এমুহূর্তে কাশ্মিরের আজাদির আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুখ্যত তিন ব্যক্তির হাতে। এই তিন জন হলেন সৈয়দ শাহ গিলানি, ইয়াসিন মালিক এবং মীর ওয়াইজ। এই তিন জনের মধ্যে কাশ্মিরীরা প্রায় সকলেই আবার সৈয়দ গিলানিকে এক ধাপ এগিয়ে রাখেন।
সৈয়দ শাহ গিলানিকে বলা যায় কাশ্মিরের নেলসন মান্দেলা। যদিও সর্বব্যাপক এক গেরিলা জনপদে তাঁকেও এক বয়োবৃদ্ধ গেরিলার মতোই লড়ে যেতে হচ্ছে মাতৃভূমির হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে। শেখ আবদুল্লাহ্’র পর বস্তুত গিলানিই কাশ্মিরের আজাদির আন্দোলনের অহিংস ধারার মূল প্রতীক হয়ে আছেন।
৮৮ বছরের এই চিরতরুণ গত মাসে নিজ দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল যে, আন্দোলনের মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার মাঝেই মুখ্য নেতা জীবিত অবস্থায় নিজ দলে সাংগঠনিক সক্রিয়তা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। গত মাসেই গিলানি জানিয়েছেন, তিনি কাশ্মিরের তেহরিক-ই-হুররিয়াত এর প্রধান হিসেবে থাকছেন না আর এবং নতুন নেতাও তিনিই বাছাই করেছেন– দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফ সেহরাইকে।
তাঁর এই ঘোষণা বহু কারণেই ভারত, পাকিস্তান এবং কাশ্মিরে বিশেষ নজর কেড়েছে। এতদিন ধারণা করা হয়েছিল, গিলানির জ্যেষ্ঠ পুত্র চিকিৎসাবিদ নাঈম গিলানি বা মেয়ে-জামাই আলতাফ আহমেদ শাহ’র হাতে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার দিয়ে যাবেন; কিন্তু কার্যত তা হয়নি।
বলাবাহুল্য, গিলানির এই সরে যাওয়া এবং সে স্থানে আশরাফ সেহরাইয়ের নিযুক্তি দিল্লি থেকেও সবাই গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে। তেহরিক হলো কাশ্মিরী আজাদি জোট হুররিয়াত কনফারেন্সের প্রধান এক সদস্য সংগঠন এবং তেহেরিকের সবচেয়ে ‘হার্ড লাইনার’ নীতিনির্ধারক ছিলেন গিলানি। ফলে গিলানির সাংগঠনিক অবসর দিল্লির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বৈকি।
২০০৪-এ তেহরিক-ই-হুররিয়াত গঠনের পর থেকে গত ১৪ বছর এক নাগাড়ে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে গেলেন গিলানি। যার মধ্যে অন্তত গত আট বছর তিনি গৃহবন্দিই ছিলেন। কিন্তু ভ্যালি জুড়ে তাঁর অসামান্য প্রভাব তাঁকে বহির্বিশ্বেও কাশ্মিরী আজাদির প্রধান নেতায় পরিণত করেছিল।
আশরাফের নিযুক্তি দিল্লির জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক?
সক্রিয় রাজনীতি থেকে গিলানির অবসর ঘোষণার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল তাঁর স্বাস্থ্য। তবে যাঁকে তিনি দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনিও এমুহূর্তে ৭৪ বছর বয়সী। তেহরিকের ‘শুরা’ বলছে, আশরাফের নিযুক্তি ঘটছে সর্বসম্মতভাবে– তবে তিনি আপাতত সাময়িক চেয়ারম্যান হবেন। আগামী বছর দলে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হবে।
ধারণা করার কারণ রয়েছে, এই ‘সাময়িক’ নিযুক্তি দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে। এইরূপ ভাবনার কারণ– তেহরিকে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরই কেবল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ নেয়া হয় এবং সর্বশেষ সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্যই কাজ করেছে গিলানি ও আশরাফের ঘনিষ্ট সম্পর্ক। এছাড়া যেহেতু গিলানি তেহরিক ছেড়ে দিলেও আজাদি আন্দোলনের অন্যতম মূল জোট ‘হুররিয়াত কনফারেন্সে’র একাংশের কার্যক্রমে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকছেন– সেহেতু তিনি নিশ্চিতভাবেই চাইবেন তেহেরিকে তাঁর বাছাইকৃত কেউ-ই নেতৃত্বে থাকুক।
আশরাফ সেহরাই সাধারণত পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করা মানুষ। গিলানির সঙ্গে তাঁর চারিত্রিক পার্থক্য বলতে মুখ্যত এটাই। এটা এক কাকতালিয় ঘটনা যে, ঠিক ১৯৫৯ সালে এই দুই বর্ষীয়ান নেতার রাজনৈতিক পরিচয় হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে এবং ঠিক ৫৯ বছর পর গিলানি কুপওয়ারা জেলায় জন্ম নেয়া আশরাফকে তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করে গেলেন। মাঝে, ১৪ বছর আগে উভয়ে একসঙ্গেই বেরিয়ে এসেছিলেন জামায়াত থেকে।
কাশ্মিরের পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত এমন তিক্ত রূপ নিচ্ছে সেখানে তেহরিকে মধ্যপন্থি কারো নেতৃত্বে অভিষেক হওয়ার সুযোগ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এইরূপ বিবেচনা থেকেই বলা যায়, গিলানির অবসর ভারতের জন্য এমুহূর্তে কোন স্বস্তি বয়ে আনছে না। সেই সুযোগ গিলানি নিজেই রুদ্ধ করে দিয়ে গেলেন। উর্দু ভাষায় আলীগড়ের গ্রাজুয়েট সুবক্তা আশরাফ সেহরাইও গিলানির মতোই ভারতের সঙ্গে দরকষাকরিষর প্রশ্নে দলে একজন ‘আপোষহীন’ হিসেবে চিহ্নিত।
কাশ্মিরী চরমপন্থায় ভারতে দায়
পর্যবেক্ষক মাত্রই জানেন, কাশ্মির প্রশ্নে দিল্লির চলমান একরোখা নীতিকৌশলেরই প্রতিক্রিয়া গিলানিকর্তৃক নতুন নেতা হিসেবে আশরাফ সেহরাইকে অনুমোদন। কাশ্মির প্রশ্নে মধ্যপন্থার সুযোগ যে সাংস্কৃতিকভাবেও কমে যাচ্ছে সেটা দেখা যায় আশরাফ সেহরাইকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরের বিষয়বস্তু থেকেও। আশরাফ সেহরাই আলীগড়ে উর্দু পড়েছেন এটা যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে– তিনি যে কাশ্মিরে হিন্দু পন্ডিত গোপীনাথ কাউলের কাছে ইংরেজিও পড়েছিলেন সেটা খুব কমই মনযোগ পেয়েছে দিল্লির সাংবাদিকদের কাছে এবং এও একেবারেই মনোযোগ পায়নি যে, আশরাফ আজাদির সংগ্রামে আইএস এবং তদ্রুপ ধারার সংগঠনগুলোর ভূমিকার তীব্র বিরোধী।
যদি এ মুহূর্তে মীর ওয়াইজ, ইয়াসিন মালিক এবং গিলানির মাঝে বাছাই করতে বলা হলে দিল্লির নেতৃবৃন্দ মীর ওয়াইজকে পছন্দ করবে এবং গিলানি হবেন তাদের তৃতীয় পছন্দ। এর একটি বড় কারণ হলো গিলনির প্রতি সশস্ত্র সংগঠন হিযবুল মুজাহেদিনের বিশেষ পক্ষপাত। হিযবুল গিলানিকে বরাবরই ‘কায়দে-ই-ইনকিলাব’ (বিপ্লবের নেতা) বলে থাকে। আর ভারত বরাবরই হিযবুলকে মনে করে পাকিস্তানের হাতে তৈরি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে। তবে ভারতের জন্য ভবিষ্যত আরও বিব্রতকর এই জন্য যে, তেহেরিকের নতুন নেতা আশরাফ সেহরাইয়ের পুত্র কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ জুনায়েদ আশরাফ পিতার নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরুর মাত্র পাঁচ দিন পরই হিযবুল মুজাহেদিনে যোগ দিয়েছে– যা কার্যত কাশ্মিরী তরুণদের নিয়মতান্ত্রিক পথে মুক্তির প্রশ্নে গভীর হতাশার এক বড় প্রতীকী বার্তা আকারে হাজির হয়েছে। জুনায়েদের এই ঘটনা একই সঙ্গে আশরাফ ও গিলানিদের মতো অহিংস ধারার রাজনীতিবিদদের জন্যও এক বড় চ্যালেঞ্জ। দিল্লি যতই নিয়মতান্ত্রিক পথে কাশ্মির সমস্যার সমাধানের পথ সংকুচিত করে আনবে ততই জুনায়েদদের সশস্ত্র পথেই আস্থা বাড়বে।