বিদায় ডন ইনিয়েস্তা

বিদায় ডন ইনিয়েস্তা

চলতি সিজনটা যেন পণ করেছে ফুটবল সমর্থকদের অাবেগের সর্বোচ্চ পরীক্ষা নেবার। মাত্র কিছুদিন আগে প্রায় দুই যুগের বন্ধন ছিন্ন করার ঘোষণা দিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। সে ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই অনুরুপ আরো একটি ঘোষণা। এবার সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে বার্সার ‘ডন’ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং বার্সেলোনার।

রিয়াল-বার্সার বৈরিতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। বার্সার কোনো খেলোয়াড় রিয়াল সমর্থকদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা পেয়েছেন এমন দৃশ্যও বিরল। অথচ, এ কঠিন কাজটিকেই সহজে পরিণত করে বছরের পর বছর বার্সার পাশাপাশি রিয়াল সমর্থকদেরও হৃদয়ে রাজ করেছেন এ স্প্যানিশ তারকা। বল পায়ে যতটা আক্রমণাত্বক, ব্যবহারে ততটায় বিনয়ী ইনিয়েস্তার বার্সা ছাড়ার ঘোষণায় তাই শুধু বার্সাই না, সমব্যথী শত্রুপক্ষ রিয়ালের সমর্থকরাও।

কম তো না, সেই ছিয়ানব্বই সালে একজন সাধারণ কিশোর হিসাবে বার্সায় প্রথম পা রেখেছিলেন ইনিয়েস্তা। দেখতে দেখতে কেটে গেল বাইশটি বছর। এ সময়টার মধ্যে কাতালানদের হয়ে জিতেছেন ৩১টি শিরোপা। কাতালান এ ক্লাবটি তার হৃদয়ে কতটা অংশজুড়ে রয়েছে তা বোঝা যায় বার্সা ছাড়লেও ইউরোপে না খেলার সিদ্ধান্তে। কারণ ইউরোপে খেললেই ঝুঁকি থাকবে বার্সার মুখোমুখি হওয়ার। এমন একজনকে বিদায় দিতে কাতালানদের কতটা কষ্ট হবে তা সহজেই অনুমেয়।

অশ্রুসজল চোখে যখন নিজের বিদায় ঘোষণা দিচ্ছেন তখন ভিজে উঠেছিল হলরুমে উপস্থিত সতীর্থদের চোখও। বার্সার পুরো স্কোয়াডের মধ্যে শুধু মেসি এবং সুয়ারেজই উপস্থিত থাকতে পারেননি আবেগঘন এ সংবাদ সম্মেলনে।

স্পেনের একটি স্থানীয় ক্লাবের হয়ে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে বার্সা স্কাউটদের নজরে অাসেন ইনিয়েস্তা। ‘৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। তখনই তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় লা মেসিয়ার পথে হাটার। মজার বিষয় হচ্ছে, লা মেসিয়ায় নিজের প্রথম দিনটিকে জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। সন্দেহ নেই বার্সায় খেলা তার স্বপ্ন ছিল, বাইশটি বছর নিরবিচ্ছিন্ন সার্ভিস দিয়েছেন নিজের স্বপ্নের ক্লাবকে। কিন্তু পরিবার অন্তপ্রাণ ইনিয়েস্তার জন্য পরিবারের বাইরে থাকা, তাদের সাথে নিয়মিত দেখা না করতে পারাটা ছিল শাস্তির ন্যায়। তবে সে শাস্তি যে তাকে শোকগ্রস্থ করার বদলে মানসিকভাবে আরো শক্ত করেছে তার সাক্ষী তো গোটা ফুটবল বিশ্বই।

কিশোর আন্দ্রেস প্রথম নজর কাড়েন বার্সার যুব দলের হয়ে ‘৯৯ সালের নাইকি কাপে। সে সময়ই ফাইনালে দু’দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন একটি গোল্ডেন গোলে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি, শুধুই এগিয়ে চলা। আর এ চলার পথে নিজেকে পরিণত করেছেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম এবং স্পেনের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ে।

স্বপ্নের বার্সার মূল দলে ইনিয়েস্তার অভিষেক ঘটে ২০০২/০৩ মৌসুমে ব্রাগার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। সে সময় বার্সার কোচ ছিলেন লুই ভ্যান গাল; যার তরুণ খেলোয়াড়দের প্রতি একটি দুর্বলতা ছিল। নিজেকে মেলে ধরার জন্য শুরুতেই সঠিক হাতেই পড়েছিলেন ইনিয়েস্তা। অভিষেকটা দ্রুত হয়ে গেলেও বার্সার জার্সি গায়ে গোল পেতে কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। সময়ের হিসাবে প্রায় দু’বছর। ততদিনে বদলে গিয়েছে ডাগ আউটের চেনা মুখও। ইনিয়েস্তার শেলের প্রথম শিকার হওয়া দলটি ছিল লেভান্তে; কোপা দেল রের নক-আউট রাউন্ডে।

ইনিয়েস্তা জাদুর সাথে ফুটবল বিশ্বের প্রথম পরিচয় ঘটে সান সিরোতে। যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি আন্দ্রেই পিরলো, জেনেরো গাত্তুসোরা। বার্সার দিন বদলের শুরু যে দলটার হাত ধরে, দিনহোর ছায়ায় কিছুটা যেন আড়ালেই ছিলেন তিনি। কিন্তু সান সিরোর সে ম্যাচই বুঝিয়ে দিয়েছিল কারো ছায়াতলে থাকতে না বরং ইতিহাস নতুন করে লিখতেই জন্ম ইনিয়েস্তার।
বার্সার ১৪ বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগখড়া কাটানোর পিছনেও দারুণ অবদান রেখেছিলেন তিনি।

এভাবে ধরে ধরে বলতে থাকলে অাসলে একটি উপন্যাসই লেখা যায় ইনিয়েস্তার অর্জন নিয়ে। কারণ, বার্সার যে দলটি একের পর এক ইতিহাস রচনা করে গিয়েছে তার অন্যতম সদস্যই শুধু তিনি নন, বরং অন্যতম মূল কারিগরই বলা যেতে পারে। একবার-দুবার না; একাধিকবার বার্সাকে রক্ষা করেছেন বিপদ থেকে। প্রয়োজনের মুহুর্তে ঐ শান্ত সৌম্য মুখটিই হৃদয় ভেঙ্গেছে বহু প্রতিপক্ষের।

পরিসংখ্যানের বোবা সংখ্যা কখনোই বোঝাতে পারবে না ইনিয়েস্তা কি। গার্দিওলার যে টিকি-টাকা; যা দিয়ে ট্রেবলই না শুধু মৌসুমের সাম্ভাব্য সবকটি শিরোপা উচিয়ে ধরলো বার্সা; তার পিছনের অন্যতম মুল কারিগর ছিলেন তিনি। বল পায় নিঁখুত, অসাধারণ ভীষণ, প্রয়োজনের সময় গোল করার সহজাত ক্ষমতা; আপনি যে কোনো ফুটবল ভক্তকে জিজ্ঞাসা করুন ইনিয়েস্তার দূর্বলতা খুঁজে বের করতে, নিশ্চিত থাকে বান্দা বিষম খাবে তবু ইনিয়েস্তার খুঁত খুঁজে বের করতে পারবে না। মিডিয়ার ফ্লাশ লাইট, কিংবা টুইটারের বার্তা কোনোটাই ইনিয়েস্তার প্রয়োজন পড়েনি। তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শুধু একজন খেলোয়াড় হিসাবেই না, মানুষ ইনিয়েস্তাকেও মনে রাখতে বাধ্য ফুটবল প্রেমীরা। তাই তো বার্সা খেলোয়াড় হিসাবে বার্নাব্যুর বিরুপ পরিবেশেও পেয়েছেন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। কিছু খেলোয়াড় থাকেন, যারা কোনো নির্দিষ্ট দলের বদলে হয়ে ওঠেন ফুটবলেরই দূত; ইনিয়েস্তা তেমনই একজন।

মাত্রই কিছুদিন আগে ফ্রেঞ্চ ফুটবল ম্যাগাজিন বলেছিল, ইনিয়েস্তার একটি ব্যালন অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। যা না হওয়ায় তারা দুঃখও প্রকাশ করেছিল। এ জবাবে বরাবরে মতই ইনিয়েস্তা নিজস্ব কায়দায় বলেছেল ‘এখানে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই ব্যক্তিগত অর্জন পছন্দ করে, কিন্তু আমার কাছে এটি কখনোই গুরুত্বপূর্ণ না। আমি যখন প্রথম এখানে আসি, আমি এটা শিখেছিলাম যে, এখানে একটি বল আছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটির যত্ন নেয়া’। আসলেই কি ইনিয়েস্তার কোনো ব্যালনের প্রয়োজন আছে? যারা তাকে খেলতে দেখেছেন, তাদের কাছে এই প্রশ্নটাই বেখাপ্পা ঠেকবে। কারণ, ইনিয়েস্তা এমন একটি জিনিস জিতেছেন যা বহু ব্যালনজয়ীও পারেনি; মানুষের হৃদয়।

মাঠের জাদুকর ইনিয়েস্তা মাঠের বাইরেও সমান জনপ্রিয়। বার্সার চির বৈরি প্রতিপক্ষ সার্জিও রামোস তো স্পষ্টই বলেছেন অন্তত দুটি ব্যালন ইনিয়েস্তার প্রাপ্য ছিল। আবেগঘন পোস্টে প্রিয় সতীর্থকে সম্মান জানিয়েছেন সাবেক সতীর্থ নেইমারও। ইনিয়েস্তার বিদায়ের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে সঠিক বাক্যটিই ব্যবহার করেছেন নেইমার। ইনিয়েস্তা যা করেছেন তার জন্য নেইমার নিজেই শুধু না, সমস্ত ফুটবপ্রেমীই তার কাছে কৃতজ্ঞ।

আরো একটি নক্ষত্র ঝরে গেল ফুটবলের জগত থেকে। এবং ইনিয়েস্তা এমন একটি নক্ষত্র যার কোনো বিকল্প আসবে না।

বিদায় দ্য ডন
বিদায় নিখাদ কাতালান যোদ্ধা।