সেকুলার হিন্দু, সেকুলার মুসলিম; রাজিব ভার্গাভার নিবন্ধের প্রতিক্রিয়া

সেকুলার হিন্দু, সেকুলার মুসলিম; রাজিব ভার্গাভার নিবন্ধের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ এবং ভারতে এখন এই তর্কটা এতোই সরব যে এটা শুধু আর জ্ঞানগত বা একাডেমিক চর্চার বিষয় নেই। রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সামাজিকভাবেও সেকুলার ও অসেকুলার মতবাদটি নিয়ে তর্ক শুধু না, রক্তারক্তির ঘটনাও ঘটে চলেছে।

এখন ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন মোদি সরকারের আমলে নিরবে বৈধতা পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে এই নির্যাতন ও মুসলিম নারী এমনকি শিশু ধর্ষণের ঘটনাকেও হিন্দু জঙ্গিরা জায়েজ করতে, বৈধতা দিতে, এইসব জঘন্য ঘটনাকে জনপ্রিয় করতে আন্দোলনে নামছে (সর্বশেষ আসিফা বানুর ধর্ষণ ও হত্যার কথা বলা যায়)। এরা ভারতে মুসলমানদের হত্যা ও ধর্ষণের অধিকার নিশ্চিত করতে চাইছে যেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংষ্কৃতিতে হিন্দুস্তানি আগ্রাসনকে মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য একশ্রেণীর লোকজন উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশের সংষ্কৃতি যত বেশি হিন্দুস্তানি, ভারতের মিডিয়াতে প্রশংসাও সেরকমভাবে বেড়ে যায়। বাঙালি মুসলমানের কোন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ সেখানে এলেই ঢালাওভাবে জঙ্গি, মৌলবাদী বলা হয়।

এই পরিস্থিতিতে হিন্দু ও মুসলিম মানে মানুষের ধর্মপরিচয়কে অক্ষুন্ন রেখে সেকুলার ধারণাটি কিভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তা নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল ভারতের পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’তে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘সেকুলার হিন্দু, সেকুলার মুসলিম’ শিরোনামে এই লেখাটি লিখেন সেকুলারিজম বিষয়ক খ্যাতিমান তাত্ত্বিক রাজিব ভার্গাভা। তিনি রাজনৈতিক চিন্তক এবং সেকুলারিজম বিষয়ে কাজের জন্য সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক পরিচিত।

রাজিবের লেখার সুত্র ধরেই এখানে কয়েকটি কথা বলার চেষ্টা করছি।

রাজিব এ লেখায় বলেন, ‘সেকুলারিটি আর ধর্ম এই দুটিই আসলে ধারণা বা কনসেপ্টগত দিক থেকে খুবই কাছাকাছি। মানুষ মূলত তাদের সম্পর্কের ধরণের কারণে এই দুইয়ের মধ্যে একটি বৈপরীত্য তৈরি করে। কেউ যদি মনে করে সেকুলার মানে ধর্মবিরোধিতা; তাইলে না থাকে সেকুলারিটি না থাকে ধর্ম।

আমরা যদি মনে করি রাষ্ট্র বা ব্যক্তিকে সেকুলার হতে হলে, ধর্মবিরোধী হতে হবে তাইলে বুঝতে হবে, আলাপের গোড়াতেই সমস্যা আছে। সেকুলার হিন্দু বা সেকুলার মুসলিম বলে কিছু হতে পারে না। এই টার্মটি স্ববিরোধী। সেকুলারিজমের কতগুলো মূল্যবোধ আছে। একজন মানুষ একই সাথে হিন্দু বা মুসলিম এবং সেকুলার হতে পারেন না। সেকুলার হিন্দু বা সেকুলার মুসলমান হতে পারেন না। এটা এতো দিন নানাভাবে গোজামিল দিয়ে বলা হয়েছে। যার ফলে আমাদের সমাজে চলমান ভায়োলেন্সটা বন্ধ করা যায়নি। রাষ্ট্রও প্রকৃত সেকুলার হয়ে ওঠেনি।

আবার নিজেকে সেকুলার প্রমাণ করতে কেউ যদি বলেন, আমি ধর্মগতভাবে মুসলিম বা হিন্দু না; আমি আসলে সংষ্কৃতিগতভাবে মুসলিম বা হিন্দু; তাতেও সমস্যার সমাধান হয় না। সংষ্কৃতি দিয়ে ধর্ম পরিচয় আড়াল করতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে এই মনোভাবই প্রকাশ পায় যে, ধর্ম জিনিসটা বুঝি দুনিয়ার খুব বাজে জিনিসগুলার একটা। এবং এটা খুব বাজে ধারণা। কারণ দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষই ক্রমাগত ধর্মপ্রবণ হয়ে উঠছে’।

আমি সেকুলারিটির নামে ধর্মবিরোধিতার অবস্থানের বিপক্ষে। সেকুলার রাষ্ট্রকে যেটা করতে হবে, তা হল ধর্মকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থানই সেকুলার ধারণার কার্যকারিতা রক্ষা করতে পারে। অন্যদিকে মুসলিমকে বা হিন্দুকে ধর্মবিরোধী সেকুলার না হয়ে ইসলাম বা হিন্দুধর্মের নামেই কিন্তু বৈষম্য বা নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেন। কাজেই সেকুলার মানে ধর্মবিরোধিতা; এমন মুখস্ত অনুসরণ থেকে সরে আসতে হবে

   —রাজিব ভার্গাভা

রাজিবের নিবন্ধে এই মন্তব্যগুলো বেশ ভালোভাবে এসেছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সাথেও বেশ মিলে যায়।

তারপর রাজিব আরো বলেন, ‘এইসব সমস্যার কারণে কিছু লোক সেকুলার বলতে মনে করেন, মাল্টি বা বহু-ধর্ম মতের সহাবস্থান। একটা সেকুলার রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেবে। তাদের অর্থ সাহায্য দেবে। তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে বিকাশের সুযোগ দেবে। কিন্তু এটাও একটা কষ্টকল্পনা। এটা করতে হলে, বলতে হবে ধর্মতে নিঃসন্দেহে শুধু ভাল আর কল্যাণের দিকই রয়েছে। কিন্তু ভালো করে খুঁজে দেখলে দেখা যাবে ধর্মে শাসন ও সংঘাতের অনেক দিকও রয়েছে। তাইলে কেন রাষ্ট্র যেকোন ধর্মকে সমর্থন দেবে?

এটা কিভাবে সম্ভব যে একজন জৈনকে বলব যে, একজন মুসলমানকে সমান সম্মান দেও। যেখানে সে কার প্রতি কিরূপ আচরণ করবে তা সে ধর্ম-আদেশে ঠিক করে নিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের এই হুকমত সে মানবে কেন? এটাতে তো তার মধ্যে আরও সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে। যদিও এটা ঠিক, সমাজে একধরণের সর্বধর্মমতের পাশাপাশি চলার ঐতিহ্য আছে। হিন্দু-মুসলিম সবাই গুরুদুয়ারায় যাচ্ছে। এটা তো ব্যক্তিগতভাবে মানুষ করছে। কিন্তু এটা তো সংঘাত রুখতে পারে না। এটা আশা করা অন্যায় যে মানুষ একই সাথে গভীর ধর্মপরায়ণ হবে আবার নিষ্ঠাবান সেকুলারও হবে’।

প্রচলিত এইসব সেকুলার ধারণার সমস্যা তুলে ধরে রাজিব একটি নতুন ধারণার প্রস্তাব করতে চাইছেন। তিনি মনে করেন, সেকুলারিটির নামে ধর্মবিরোধিতা বা বহুধর্ম নিয়ে চলার যে সমস্যা তা থেকে বের হতে হবে। তিনি প্রস্তাব করেন,

সেকুলারিটির অর্থ এটা হতে পারে– ‘against institutionalised religious domination’. ধর্ম যখন প্রাতিষ্ঠানিক রুপ নিয়ে আধিপত্য চালায় তার বিরোধিতাই সেকুলার চর্চার ধরণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সেখানে কাউকে জোর করা যাবে না, কোন ভাবেই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে মানুষ যা করতে পছন্দ করে না তা করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না। অনেক সময় সমাজে এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়, নিজের ইচ্ছা, পছন্দ বা বিশ্বাসের বাইরে অনেক কিছু করতে বাধ্য করা হয়। ভয়ের কারণে সাধারণ মানুষ এমন আচরণ করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে যে ধরণের হত্যা-সংঘাত দেখা যাচ্ছে তাতে সেকুলার ধারণার গৎবাঁধা পুরানা প্রতিজ্ঞা কোন কাজে আসছে না। রাষ্ট্র যদি ধর্মকে প্রতিষ্ঠান আকারে গড়ে তোলার মদদ দেয়, তখনই এই ধরনের ভায়োলেন্স সামাজিক সম্প্রীতিকে নষ্ট করে সংঘাতকেই উস্কে দেয়। রাষ্ট্র নিজের সুবিধা মতো একটা ধর্মকে মদদ দেয় অন্যদের প্রতি লোক দেখানো মনোভাব কিছু নিয়ম পালন করে। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

তাই রাজিব বলেন, ‘আমি সেকুলারিটির নামে ধর্মবিরোধিতার অবস্থানের বিপক্ষে। সেকুলার রাষ্ট্রকে যেটা করতে হবে, তা হল ধর্মকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থানই সেকুলার ধারণার কার্যকারিতা রক্ষা করতে পারে। অন্যদিকে মুসলিমকে বা হিন্দুকে ধর্মবিরোধী সেকুলার না হয়ে ইসলাম বা হিন্দুধর্মের নামেই কিন্তু বৈষম্য বা নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেন। কাজেই সেকুলার মানে ধর্মবিরোধিতা; এমন মুখস্ত অনুসরণ থেকে সরে আসতে হবে’।

রাজিব এই লেখায় ভারতের সাম্প্রতিক মুসলিম নিপীড়নের কিছু উদাহরণ দেন। একটা দল যখন অন্যদলকে আক্রমণ করবে তখন তো একটা কমিউনিটি আরও বেশি করে নিজেদের ধর্ম পরিচয় নিয়ে সংহত হওয়ার চেষ্টা করবে। কাজেই সেকুলার মানে নিছক ধর্মহীনতা নয়। এবং শেষ করেন এই কথা বলে যে এমন পরিস্থিতে, একজন মানুষ কিভাবে একইসাথে, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান ও ঈমানদার সেকুলার হবে?

রাজিব ভার্গাভার এই প্রস্তবনার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। কিন্তু যে জায়গাগুলোতে প্রশ্ন তুলতে হবে তা সংক্ষেপে বলেই লেখা শেষ করি।

তিনি ধর্মকে প্রতিষ্ঠানিক আধিপত্য তৈরির জায়গা থেকে নিবৃত রাখার যে ধারণাটি দিয়েছেন; তা নতুন কোন ধারণা না। তিনি নিজেও জানেন এবং বলেছেনও। ইউরোপে চার্চের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে ঐতিহ্য থেকে সেকুলার ধারণাটি এ পর্যায়ে এসেছে, তার সাথে রাজিবের প্রস্তাবের হুবহু মিল আছে। ফলে তিন-চারশো বছর আগে যে ধরণের আধিপত্য-বিস্তারকারী ধর্ম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় সেকুলার রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, এতদিন পরে, এই উত্তরাধুনিককালে রাজিবের এই একই ধরনের প্রস্তাব এটাই প্রমাণ করে যে, ‘সেকুলার’ ধারণাটির কোন দার্শনিক বিকাশ আমাদের জ্ঞান-পরিমণ্ডলে ঘটেনি। সেই পুরানা ভাবচক্রে তারা প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে এবং ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা দুনিয়াতেই সেকুলারিজমের সমস্ত অঙ্গীকার মিথ্যা প্রমাণিত হতে চলেছে। তাছাড়া আরো বলা যায়, এই চর্চার মধ্য দিয়ে কি ইউরোপ ‘আদর্শ সেকুলার’ হতে পেরেছে? সেখানে তো সেকুলারিটির নামে একটা খ্রিস্টীয় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য তৈরি হয়েছে।

তিনি ধর্মীয় সহিংসতাকে দুইভাগে দেখতে চেয়েছেন। একদিকে আছে এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের সংঘাত, অপরদিকে খোদ ধর্মের নানা মত ও পথের মধ্যে জারি আছে সহিংস সংঘাত।

কাজেই ভারতীয় বা বাংলাদেশের মতো সমাজে রাজিবের এই প্রস্তাবনার ভবিষ্যত খুব যে পরিষ্কার তা বলা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্র যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে কোন সন্দেহ নাই অবস্থাটা এখনকার চেয়ে একটু হলেও উন্নত হবে। ফলে একটি রাষ্ট্র যখন সেকুলার আদর্শকে ধারণ করতে চাইবে, তাকে এক ধর্মের চেয়ে অন্য ধর্মকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া যাবে না, তেমনি ধর্মের ভেতরেও যেসব ফেরকা রয়েছে, তাদের মধ্যে কাউকে বেশি গুরুত্ব আর কাউকে কম গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটিও বাদ দিতে হবে। এটা না করতে পারলে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাসম্পর্ক তৈরি হবে না, রাষ্ট্রও এক ধর্মের চেয়ে অন্য ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া বা ধর্মের ভেতরের একটি গ্রুপকে প্রাধান্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবে না।

জনাব রাজিবের এই ছোট্ট নিবন্ধটি আসলে অনেক চিন্তার দাবি রাখে। বিশেষ করে চলতি সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এটা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবা দরকার। কিন্তু তিনি সেকুলার ধারণার কার্যকারিতার দিকে লক্ষ্য রেখে যে তৃতীয় বিকল্পটি (against institutionalised religious domination) হাজির করেছেন, সেকুলারিজমের গড়ে উঠবার ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় তাও খুব কাজের কাজ হবে না।

রাজিবের লেখার সবচেয়ে বড় গাফিলতি হল, ধর্মকে নীতি, সংষ্কৃতি বা একাট্টা বিশ্বাস আকারে দেখেছেন। ধর্ম একই সাথে রাজনীতি ও ক্ষমতা চর্চার প্রক্রিয়া হিসেবে যখন হাজির হয়, বিশেষ করে আইন আকারে যখন হাজির হয় এবং বিপুল মানুষ তা মেনে নেয় তখন সেকুলার টেকনিক বা ইন্জিনিয়ারিং আসলেই কতটা কাজে আসতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে প্রখ্যাত চিন্তক আশীষ নন্দী তার সাড়া জাগানো লেখা ‘এন্টি সেকুলার মেনিফেস্টো’-তে ভারতীয় সমাজের এবং সেকুলার ধারণার যে সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছিলেন রাজিব তাও আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। আমলে নিলে অন্তত নতুন করে সেই পুরানা থিসিসই আবার দিতেন না।

তারপরেও লেখককে ধন্যবাদ সেকুলারিজমের মানে যে বস্তাপচা ধারণা আমাদের সমাজে আছে তার বাইরে এসে নতুন কিছুর সম্ভাবনা নিয়ে তিনি ভাবতে উৎসাহী হয়েছেন। এই ভাবনার দরজাই আমাদের সুন্দর এক নতুন দুনিয়ার হদিস দিবে হয়তো।