ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবের শিয়া অধ্যুষিত কাতিফ প্রদেশের আল-আওয়ামিয়া শহরে আব্দুল্লাহ’র বাসায় হঠাত করে অভিযান চালায় সৌদী নিরাপত্তা বাহিনী। ভাগ্যক্রমে তিনি বাড়িতে ছিলেন না। সর্বপ্রথম গত বছর আব্দুল্লাহ’র বাড়িতে পুলিশি অভিযান হয় এবং তখন থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনো কারো বাড়িতে বা কারো বন্ধ দোকানে পর্যন্ত আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। এই পলাতক জীবনে তিনি বারবার তার পরিবার বিশেষ করে তার ৬ মাস বয়সী সন্তানের কথা ভেবে চিন্তিত হচ্ছেন।
আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমি ৯মাস যাবত নিজের স্ত্রীকে দেখছি না, এবং সন্তান বলতে কেবল সন্তানের একটি ছবি। তাদের সাথে এই না থাকাটা আমাকে বেশ ব্যাথা দেয়” ফোনে আলাপের এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আব্দুল্লাহ’।
এরকম অনেক তরুণ আল-আওমিয়ার নানা প্রান্তে আত্মগোপন করে আছে। যেহেতু গত বছরের আগস্ট থেকে শহরের বাইরে বের হবার পথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, তারা নিরাপদ স্থানেও যেতে পারছে না। তবে কেন এমন করছে সরকার তাদের সাথে, এই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল্লাহ বলেন; ‘আমি জানি না কি এমন করেছি আমি। আমি কেবল জানি আরব বসন্তের সময় সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম’। তিনি আরো বলেন, ‘তারপর থেকে আমাদের পুরো সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত আতঙ্কে ভুগছে, কেননা এখন পর্যন্ত ৫০জনেরও বেশি মানুষ আওমিয়ার শহর থেকে গুম হয়ে গেছে’। আব্দুল্লাহর পরিবারের আরো ৬ জন সদস্য গত বছর গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধ্বে অভিযোগ ছিল, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
মূলত ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সৌদি ক্ষমতাসীন পরিবারের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিল, এসব অভিযোগ মূলত আনা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেই। সেসময়ে একজন শিয়া ইমাম নিমর আল নিমরের নেতৃত্বেই সোদি রাজতন্ত্র হটানোর ডাক দেওয়া হয়েছিল এবং সৌদি আরবে শিয়াদের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য চালু আছে তার প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। ঠিক তারপরে ২০১২ সালে আল নিমরকে সৌদি সরকার গ্রেফতার করে এবং ২০১৬ সালে তাকে মৃতুদন্ড দেওয়া হয়। সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগ দিয়ে সেই শিয়া ইমাম ছাড়াও ৪৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০১৭ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন মোতাবেক, রাজনৈতিক কারণে ফাঁসির দন্ড ধার্য্যে সৌদি সরকার রেকর্ড করেছে। এখন পর্যন্ত সৌদি শিয়া, যারা তাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগ, নানা সময়ে তাদের ৩৮ জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
এমনকি সেই শিয়া ইমামের পরিবারকেও নানাসময়ে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে, সেই ইমামের একজন ভাই জিহাদ আল নিমর জীবন হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন, এবং এই এলাকা ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন
‘আমাকে সরকার খুঁজছে কারণ আমি সরকার-বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম, এবং আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চেয়েছিলাম। এমনকি এই সরকার আমার ভাইয়ের মৃত লাশ ফেরত দিতেও অস্বীকৃত জানালে, আমি সেটারও প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হই’।
তিনি জানান, ‘আসলে ফাঁসিকে সৌদি সরকার তার দমন-পীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে’।
রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতাশালী হওয়ার পর আল-আওমিয়া শহর দখল করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। স্থানীয়রা নানাভাবে এর প্রতিবাদ জানায়। জাতিসঙ্ঘ ৪০০ বছরের পুরানো এই শহরকে সংরক্ষণের আহবান জানালেও সৌদি সরকারের দাবি, তারা এই শহরকে উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার করবে। সেখানে শপিংমলসহ নানা স্থাপনা গড়ার কথাও শোনা যায়।
শিয়াদের কাছে ইমাম আল নিমরের এই আল-আওয়ামিয়া শহর রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ ব্যাপারে সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দাবি করেছেন, ইরানের সাথে সৌদি সরকারের শত্রুতা থাকলেও, সৌদি শিয়াদের প্রতি তার কোন বিরাগ নেই।
সৌদি আরবের সুন্নিপন্থি রাজতন্ত্রের কারণে শিয়ারা সেখানে সবসময় নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তবে অনেকের দাবি, গত বছর যুবরাজ সালমানের ক্ষমতায় আরোহনের পর থেকে সে নিপীড়ন ব্যাপক হারে বেড়েছে।
ডানা আহমেদ নামে একজন মানবাধিকার কর্মী জানালেন, যুবরাজ সালমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ২৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।