আগমনেই আশার বার্তা দিয়েছেন এমন ক্রিকেটার কম দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। শুধু যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি তাহলেও লিস্টটা কম লম্বা না। কিন্তু সাকিবের মতন নামের প্রতি সুবিচার করেছেন এমন ক্রিকেটার যেমন আছেন তেমনি আফতাব-আশরাফুলদের মতন প্রতিভার প্রতি অবিচার করা ক্রিকেটারও কম নয়। নিকট অতীতে যার হাতের জাদুতে আশার আলো দেখছিল বাংলাদেশ; তিনি ‘দ্য ফিজ’ মোস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তার পারফরমেন্স একটা প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে, ‘কোথাও কি ভুল হচ্ছে মোস্তাফিজ?’
পাকিস্তানের বিপক্ষে অনেকটা আচমকাই তাকে মাঠে নামিয়ে দেয় টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রথম ম্যাচে প্রতিভার কিছুটা ঝলক দেখা গেলেও অনেকেই ছিলেন সন্দিহান। সেই সন্দেহ বাতিক মনগুলোকে মোহগ্রস্ত করে তুললেন তিনি নিজেই। ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন-আপে আতঙ্ক ছড়িয়ে। সেটির মাত্রা কতটা ছিলো ছোট্ট একটি ঘটনা থেকেই আঁচ করা যায়। ফ্রি-হিট পেয়েও মোস্তাফিজে মোহাচ্ছন্ন ভিরাট কোহলি ব্যাট না চালিয়ে ডিফেন্ড করেছিলেন তার বল। স্বভাবতই সাধারণ সমর্থক থেকে শুরু করে বিশ্ব মিডিয়া ব্যতিবস্ত হয়ে পড়লো মোস্তাফিজ বন্দনায়। ডাক আসলো আইপিএল-টি টোয়েন্টি ব্লাস্ট থেকেও।
আইপিএলে নিজের প্রথম আসরেই বাজিমাত করে মোস্তাফিজ জিতে নিলেন সেরা উদীয়মান তারকার পুরষ্কার। এটা ইতিবাচক অবশ্যই, বাংলাদেশের জন্য আনন্দেরও বটে। কিন্তু এখান থেকেই যেন ঝাঁঝ হারাতে শুরু করলেন ফিজ। পুরো টুর্নামেন্ট যেন শুষে নিয়েছিল তাকে। তারপর সামান্য বিশ্রাম নিয়েই রওনা হলেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। টুর্নামেন্টের মধ্যপথেই ইনজুরির তীব্রতায় দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। তারপর থেকেই কেমন যেন অচেনা লাগছে মোস্তাফিজকে। চেনা সেই ছন্দ, কাটার বা স্লোয়ার সবই কেমন যেন অকেজো।
ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগগুলো আর ক্লাব ক্রিকেটে একটা ফারাক রয়েছে। ক্লাবগুলো যেমন নিজেদের উঠিয়ে আনা খেলোয়াড়দের যত্নের ব্যাপারে সচেতন সেখানে ফ্রাঞ্চাইজি লিগগুলোর ক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা নেহায়েতই পণ্য। যদি সত্য বলা হয়, তাহলে বলা লাগে দাস। হাটে তুলে কেনাবেচা হয়, মূল্য অনুযায়ী চাহিদা থাকে পারফরম্যান্সের। ইতিবাচক দিক যে একদমই নেই, তা না। খেলোয়াড়দের দিক থেকে চিন্তা করলে আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি নিরেট সত্য। একই সাথে একই ড্রেসিংরুমে বিশ্বমাতানো অন্য তারকাদের কাছ থেকে শেখারও বেশ সুযোগ থাকে। বিশ্বব্যাপি পরিচিতি পাওয়া যায় দ্রুতই।
বিষয়টি অনেকটা এমন যে, মনিবের কর্মের বিনিময়ে খাদ্য-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা তো পূরণ হচ্ছে। বিনিময়ে মনিব কী নিচ্ছে? এ প্রশ্নটি অবধারিত ভাবেই আসবে। মোস্তাফিজের কাটার-স্লোয়ারে যে ধাঁধা সেটা এখন অনেকটাই উন্মোচিত। কতটা, সেটি দেখা গিয়েছে আইপিএলে মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচটিতেই। এখন প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ের খুটিনাটি সম্পর্কে জানা যায় খুবই সহজে। যার ফলে, যে যত বেশি বৈচিত্রময় সে তত বেশি টিকে থাকতে পারে। মোস্তাফিজ কি নিজের বৈচিত্র বাড়ানোর জন্য নিজেকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন? এ ধরনের টুর্নামেন্টে যে চাপটা থাকে, সেটি সামলে নিজের খেলা নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। একই সাথে নেটে অপরাপর দলের যারা নিয়মিত মোস্তাফিজের মুখোমুখি হচ্ছেন তাদের কাছে বিষয়টি আরো সহজ হয়ে যাচ্ছে। নেটে ম্যাচের চাপ থাকে না, একবার না একশো বার আউট হলেও সুযোগ থাকে।
আইপিএলের সমালোচনা করার জন্য না, বা মোস্তাফিজের বিদেশে খেলার বিরোধিতা করে লেখা না। তিনি যদি পারেন তাহলে সেটি নিয়ে কারোরই কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু এ ধরনের আসরে গিয়ে যদি নিজ সত্ত্বাই হারিয়ে বসেন তাহলে প্রশ্ন জাগেই। তাই বলতেই হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে না তো মোস্তাফিজ?
অনেক খেলোয়াড়ই অনেক রকমের মেথডে সফল। ইনজুরি ফেরত মোস্তাফিজ ফিরে পাননি তার পুরোনো ছন্দ। এখন বাংলাদেশ জাতীয় দল অলস সময় পার করছে। এসময়টায় বেশ ভালো সুযোগ ছিল নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে বোলিংয়ে আরো বৈচিত্র আনার। সেটির বদলে আইপিএলে যাওয়াটা কতটা ঠিক হয়েছে তার উত্তর সময়ই ভালো দিবে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে সাকিবও আইপিএল খেলছেন এবং জাতীয় দলেও সফল হচ্ছেন। সাকিবের বিষয়টি উদাহারণ না, এক্সেপশন। মোস্তাফিজের প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও তিনি যে সাকিবের ধাতের নন তা তো স্পষ্টই।
এখানে কেউ যদি বোর্ডের করণীয় জিজ্ঞাসা করেন তাহলে ভূল হবে। ফ্রাঞ্চাইজি জামানায় বোর্ডগুলো অনেকটাই অসহায়। কেউ কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকতে না চাইলে তাকে জবরদস্তি করে আটকানো সম্ভব না। এই ঝুঁকির কারণে জানা সত্ত্বেও বোর্ড একজন খেলোয়াড়কে আটকানোর ক্ষেত্রে অসহায়। যেটির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দল। বিশ্ব মাতানো সব তারকা থাকা সত্ত্বেও যাদের বাছাই পর্ব পার হয়ে নিশ্চিত করতে হয়েছে পরবর্তী বিশ্বকাপ যাত্রা। সুতরাং, নিজের বুঝটা খেলোয়াড়কেই বুঝতে হবে। বোর্ড-ক্লাব যেভাবে একজন খেলোয়াড়কে আগলে রাখে তার কিয়দাংশও করে না ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। পারফরমেন্স আছে তো টাকা আছে, নেই তো আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করা হয়।
এ বিষয়টি বোঝার জন্য মোস্তাফিজের অন্য কারো দিকে তাকানোর দরকার নেই। তিনি নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারবেন। যে হায়দ্রাবাদের হয়ে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে ইনজুরি বাঁধালেন, তারা তার পূণর্বাসনে কতটা ভূমিকা রেখেছে? নিজের প্রথম সিজনেই শিরোপা উপহার দেয়া মোস্তাফিজ পরের সিজনে পেলেন মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ। এবার তো হায়দ্রাবাদ দলেই রাখেনি তাকে। সুতরাং, এটা তো খুবই পরিষ্কার যে, ফ্রাঞ্চাইজিগুলো পুরোনো দিনের মনিবের মত; দাসকে ততক্ষণই খাওয়া-পরা দিচ্ছে যতক্ষণ সে কাজে আসছে। কাজে না আসলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে নিদারুণ অবহেলায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন আর আগের অবস্থায় নেই যে বৈশ্বিক আসরে কারো অংশগ্রহণ নতুন নজির রাখবে। বরং এখন নিজের অবস্থানটা নিজের উপলব্ধি করা উচিত। মোস্তাফিজকে মানুষ চিনেছে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে তার পারফরম্যান্স দেখেই। এটাই একজন খেলোয়াড়ের মূল ঠিকানা। মনিবকে খুশি করতে গিয়ে নিজের হাত দুটোই খোয়ালে তার আর মূল্য কী? সহজ এ উপলব্ধিটা এখন একান্ত প্রয়োজন। নতুবা, মোস্তাফিজ শুধু নিজেকেই হারাবেন না, বাংলাদেশও বঞ্চিত হবে অসামান্য এক প্রতিভা থেকে প্রাপ্ত পারফরম্যান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে।
এটি আইপিএলের সমালোচনা করার জন্য না, বা মোস্তাফিজের বিদেশে খেলার বিরোধিতা করে লেখা না। তিনি যদি পারেন তাহলে সেটি নিয়ে কারোরই কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু এ ধরনের আসরে গিয়ে যদি নিজ সত্ত্বাই হারিয়ে বসেন তাহলে প্রশ্ন জাগেই। তাই বলতেই হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে না তো মোস্তাফিজ?
পুরো আসরই পড়ে রয়েছে। প্রথম দিকে দারুণ বল করা মোস্তাফিজ শেষ ম্যাচে যেভাবে বেধড়ক মার খেলেন তারপর মুম্বাই তার ওপর কতটা আস্থা রাখবে সে প্রশ্ন আছে। কারণ, এ টুর্নামেন্টটিতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বঞ্চণার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন হিসাবে মোস্তাফিজের নাম যোগ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু সদ্যই কৈশর পেরোনো এ তারকার মনস্তত্ত্বে এটি বেশ প্রভাব ফেলবে। যার প্রভাব পারফরমেন্সেও পড়তে বাধ্য।
মোস্তাফিজকে শেষ ম্যাচে দেখা গিয়েছে বেশ ক্লান্ত। এমন শরীর নিয়েই মাঠে নামার প্রভাব ম্যাচ শেষেই পেয়েছেন তিনি। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, ব্যাটসম্যান বা স্পিনারদের তুলনায় পেসারদের ক্যারিয়ার কম লম্বা হয়। ইনজুরি সব সময়ই পেসারদের পরম শত্রু। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা পেস বোলিংয়ের ধকল সইবার মত তেমন উপযুক্ত নন। এমন অবস্থায় টানা ম্যাচে উন্নতির বদলে অবিনাশী কিছু ঘটার সম্ভাবনাই থাকে প্রবল। ইনজুরি ফেরত মোস্তাফিজের গতি কতটা কমে এসেছে সেটির দিকে খেয়াল করলেও বিষয়টি বোঝা যায়। এখন বোর্ড বা অন্য কেউ না, মোস্তাফিজের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যে ক্যারিয়ারকে লম্বা করার জন্য টুর্নামেন্ট বাছাই করে খেলবেন নাকি দ্রুত ছুটতে গিয়ে ধুমকেতুর মতো হারিয়ে যাবেন।