সাম্বার তাল, টিকি-টাকার ছন্দ, দ্রুত লয় কাউন্টার অ্যাটাক; ফুটবলের নিত্যকার অনুসারীদের কাছে এ শব্দগুলো ভীষণ পরিচিত। কিন্ত এই তাল-ছন্দ-লয়; এগুলো তো সংগীতের শব্দ, ফুটবলে এগুলোর আগমন কেন? বা মিউজিকের সাথে ফুটবলের অাদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না? অনেক প্রশ্নই এসে যায়। সেসকল প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন আইভোর বোল্টন। বিখ্যাত টিয়াট্রো রিয়াল অপেরা হাউসের সংগীত পরিচালক। যিনি একই সাথে একজন নিবেদিত প্রাণ ফুটবল ভক্ত। ফিফা’র ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে পেরিকলস মনিওদিস আইভোর বোল্টনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। জবান পাঠকদের জন্য চমৎকার এই আলাপচারিতাটি অনুবাদ করেছেন দেওয়ান মারুফ শুভ।
ফুটবলের নিয়ে ছোটবেলার সবচেয়ে মনে রাখার মতো স্মৃতি কি?
আইভোর বোল্টন : আমার প্রথম ফুটবলীয় অভিজ্ঞতার সাথে ‘বোল্টন’ জড়িত। এমন একটা ক্লাব, যার রয়েছে বিখ্যাত অতীত এবং ইতিহাস। আমার বয়স তখন সাত বছর, বাবা আমাকে নিয়ে যান বোল্টনের খেলা দেখতে। বাবা ছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ এবং ব্ল্যাকবার্ন ছিল শিল্পায়িত শহর। রোভার্স তখন দ্বিতীয় বিভাগে খেলত, এখন আমরা যাকে চ্যাম্পিয়নশিপ বলি। হেঁটে মাঠে যাওয়ার উত্তেজনাপূর্ণ এই মুহুর্তটি আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি।
কখনো ফুটবল খেলেছেন?
বোল্টন : আমার রবিবার সকালটা সবসময়ই পিয়ানো শেখার জন্যে বরাদ্দ থাকত। আমাকে রাশিয়ান একজন বিখ্যাত শিক্ষক পিয়ানো শেখাতেন। প্রশিক্ষণের পর আমি বাবার সাথে মাঠে যেতাম। আমি গ্রামার স্কুলের দলে খেলতাম কিন্ত কখনোই স্কুলের প্রধান দলে জায়গা পাইনি। আমার সহপাঠী কয়েকজন ইংল্যান্ডের যুবা দলে খেললেও আমি তাদের থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে ছিলাম। কিন্ত হ্যাঁ আমি খুব উদ্যমী লেফট-ব্যাক ছিলাম।
পিয়ানো বাজানো মানে ছন্দ অনুসরণ করা, এটা হচ্ছে আবেগ, সূক্ষ্মতা, শিল্প। আপনি কখনো ফুটবলের পিচে এসব খুঁজে পেয়েছেন?
বোল্টন : আমি ইংল্যান্ড যাওয়ার অনেক পরে আর্সেনালের ভক্ত হই। হয়তো আগেও ছিলাম কিন্ত যখন আর্সেন ওয়েঙ্গার আসে তখন এটা প্রতিভাত হয়। তার খেলার ধরণ ছিল নিখুঁত, ছিল একটা আলাদা কাঠামো। খেলোয়াড়রা সবসময়ই ছন্দে থাকতো এবং মাঠে জায়গা খুঁজে পেত। তার খেলার শৈলীতে একটা সৌন্দর্য ছিল।
কিভাবে আপনি পেশা হিসেবে সংগীতকে বেছে নিলেন?
বোল্টন : ছোটবেলায় আমি স্থানীয় গির্জায় গাইতাম। গানের দলটা খুব বিখ্যাত ছিল না, কিন্ত আমাদের অনেকটা সময় প্রশিক্ষণে থাকতে হত। শুক্রবার সন্ধ্যায়, শনিবার সকালে প্রশিক্ষণ নিতাম এবং রবিবার দুইবেলা গির্জায় গাইতে হতো। এছাড়া স্কুলের পরে সপ্তাহে ছয়দিনই গাইতাম। আমাদের একটা নির্দিষ্ট সূচি ছিল এবং দায়িত্ব নিয়ে গাইতাম। আসলে প্রতি সপ্তাহে অনেক সময় ব্যয় হতো এর পেছনে যেমনটা ফুটবল দলের ছেলেমেয়েরা ব্যয় করে প্রশিক্ষণে। অনেকটা সময় ব্যয় করার পরই তারা সিদ্ধান্ত নেয় আসলে ক্যারিয়ারটা ফুটবল কেন্দ্রিক হবে কি না।
এবং আপনার সাহসও ছিল এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার…
বোল্টন : হ্যাঁ আমি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি এবং সফল হই। আমার গণিতেও আগ্রহ ছিল কিন্ত গণিতের জন্যে ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ডে আবেদন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আমার আগ্রহ ছিল সংগীতে এবং ক্যামব্রিজ নিঃসন্দেহে সংগীতের জন্যে ব্রিটেনের মধ্যে সেরা প্রতিষ্ঠান। শুধু প্রশিক্ষকই না, সহপাঠীরাও থাকে চোয়ালবদ্ধ। আপনি হঠাত করেই এমন অনেক জনের মধ্যে এসে পড়বেন যারা সবাই অত্যন্ত প্রতিভাসম্পন্ন। তখন আপনার নিজেকে অতিক্রম করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমি তখন ফুটবল অনুসরণ করার সময়ও পেতাম না।
আপনি এখন মাদ্রিদের ‘থিয়েটার রিয়ালের’ পরিচালক। ফুটবল এখন আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বোল্টন : আমি খেলা দেখি এবং যথেষ্ট আনন্দ পাই। যদিও আমি আর্সেনালের খেলা দেখার সময় করে উঠতে পারি না। সত্যি বলতে, এখন আমি বার্সেলোনায় থাকি এবং তাদের সব খেলার টিকিট আছে আমার। বার্সেলোনার খেলা দেখা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। মাদ্রিদেও প্রায়ই আমাকে তাদের খেলার দেখার আমন্ত্রণ করা হত। কিন্ত আমি সত্যিকার অর্থেই আবার খেলায় ফিরে গিয়েছিলাম যখন আমি মিউনিখে বাভারিয়ান স্টেট অপেরাতে ছিলাম। সেখানে জার্মান থিয়েটার লিগে বাভারিয়ান স্টেটের হয়ে আমাকে খেলার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। ১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দিন আমাদের ট্রেনিং ছিল… যেদিন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফাইনালটা মিউনিখের হাত থেকে চুরি করে নেয় (হাসতে হাসতে)। শেষ দুই মিনিটে ম্যানচেস্টার ইউনাইটডের দুই গোল আমার জার্মান সহকর্মীদের হতভম্ভ করে দেয়।
এখন বার্সেলোনায় কেন থাকা হয়? বার্সার জন্যে?
বোল্টন : না আসলে (হাসতে হাসতে)। আসলে আমার স্ত্রী একজন সংগীততাত্ত্বিক, স্প্যানিশ সংগীতের রেনেসাঁর একজন বিশেষজ্ঞ এবং তাকে এখানে কাজ করতে আমন্ত্রণ করা হয়। সে এর আগে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক ছিল, এখন বার্সেলোনায় গবেষণার কাজ করছে। আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি স্পেনে থাকতে অস্বীকৃতি জানাব কি না। আমি বললাম, একদমই না। এখানে আসার দুই বছর পর আমি থিয়েটার রিয়ালের পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ পেলাম। এখন আমাদের মাদ্রিদেও একটা এপার্টমেন্ট আছে কিন্ত আমরা বার্সেলোনাতেই বেশি থাকি। আমি নিজেকে ভাগ্যবানই বলব, কারণ আমি ফুটবলের খুব কাছাকাছিই থাকতে পারছি।
মায়েস্ত্রো, ফুটবলের সাথে সংগীতের কী কী মিল খুঁজে পান আপনি?
সংগীত এবং ফুটবলে দলবদ্ধভাবে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। পুরো একটা দল মিলে কোন স্বরগ্রামকে ব্যখ্যা দেয়ারই একটা অদৃশ্য অংশ হচ্ছে অর্কেস্ট্রাকে প্রশিক্ষণ করানো। ধরুন, আপনি যদি একজন ব্রাস বাদক হিসেবে একটা ভুল করেন তখন আপনার সহকর্মীদেরও চাপের মধ্যে ফেলে দিবেন এবং পুরো দলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। তাই বলা যায় দায়িত্ব দলের প্রত্যেকটা সদস্যের উপর বর্তায়।
তাহলে তো বলতে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিজেদের মধ্যেই…
বোল্টন : হ্যাঁ, কারণ আপনার এমন কোন প্রতিদ্বন্দী থাকবে না যে আপনার অনুষ্ঠানের ক্ষতি করতে চাইবে। অনেকে পরিচালকদেরও প্রতিদ্বন্দী মনে করেন (হাসতে হাসতে)। কিন্ত আমি বলব আমি একজন প্রশিক্ষকের মত।
কিভাবে?
ফুটবল অথবা সংগীতে, সবসময় আপনার একটা লক্ষ থাকে। ফুটবলে লক্ষ থাকে খেলায় জেতা, একটা শৈল্পিক উপায়ে। অর্কেস্ট্রার লক্ষ থাকে একটা স্বরগ্রাম প্রদান করা এবং শৈল্পিক উপায়ে তা ব্যাখ্যা করা। তাই বলা যায় পরিচালকই এই লক্ষটা ঠিক করে দেন। মাহলার বা ব্রাকনারে সুর তোলা সহজ কোন কাজ নয়। আমি মনে করি এর জন্যে প্রতিনিয়তই মানুষ নিজের সক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে আরো উপরে নিয়ে যায়। রিচার্ড ভাগনারের স্টাইলে সুর তোলার জন্যে আপনাকে আপনার সেরাটাই দিতে হবে। ডেবাসির সুর তুলতে গেলে মস্তিষ্ককে দ্রুত কাজ করাতে হয়। ঠিক একই কথা বলা যায় গার্দিওলা বা ওয়েঙ্গারের রণকৌশলের ব্যপারে।
আপনার নিজস্ব স্টাইল কী?
বোল্টন : আমি তেমন কর্তৃত্ববাদী সংগীত পরিচালক নই। পুর্ববর্তী প্রজন্মের পরিচালকগণ ছিল অনেকটা স্বেচ্ছাচারী। তারা ছিলেন নিজেদের ঘরানার ওস্তাদ। এটা অবশ্য তারা যেই সমাজে বাস করতেন তারই একটা প্রতিচ্ছবি, যা তাদের মধ্যে কর্তৃত্বের প্রবণতা নিয়ে এসেছিল।
ফুটবলেও এরকম কোচ রয়েছে…
বোল্টন : আপনি যখন একটা অর্কেস্ট্রার সামনে দাঁড়াবেন তখন আপনার কথার একটা মূল্য থাকবে, আপনার কথার একটা অর্থ থাকবে, অন্যথায় সেখানে শৃংখলা থাকবে না। সাধারণত আপনার দল চাইবে একটা গতিশীল শক্তিশালী মহড়া, তাদের মধ্যে বিশ্বাস থাকতে হবে যে সমস্যাগুলোর সমাধান মহড়াতেই হচ্ছে। এই ধরুন, একসাথে সুর তোলার মুহুর্ত বা যান্ত্রিক কোন সমস্যা এবং একই সাথে পুরো সুরটা ঘষামাজা করা। তাই পুরো কাজটাই হচ্ছে মনোযোগ প্রদান করা এবং ধীরে কথা বলা। ফুটবলে আমি একজন উৎসাহী কোচ চাইব যার মস্তিষ্ক পরিষ্কার এবং সংগঠিত, যিনি জানেন তিনি কী চান। সে শুধু টাচলাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে হবে খেলোয়াড়দের মতই নিবেদিত।
তাহলে আপনি কি আশা করছেন, এটা বোঝা নিশ্চয়ই গুরত্বপূর্ণ?
বোল্টন : হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যেই সুরটা বের করে আনতে চাচ্ছেন তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা আপনার মাথায় থাকে। তাই আমি এমন কাউকেই পছন্দ করি যার মাথায় একটা সুর বা খেলা সম্পর্কে মজবুত দূরদৃষ্টি রয়েছে।
আপনার দলের তারকাদের সম্পর্কে কি বলবেন?
মাঝে মাঝে তারা নিজেরাই একজন মুখপাত্র ঠিক করে নেয়। কিন্ত সাধারণত আমি উপভোগ করি যখন দলের সদস্যরা নিবেদিত, আমি দলের সাথে কথাবার্তটা উপভোগ করি। তারা চায় সবসময় ভাল কিছু দিতে। আমি চেষ্টা করি তাদের উৎসাহিত করতে। যখন একটা অর্কেস্ট্রার সব সদস্য দায়িত্ব নিতে চায়, সেই অর্কেস্ট্রাগুলোই সেরা হয়ে ওঠে। বার্লিনের অর্কেস্ট্রাগুলা সাধারণত বাজানোর সাথে সাথে স্বর দেয়; তাই মহড়ার সময় তারা অনেক কথা বলে। কোন কোন পরিচালকের মহড়া গুলোও দর্শকদের জন্য অনুষ্ঠিত আসল প্রদর্শনী অপেক্ষা বেশি আনন্দদায়ক।
এটা নিশ্চয়ই কোন ফলপ্রসূ কৌশল না?
বোল্টন : ফুটবলে আপনি এই কৌশলে হেরে যাবেন (হাসি)।