়রা জাতীয় দলের বদলে দাসত্বকেই বেছে নেবেন স্বেচ্ছায়। মানুষ হিসাবে আবেগের গলা টিপে মারার ফলে কেউ যদি নিরাবেগভাবে দেশের বদলে দাসত্ব বেছে নেয় তখন তাকে দায় দেয়ার কোনো উপায় থাকবে না।