আপনি যদি কাউকে খাওয়ার পূর্বে চামচে চুম্বন করতে দেখেন অথবা যখন তারা একত্রিত হয় তখন একে অপরের হাতের পৃষ্ঠদেশে চুম্বন করতে দেখেন, তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন যে, তারা মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির অনুসারী অথবা তারা মৌলভি।
‘মৌলভি’, যাকে আমরা ‘সূফি’ বলেও চিনে থাকি, এরা বিখ্যাত মুসলিম কবি ও স্কলার মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির চিন্তাধারার অনুসারী। মাওলানা রুমি ১২০৭ সালে আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৭৩ সালে তুরস্কের কেন্দ্রীয় প্রদেশ কোনিয়ার ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা রুমির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মসনবী শরীফ’, যা তিনি তার দীর্ঘদিনের দরবেশ বন্ধু শামস-ই-তাবরিজিকে হারানোর শোকে রচনা করেছিলেন। রুমি এই গ্রন্থে সহ্যশক্তি ও ভালবাসার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং ধর্মীয় সিলসিলা ধরে রেখেছেন, যা বিশ্বব্যাপি প্রভাব বিস্তার করেছে, বিশেষত তুরস্ক, ইরান, আজারবাইজান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায়।
তুরস্কের পর্যটকেরা সাধারণত ‘ঘূর্ণায়মান দরবেশ’ অথবা নৃত্যরত সুফিদের সাক্ষাৎ পেয়ে থাকেন কিন্তু তারা এর সঠিক ইতিহাস বা গুরুরহস্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন।
একজন প্রবীণ দরবেশ বা আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা কাদেরি ইয়েতিস (৭৪) তার ছাত্রদেরকে উপদেশ দিচ্ছিলেন, যেন তারা নিজেদেরকে ‘মৌলভি’ হিসাবে পরিচয় না দেয়।
তার মতে, ‘এটা আত্মচর্চায় রূপ নেবে’। বলে রাখা যেতে পারে যে, ইয়েতিস একজন পেশাগত ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেন, ‘এটা মনে রাখা দরকার যে, তারা মূলত সর্বক্ষেত্রে তাদের আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মৌলভি হয়ে উঠবেন’।
মৌলভির অনুসারীগণ জানেন যে, ‘এই উপদেশ তাদের সহ্যক্ষমতা, দয়াময়তা ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধি করবে, যা তাদের জীবনের গতিবিধি বদলে দিবে’।
‘পৃথিবীতে যত কিছু বর্তমান আছে, সবকিছুর প্রতি সমানভাবে সম্মান জানানোর ব্যাপারে তাদের মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া রয়েছে’, বলছিলেন ইয়েতিসের একজন ছাত্রী, যার নাম নাগিহান সিফ্টারার (৩৮), যিনি তুরস্কের প্রথম ঘূর্ণায়মান নারী দরবেশ।
“যদিও এখানে কিছু গ্রুপ আছে যারা নারী-পুরুষের একত্রে ‘ঘূর্ণায়মান নৃত্য’ প্রদর্শন করে থাকেন, ঐতিহাসিক বিবেচনায় এটা আলাদাভাবে হওয়া উচিৎ’, বলছিলেন সিফ্টারার, যিনি বর্তমানে পেশায় একজন হিসাবরক্ষক, তিনি এটাকে ‘পার্থিব পেশা’ হিসাবে বিবেচনা করেন।
প্রতিবছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হাজার হাজার মানুষ ঘূর্ণায়মান দরবেশদের প্রদর্শনী দেখতে ভিড় জমান, বিশেষত কোনিয়া এলাকায়।
আন্তর্জাতিক মৌলভি ফাউন্ডেশনের বর্ণনা অনুসারে, মৌলভি জীবন হচ্ছে নিয়মানুবর্তিতা ও আইন মেনে চলার বিধিবদ্ধ জীবন।
১৯৯৬ সালে কোনিয়ায় এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ফারুক হেমদেম চেলেবি, যিনি রুমির ২২তম প্রজন্মের একজন সাধক।
মৌলভি ঐতিহ্যে বংশপরাম্পরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের মধ্যে যারা মৌলভি হতে চান তারা প্রথমে একজন পবিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসেন, সেখান থেকে তারা দরবেশে পরিণত হন, এরপরে শায়েখ এবং সর্বশেষ স্তর ‘চেলেবি’তে পরিণত হন।
‘সূফিবাদ খুবই জনপ্রিয়, বিশেষত তুরস্কে কিন্তু এর মূল প্রেরণা ও বিষয়বস্তু অনেকেই ভালোভাবে জানেন না’, বলছিলেন ফারুক হেমদেম চেলেবি, যিনি বিবাহ অনুষ্ঠানে বা উন্মুক্ত কোন দোকানে দরবেশদের প্রদর্শনীর ঘোর বিরোধী।
‘তুরস্কের সরকার ১৯২৫ সালে মৌলভিদের দরবার বা আস্তানা সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার অজুহাতে বন্ধ করে দেন। ১৯৫৩ সালে এটা আবার বৈধতা পায় এবং তুরস্ক সরকার কতৃক কোনিয়ায় জনসম্মুখে ‘ঘূর্ণায়মান প্রার্থনা’র অনুমতি প্রদান করা হয়’, বলছিলেন, একজন আমেরিকান শায়েখ ও রুমি গবেষক ইব্রাহিম গ্যামর্স (৬৭)।
গ্যামর্স, যিনি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী, পাশাপাশি তিনি মাওলানা রুমিকে নিয়ে দুইটি বইও লিখেছেন। তিনি আধ্যাত্মিকতাবাদ অনুশীলনে আগ্রহবোধ করেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ধারার আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন করেন কিন্তু সূফিবাদকে সর্বাধিক পছন্দ করেন।
এই নওমুসলিম বলেন, ‘মৌলভিপন্থা মুসলমানদের আধ্যাত্মিকতাবাদ কিন্তু পশ্চিমারা ইসলাম ও সূফিবাদকে আলাদাভাবে দেখতে পছন্দ করেন। ফলে তারা ইসলামমুক্ত সূফিবাদ চর্চা করেন এবং সূফিবাদের বই অধ্যয়ন করেন’। তার মতে, ‘মাওলানা রুমির বই যুক্তরাজ্যে খুবই জনপ্রিয়’।
চেলেবি বলেন, ‘বর্তমানে মৌলভিদের সকল আস্তানা বা দরবার তুরস্কের সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’। তিনি জানান, ‘বিশ্বজুড়ে তথা বাগদাদ থেকে মেসেডোনিয়া এবং মিশর থেকে বুলগেরিয়া জুড়ে প্রায় ১০১টি মৌলভি আস্তানা রয়েছে’।
তবে অনুশীলনকারীদের প্রকৃত সংখ্যা বের করা কঠিন। চেলেবি বলেন, ‘এটা বের করা সত্যিকার অর্থেই খুব কঠিন যে, সারা বিশ্বে মোট কতজন মৌলভি আছেন। তাছাড়া সেখানে অনেক ভক্তরাও আছেন। তবে আনুমানিক এক থেকে দেড় হাজার জন মৌলভি হতে পারে’। তার মতে, ‘যারা মৌলভীদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে, তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে’।
সাধক ইয়েতিস বলেন, ‘শুধুমাত্র মাওলানা রুমির মসনবি পাঠ করে কেউ মৌলভি হতে পারবে না’।
তিনি যোগ করেন, ‘একজন সাধকের উচিৎ তার অহংবোধ পরিত্যাগ করা এবং ‘ওসাকের’ আগুনে দগ্ধ করে ফেলা, এজন্য তাদের সেখানে যাওয়া উচিৎ, যেখানে মৌলভিরা একত্রিত হন’। তিনি মাওলানা রুমির কবিতা উল্লেখ করেন, “আমি ছিলাম অবুঝ ও দুর্ভাগা, সেখান থেকে জ্বলেপুড়ে আমি হয়ে গেলাম পরিপূর্ণ ও আলোকিত’।
গ্যামর্স বলেন, ‘ওসাক’ মানে হচ্ছে এক ধরণের আগুনের চুল্লি, যা তুরস্কে দেখা যায়। এই চুল্লির পাশে মৌলভিরা সাধনা করে পরিশুদ্ধি লাভ করেন, তথা পরিপূর্ণ হন’।
তিনি জানান, ‘মৌলভিরা অন্যসব মানুষের মতই সাধারণ মানুষ। এদের কেউ ছাত্র, কেউ সরকারি কর্মকর্তা, আবার কেউ কেউ ব্যাবসায়িক মানুষ’।
ঘূর্ণায়মান দরবেশদের পোশাক অনেক বেশি প্রতীকী। তাদের ‘শঙ্কু’ বা বিশেষ আকৃতির টুপি, যা পাথরের সমাধির মতো– এটা তাদের অহংবোধের মৃত্যুর প্রতীক।
৫৫ বছর বয়সী বেকির ইনিরির, যিনি ঘূর্ণায়মান দরবেশের একজন ও পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, তিনি বলেন, ‘তার দরবেশ হওয়ার সাধনা শুরু হয়েছিল নয় বছর আগে’।
তিনি জানান, প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে ‘সেমা’ বা ঘূর্ণায়মান জিকিরের মজলিশ শুরু হয়। বেকিরি বলেন, তিনি কোন ধর্মীয় পরিবারে বেড়ে ওঠেননি কিন্তু সবসময়ে আল্লাহর নৈকট্য চাইতেন। তিনি ৪৬ বছর বয়সে কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হন, ফলে তিনি কাদেরি ইয়েতিসের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তার নিকটে এক বছর প্রশিক্ষণ নেয়ার পরে তিনি প্রথমবারের মত ঘূর্ণায়মান জিকিরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, যা ছিল তার জীবনের আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে একটি অগ্রগতি।
তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণায়মান জিকির ও সূফিবাদ শেখার পরে আমার জীবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন ঘটে যায়। আমার জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে যায়’।
ইনিরির মতে, ‘বর্তমান পৃথিবী খুবই কঠিন একটি জায়গা। আমরা এমন একটা পরিবেশে বাস করি যেখানে মূল্যবোধ পরিণত হয়েছে অসভ্যপনায়’।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি রঙ্গমঞ্চে বসবাস করছি, যেখানে আমরা কর্ম করতে এসেছি, আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে। অথচ আমরা আমাদের আত্মঅহংকার বৃদ্ধির জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। যদি আমরা একটু আমাদের পেছনে ফিরে তাকাই, সূফিবাদ চর্চা শুরু করি এবং ভাবতে শুরু করি যে, জগতের এতকিছু কেন সৃষ্টি করা হয়েছে, তাহলেই আমরা আমাদের সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাব’।