অনুচ্চ স্বরে বলা কথাটাই দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। মেসি-রোনালদো না, এই মুহুর্তে বিশ্বসেরা ফুটবলার মিশরীয় ফারাও মোহাম্মদ সালাহই। এটা ঠিক যে, মাত্র এক মৌসুমের সাফল্যে মেসি-রোনালদোর সাথে তুলনাটা একটু বেখাপ্পা। কিন্তু সালাহ যা করেছেন, যা করে চলেছেন তাতে মনের মাঝে পুষে রাখা কথাটাই প্রকাশ্যে বলছেন ফুটবল জগতের অনেক কিংবদন্তি।
মেসি-রোনালদো উত্তর ফুটবল বিশ্ব রাজ করবে কে তা নিয়ে বহু কথাই হয়েছে। সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে ব্রাজিলীয়ান তারকা নেইমারের নাম। মাত্র মাস তিনেক আগেও সালাহর নামটি স্বপ্নেও ভাবেননি কেউ। চেলসিতে ফ্লপ সালাহ রোমার হয়েও এমন কিছু করেননি যা মেসি-রোনালদোর রাজত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। বরং যে দামে তাকে ক্লপ কিনেছিলেন সেটি যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল।
এবারই প্রথম না, যে মেসি-রোনালদোর বাইরেও কারো নাম ব্যালন জয়ের জন্য আলোচিত হচ্ছে। এর আগে রবেন, স্নাইডার, ইনিয়েস্তা, নয়ার, নেইমারদের নামেও বেশ শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু এবারের মত কখনোই নয়। এ দিকটাকেই বরং চোখ দেয়া যাক তাহলে।
প্রথমত, মেসি-রোনালদোর পাশে এর আগে যাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ছিলো ইউরোপিয়ান কোনো পরাশক্তির সদস্য। যেমন রবেন এর নাম যেবার উঠে আসলো সেবার তার দল জিতেছিল ট্রেবল। নয়ার ছিলেন বিশ্বজয়ী জার্মান দলের সদস্য। ইনিয়েস্তা প্রতিনিধিত্ব করেছেন বার্সা-স্পেনের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলের। সেখানে সালাহর লিভারপুল ইউরোপের এলিট পরিবারের সদস্য হলেও কৌলিন্য হারিয়েছে বেশ আগেই। বিগত কয়েক বছর তো চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই জায়গা করে নিতে পারেনি।
এ মৌসুমের শুরুটাও ছিলো সাদামাটা। বরং মৌসুমের মাঝপথে দলের মূল তারকা কৌতিনহো বার্সা শিবিরে তাবু গাড়লে বিষম খাবার জোগার হয়েছিল রেডস সমর্থকদের। আর সেখান থেকেই শুরু সালাহ ম্যাজিকের। কৌতিনহোর অভাব তো বুঝতেই দেননি, বরং মানে এবং ফিরমিনহোকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ট্রায়ো। বিবিসি বা এমএসএন এর মত গালভরা নাম জুটেনি এ ট্রায়োর। কিন্তু কার্যকরিতায় যে তারা কোনো অংশেই ‘তারকা’ তাকমাধারীদের চেয়ে কম নন সেটির প্রমাণ দেখা যাচ্ছে নিত্যই। মৌসুমজুড়ে দুর্দান্ত খেলা সিটির গোল্ডেন লিগ এর স্বপ্ন নৎসাত দিয়ে শুরু, এরপরের গল্পটা শুধুুই এগিয়ে চলার।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিভারপুলের বিপক্ষে নিরুঙ্কুশ ফেভারিট হিসাবে শুরু করা সিটিকে যেভাবে চপোটাঘাত করেছেন সালাহ এন্ড কোং সেটি ছিল দেখার মতো। এটি এক দিক দিয়ে বিশুদ্ধ ফুটবল প্রেমীদের জন্যও ছিল আনন্দদায়ক। বিলিয়ন ডলারের সিটিকে তার অর্ধেক মূল্যের লিভারপুল যেভাবে মাটিতে নামিয়ে এনেছে সেটি ছিলো অসাধারণ। সেমিতে প্রতিপক্ষ হিসাবে জুটল বার্সাকে হারিয়ে রুপকথার জন্ম দেয়া রোমা। সেই রোমান গ্লাডিয়েটরদেরও রেহাই দিলেন না সালাহ। অসাধারণ দুটি গোলের সাথে অ্যাসিস্ট করে প্রথম লেগেই প্রায় নিশ্চিত করে ফেললেন বহুবছর পর রেডসদের ফাইনাল যাত্রা। সেমির ড্র এর ডেইলি মেইলের জরিপে ৪০ শতাংশ মানুষ লিভারপুলকে ঘোষণা করেছিল সাম্ভাব্য শিরোপাধারী হিসাবে। সালাহ ম্যাজিকের পর সে সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে।
ইতোমধ্যেই জিতেছেন পিএফএর বর্ষসেরার খেতাব। হুমকির মুখে রেখেছেন লিভারপুলের হয়ে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল করা ইয়ান রাশের রেকর্ডকে। গোল সংখ্যায় ইতোমধ্যেই পেছনে ফেলেছেন রোনালদো-মেসিকে। অথচ, সালাহ স্ট্রাইকার নন। নিখাদ উইঙ্গার। এ পজিশন থেকে মৌসুমে ৪০ এরও বেশি গোল শুধু বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। লিভারপুল সালাহ ওপর কতটা নির্ভরশীল তা রোমার ম্যাচেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিনি মাঠ থেকে উঠে যাবার পরই দুটি গোল হজম করেছে লিভারপুল।
রিয়াল-বার্সার সাথে এই মুহুর্তে কাগজে কলমে কোনে অংশেই তুল্য না লিভারপুল। বার্সায় মেসির সাথে সুয়ারেজ, ডেম্বেলে, ইনিয়েস্তারা রয়েছেন। রিয়ালে রোনালদোর সাথে মদ্রিচ, ক্রুস, ইস্কোদের মত খেলোয়াড়। বার্সা তো এই দল নিয়েও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ছিটকে গিয়েছে কোয়ার্টারেই। রিয়াল সেমিতে খেললেও খেলার ধরণ মন ভরানোর মতন না। সেখানে সাদা মাটা একটি দলকেই টেনে নিয়ে চলেছেন সালাহ। নিজে খেলছেন, সতীর্থদের খেলাচ্ছেন।
শুধু ক্লাবের হয়েই না, জাতীয় দলের হয়েও সমান উজ্জ্বল মিশরীও ফারাও। দীর্ঘদিন পর মিশরকে তুলেছেন বিশ্বকাপের মূল পর্বে। এটুকুও যদি যথেষ্ট না হয় ব্যালন জয়ের ক্ষেত্রে তাহলে কি হবে সেটি বোঝা মুশকিল। ক্লপ এবং জেরার্ড তো রাখঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন সালাহই এই মুহুর্তে বিশ্বসেরা। ল্যাম্পার্ড বাড়তি শর্ত হিসাবে যোগ করেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের বিষয়টি।
এখানে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। সালাহ স্বপ্নের মত মৌসুম মেসি-রোনালদোকে সাধারনের কাতারে নামিয়ে আনছে না। গত দশ মৌসুম তারা যা অর্জন করেছে তা ব্যাখ্যাতীত। কিন্তু ব্যালন জয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় নির্দিষ্ট মৌসুমে কোনো খেলোয়াড়ের পারফরমেন্স। সে বিবেচনায় নিঃসন্দেহে সালাহ এখন বাকিদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। বিখ্যাত ফুটবল বিশ্লেষক ক্রিস সাটন তো ইতোমধ্যেই সালাহর হাতেই তুলে দিয়েছেন ব্যালনের খেতাব।
সালাহ তার এর পারফরমেন্স কতটা সময় ধরে রাখতে পারবেন তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এ মৌসুমে যদি রোনালদো-মেসিকে দর্শকের আসনে বসিয়ে ব্যালন হাতে হাসিমুখে পোজ দেন অবাক হবার কিছু থাকবে না, বরং সত্যি বললে এ মৌসুমে তার ব্যালন না জেতাটাই হবে বিস্ময়কর।