অজানায় ঘুরতে চলে যাওয়া বাংলা গানের বরপুত্র

অজানায় ঘুরতে চলে যাওয়া বাংলা গানের বরপুত্র

১৯৬৮ সালের শেষদিকের কথা। তদানীন্তন অবিভক্ত পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে এইচএমভি পাকিস্তানে সুরকার হিসেবে এনলিস্টেড হলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সের এক বিস্ময়বালক। বছর দুয়েক পর এইচএমভি ইন্ডিয়ায় সুরকার ও শিল্পী হিসেবে এনলিস্টেড হয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। এইচএমভি স্টুডিও এন্ড রেকর্ড লেবেলে তখন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পীদের নামই কেবলমাত্র এনলিস্টেড হতো। এই রেকর্ড লেবেল থেকে এলবাম প্রকাশিত হওয়াকে সেই সময়ে সংগীতের অঙ্গনে সবচেয়ে মর্যাদার গণ্য করা হতো। ১৯৫৫ সালে পুরাতন ঢাকায় জন্ম নেয়া এই সংগীত বিস্ময়ের নাম লাকী আখান্দ। আদি নিবাস কুমিল্লা জেলায়। সংগীত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম নেয়া লাকীকে মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই পিতা আব্দুল হক সংগীতে তালিম দিতে থাকেন। কঠোর অধ্যবসায় আর প্রতিভার দ্যুতিতে অল্প বয়সেই আলোচনায় আসেন তিনি। ছোট দুই ভাই জলি আর হ্যাপিও হাঁটতে থাকেন তারই পথ ধরে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আবারো মনোনিবেশ করেন সংগীতে।

১৯৭৫ সালে ছোটভাই (আরেক কিংবদন্তী শিল্পী) হ্যাপিকে দিয়ে কিছু গান করান লাকী আখান্দ। ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’, ‘পাহাড়ি ঝর্না’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ শিরোনামের গানগুলো প্রকাশিত হলে এক লহমায় তখনকার বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন সম্পূর্ণ ভিন্নধারার এই সংগীতে বুঁদ হয়ে যায়। প্রথাগত বাংলা গানের ধারায় নবতর যন্ত্রানুসঙ্গ আর সংগীতায়োজনের এক প্রবল ঢেউ এসে লাগে। রক এন্ড রোল আর পপ ঘরানার সাথে মিশ্রণ করে বাংলা গানের ছন্দ, বাদনরীতি আর গায়কীর ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন একটি ধারার প্রচলন করেন এই ভাতৃদ্বয়। ক্লাসিক্যাল মিউজিক শেখার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈচিত্রপূর্ণ গান শুনে নিজেকে ঋদ্ধ করেছিলেন লাকী আর হ্যাপি আখান্দ। স্প্যানিশ, ল্যাটিন, রাশিয়ান, ম্যাক্সিকান ছন্দগুলোর প্রয়োগে সৃষ্টি হতে থাকে কালজয়ী সব গান। ‘ঐ নীল মনিহার, আমায় ডেকোনা’, ‘তুমি ডাকলেই কাছে আসতাম’ গানগুলো লাকী আখান্দকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। নিজের এবং হ্যাপির গানের পাশাপাশি লাকী আখান্দের সুর করা গান ‘এমন একটা মা দে না’, ‘মামুনিয়া’ গেয়ে তুমুল আলোচিত হন ফেরদৌস ওয়াহিদ। তার সুরারোপিত যেখানে ‘সীমান্ত তোমার’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর’ প্রভৃতি গান কন্ঠে ধারণ করে শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়তে সক্ষম হন কুমার বিশ্বজিত, সামিনা চৌধুরীরা। এসময়ে ছোটভাই হ্যাপি ভারতে গিয়ে মান্না দে, আরডি বর্মন প্রমুখ উপমাহাদেশের কিংবদন্তিদের মোহিত করে ফেলেন নিজস্ব বাদন আর গায়কীতে। জন্মগত বিরল প্রতিভার অধিকারী দুই ভাই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানে গিটার আর কিবোর্ড এর সার্থক ব্যবহার ঘটান। প্রকৃত প্রস্তাবে লাকী আখান্দ সর্বপ্রথম এদেশে গিটার বাদনের প্রচলন করেন। সেসময় লাকী আর হ্যাপি আখান্দের বাদনের ধারেকাছেও ছিলেন না এদেশের কোন যন্ত্রশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক। এমনকি কলকাতা কিংবা মুম্বাইয়ের অনেক খ্যাতিমান মিউজিশিয়ান এই ভাতৃদ্বয়ের যন্ত্রবাদনের অমিত প্রতিভার দ্যুতির কাছে পাত্তাই পাননি।

কিন্তু ১৯৮৭ সালে আদরের ছোটভাই হ্যাপির অকস্মাৎ প্রয়াণ লাকী আখান্দকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। সংগীতের ভুবন থেকে এক দীর্ঘ নির্বাসনে চলে যান তিনি। শ্রোতাদের বহু অনুরোধ আর নিজের আত্মার তাগিদে ১৯৯৮ সালে কামব্যাক করেন লাকী আখান্দ। এই ফেরার পর্বটি চমকপ্রদ। অনেকেরই ধারণা ছিল লাকীদের সময়ের সংগীত আর চলনসই হবে না। কিন্তু সংগীতের চিরকালীন ক্লাসিক্যাল সৃষ্টিশীলতা যার ধমনীতে বহমান ছিল, তাকে সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। জেমসের কন্ঠে ধ্বনিত তার সুরারোপিত ‘লিখতে পারি না কোন গান আর তুমি ছাড়া’ গানটি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর্ক ব্যান্ডের হাসানের গাওয়া ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’, ‘সামিনা চৌধুরীর গাওয়া ‘কালকে যেদিন ছিলো’ গানগুলো লাকী আখান্দের চিরসবুজ এবং চির আধুনিক সংগীত প্রতিভারই স্বাক্ষর বহন করে। বাংলা গানের পুরনো ধারার খোলনলচে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে আধুনিক রূপ দেয়ার একক কৃতী লাকী আখান্দের। কিন্তু আমাদের সংগীতের শাস্ত্রীয় বৈশিষ্টকে ভিত্তি (বেইজ) করেই তিনি তার সুরসম্ভারকে প্রকাশিত করেছেন। বাংলা গানের প্রবহমান সুরের নিজস্বতার ওপর তিনি বিভিন্ন বৈচিত্রপূর্ণ অলংকার যোগ করে বিনির্মাণ করেছেন সুরের ধারার অমর এক ইমারত। বিভিন্ন ঘরানা আর ধারার পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল সংগীতে তার ঈর্ষণীয় দখলের অমর এক মাস্টারপিস বলা যায় আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে গানটিকে। এদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ, কিংবদন্তি গজল-শিল্পী উস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া এই গানটিতে সুরারোপ করেন লাকী আখান্দ। গানটি বিখ্যাত গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা। লাকী আখান্দ আর কাওসার আহমেদ চৌধুরীর জুটি এদেশের সংগীতকে উপহার দিয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান। গান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাণীকে খুবই গুরুত্ব দিতেন লাকী আখান্দ। পাশাপাশি সুরারোপের ক্ষেত্রে কথামালার আবেগকে মাথায় রেখে মেলোডিকে দিতেন প্রাধান্য। তাই তার সৃষ্টিকে বলা হয়ে থাকে সময়ের চেয়ে কয়েক ধাপ এগোনো। তাই, আজও কোথাও ঘুরতে বের হলে ‘আমায় ডেকোনা’ কিংবা ‘চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে’ গানগুলোই সবার আগে ঘুরেফিরে গীত হয়। লাকী আখান্দকে শুধুমাত্র সুরকার বা গায়ক হিসেবে বিবেচনা করলে তার একটি দিক একেবারেই অগোচরে থেকে যায়। গিটার কিংবা কীবোর্ড বাদনে তার ধাঁচটি একেবারেই স্বকীয়। গানের কর্ডিং এর ক্ষেত্রে হ্যাপি আর লাকী আখন্দের মতো মুন্সিয়ানা এদেশে কেবলমাত্র অকালপ্রয়াত শেখ ইশতিয়াক আর নিলয় দাশই দেখাতে পেরেছেন সম্ভবত।

এই লেখকের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের আলাপচারিতায় লাকী আখান্দ সংগীত নিয়ে তার নিজস্ব ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সমসাময়িক কালের নকল সুর, চটুল কথা আর দুর্বল কম্পোজিশন নিয়ে বলতেন হতাশার কথা। তিনি সবসময় নিবিষ্ট চর্চাকে গুরুত্ব দিতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ঢাকা শহরের যানজট তাকে বিরক্ত করতো প্রচণ্ড। তাই প্রায়ই চলে যেতেন ময়মনসিংহ জেলায়, কিংবা ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও। রেষারেষি আর চাটুকারিতা থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রাখা এই সুরস্রষ্টা ছিলেন আত্মমর্যাদায় বলীয়ান। তাই অসুস্থতার সময়েও হাত পাতেননি কারো কাছে। এমনকি সরকারের কাছেও নয়। শেষ পর্যন্ত তার অসুস্থতার খবর সুহৃদজন এবং প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়।

গত ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত লাকী আখান্দ পাড়ি জমান অজানার দেশে। ঢাকা শহরে সেদিনও অঝোরে ঝরেছিল বৃষ্টি। তারপর একটি বছর কেটে গেলো দ্রুতই। আজও এ শহরে বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। কিন্তু প্রিয় কীবোর্ডে টুপটাপ জলতরঙ্গের মতো সুর তুলতে আমাদের মাঝে আর নেই লাকী আখান্দ।

নতুন করে আর কখনো সুরেলা ঝংকার তুলবে না গিটার, তার হাতের জাদুতে। তবে সুরের যে সোনালি তরী তিনি ভাসিয়ে গেছেন, তা এদেশের সংগীতপ্রেমীদের যুগ যুগ ধরে ঘুরতে নিয়ে যাবে মোহময়তার অজানা এক দেশে।