বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার। সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী-কন্যা তাঁদের পাসপোর্ট যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সমর্পণ করেছেন। সেখান থেকে ওই পাসপোর্ট লন্ডনের বাংলাদেশের দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে; যা এখন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে আছে।
গতকাল সোমবার শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি লন্ডনের এক অনুষ্ঠানেও তারেক রহমানের নাগরিকত্ব বর্জনের কথা উল্লেখ করেন। এ বক্তব্যের পর লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমান প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে আইনি নোটিশ পাঠান। নোটিশটিতে তিনি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেন এবং আরও উল্লেখ করেছেন, দশ দিনের মধ্যে শাহরিয়ার আলমকে জাতির কাছে বা তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ নিয়ে আইনের অধ্যাপক ও সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বলেছেন, “পাসপোর্ট থাকা বা না থাকা, জমা দেয়া বা না দেয়ার সাথে নাগরিকত্বের কোন সম্পর্ক নাই। বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিক আছে, সবার তো পাসপোর্ট নাই। বিরাট সংখ্যক মানুষের পাসপোর্ট নাই তবে তারা কি এ দেশের নাগরিক না? জানা বোঝার কিছুটা সমস্যা আছে বলেই সেসব কথাগুলো হচ্ছে। পাসপোর্ট হচ্ছে একটি ট্রাভেল ডকুমেন্ট। এখন তারেক রহমানের পাঠানো আইনী নোটিশের বিপরীতে তার নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন করে জমা দেয়া দরখাস্ত যদি স্পষ্টভাবে না দেখাতে পারে তাহলে তো ‘উনি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন’ এই কথাটা টিকবে না।”
অন্যদিকে লন্ডন সফরে থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন।
তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কি আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহদীন মালিক বলেন, তারেক রহমান যদি রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে ব্রিটেনে অবস্থান করে থাকেন তবে সেটা বাংলাদেশ সরকারের একার হাতে থাকে না। যেমন রোহিঙ্গারা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, এখন মিয়ানমার যদি বলে রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফিরিয়ে দিতে অর্থাৎ প্রত্যাবাসন করতে। সেক্ষেত্রে তো তারা আবার মিয়ানমারে ফিরে গেলে নির্যাতনের শিকার হবে না, এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তি করবে না, করা উচিত হবে না। এবং তাকে (তারেক রহমান) ফেরৎ আনার ব্যাপারটা হচ্ছে আশ্রয়দাতা দেশের আইনের ব্যাপার, যেটা আইনগত ভাবে সম্ভব নয়, সেই পথে ওখানে গিয়ে দেনদরবার করে তো লাভ নাই।”
আবার এদিকে আইনমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না তারেক রহমান। ফলে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে এবং প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগ তারেক রহমানকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এরকম পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না।
উল্লেখ্য, তারেক রহমান ২০০৮ সালে পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেন। সে সময় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত করা হয়। শাহরিয়ার আলম জানান, এরপর আর তিনি মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেননি। ২০১৪ সালের ২ জুন তিনি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সপরিবারে পাসপোর্ট জমা দেন। সেখান থেকেই তা হাইকমিশনে আসে।
এ ঘটনার প্রমাণ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী যে নথি-র প্রতিলিপি প্রকাশ করেছেন। তাতে রয়েছে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ ভুল। যার জের ধরে বিএনপি এটাকে ‘রহস্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছে। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ভুল উল্লেখ করেন,
১. ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট’ এর স্থলে হবে ‘ইমিগ্রেশন কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট’
২. ব্রিটিশ ইংরেজিতে হোল্ডিং নাম্বারের পর কমা হয় না।
৩. পরের লাইনে আবার প্রদেশের নামের আগে কমা নেই।
৪. ‘বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশি’ লেখা হয়েছে।
৫. ‘অ্যাম্বাসি’ নয় হবে ‘হাই কমিশন’।
৬. ‘কুইন’স গেট’ বানান ভুল রয়েছে।
৭. টেলিফোর নাম্বার অকারণে বোল্ড করা হয়েছে।
৮. ব্রিটিশ ইংলিশে ডট (.) দিয়ে তারিখ লেখা হয় না। মাসের নাম উল্লেখ করা হয়।
৯. ‘স্যার’ এর স্থলে ‘স্যারস’ লেখা হয়েছে।
১০. উপরে চারটি পাসপোর্টের কথা উল্লেখ করলেও নিচে একটি পাসপোর্টের কথা বলা হয়েছে।
১১. ‘থ্যাংক ইউ’ এর পরে ফুলস্টপ নেই।
১২. বাক্যের মাঝে থাকার পরেও ‘ফেইথফুলি’ বানানে বড় হাতের অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে।
১৩. স্বাক্ষরকারীর নাম দেয়া নেই।
পাসপোর্ট জমা দেয়া মানে কি নাগরিকত্ব থাকলো না?- এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম জানান, বিদেশে থাকার বিষয়টা ভিন্ন। কিন্তু তাঁর কাছে এখন আর কোন বাংলাদেশি পরিচয়পত্র থাকলো না। যেহেতু তার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, তারেক রহমান বিশ্বের অসংখ্য বরেণ্য রাজনীতিবিদদের মতোই সাময়িকভাবে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। আর সংগত কারণেই তা পেয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অংশ হিসেবেই তিনি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র বিভাগে তাঁর পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। সে দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, তাঁর পাসপোর্ট জমা রেখে তাঁকে ট্রাভেল পারমিট দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পাসপোর্ট তাঁর কোনো কাজে লাগছে না। যখনই তিনি দেশে ফেরার মতো সুস্থ হবেন, তখনই তিনি দেশের অন্যান্য নাগরিকের মতোই পাসপোর্টে জন্য আবেদন জানাতে এবং তা অর্জন করতে পারবেন।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ফেসবুক পেজ হ্যাক করা হয় বলে তিনি জানান। প্রতিমন্ত্রী গতকাল সোমবার তাঁর এই পেজে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পাসপোর্টের ফটোকপি এবং যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরে তার জমা দেওয়া আবেদনের একটি কপি পোস্ট করেন। এসব কপি হ্যাক করা হয়েছে এবং তা উধাও হয়ে গেছে বলে প্রতিমন্ত্রী তাঁর পেজে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার একটি পোস্টে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম লিখেছেন, ‘আমার ফেসবুকের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে সারা রাত। হ্যাকিং। পোস্ট উধাও। বুঝতেই পারছেন এই বিনিয়োগ কারা করেছে। তার পেজটি হ্যাকড হয়েছে। এরপর কিছু পোস্ট উধাও হয়ে গেছে।’
গত শনিবার বিতর্কের শুরুটা হয় লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, লন্ডনে হাইকমিশনে নিজের পাসপোর্ট জমা দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন।
অথচ সর্বশেষ বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার ক্লেইমের মূল বিষয় নাগরিকত্ব ছিল না, ছিল পাসপোর্ট ফেরত দেয়া। কিন্তু বিএনপির নেতার কথাতেই এখন প্রমাণ হচ্ছে যে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তাই নাগরিকত্বের কথাটি আমি এখন আরো জোরালোভাবে দাবি করবো। অ্যাসাইলাম সিকাররা (আশ্রয়প্রার্থী) রাষ্ট্রবিহীন বা স্টেটলেস থাকেন, তারা যে দেশের লোক সেদেশে বাঞ্ছিত নন, বা সেদেশে যেতে চান না, এই কারণে তারা পাসপোর্ট সমর্পণ বা হ্যান্ডওভার করেন। তারেক রহমান ঠিক তাই করেছেন।
সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “সফরের পুরোটাই তারেক রহমানময়, অথচ আরও অনেক কিছু ছিল। যার কোনো কিছু আলোচনায় নেই। আশা করা যায় সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্ন-উত্তরও তারেক রহমানময়ই হবে। অর্জনটা কী হলো, তারেক রহমানের গুরুত্ব প্রমাণ করা ছাড়া? হ্যাঁ, জানা গেল রাজনৈতিক আশ্রয়ের তথ্য। তা জানার তো আরও অনেক উপায় ছিল। রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া-পাওয়া, হোম অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট দুতাবাসে আসার সঙ্গে নাগরিকত্ব ত্যাগের কোনো সম্পর্ক নেই, প্রতিষ্ঠিত সত্য আড়াল করে-অপরিপক্কতা প্রমাণের প্রতিযোগিতা চলছেই। গলা পর্যন্ত কাদায় ডুবেও যেন কাদা গায়ে লাগছে না। বোকা বোকা কথা বলা অব্যাহত আছে।”
ওই স্ট্যাটাসের মন্তব্যে হাবিব বাবুল নামের একজন তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন একসময়। এবং তাকেও নীল রংয়ের ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয়েছিল। এবং সেখানে তার জাতীয়তা হিসেবে বাংলাদেশিই লিখতে হতো।