বিশ্বজুড়ে সমাদৃত সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম ফুটবল। আমাদের কাছে ফুটবল মানে প্রিয় দল সবার সেরা, বাকিরা পাগলপারা। পান থেকে চুন খসলে ভালবাসার দলের গুষ্ঠির পিন্ডি চটকে দেই। হাল আমলে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা তর্কে কেটে যায় বেলা, চায়ের আড্ডায় ঝগড়াঝাঁটিতে নিজেদের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সম্ভাব্য সবটাই করি আমরা। কিন্তু আমরা হয়ত কিছুই নই! এমন অনেক ক্লাব আছে যাদের সমর্থকেরা ক্লাবকে ভালবাসে, স্রেফ ক্লাবকে। কয় সিজন ট্রফিলেস, ইউরোপিয়ান টুর্ণামেন্টে পরেরবার খেলতে পারবে কি পারবে না এসব ভাবে না। আবার উল্টো পিঠে সাফল্যের ডানায় চড়ে ভক্তরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। একটি দলের হৃদপিন্ড বলা যায় সমর্থকদের। শিরায় শিরায় তাদের চলাচল। কোন কোন ক্লাব ভক্তদের এমনকি উৎসর্গ করে দেয় দলের ১২ নম্বর জার্সিটিও। এতেই স্পষ্ট হয় উন্মাদ মানুষগুলির অবস্থান। জানবো তেমন দশটি ফুটবল ক্লাবের ফ্যানবেজ সম্পর্কে।
১. বরুশিয়া ডর্টমুন্ড
জার্মানির নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়া শহর। জনসংখ্যা পাঁচ লাখ। সেই শহরের একটি ক্লাব ২০১৩ সালে প্রথমবারের মত উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে। ওয়েলস এর ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ ৪৫ হাজার টিকিট ছাড়ে ফাইনাল উপলক্ষে। জানেন, ওই শহর থেকে কতটি আবেদন জমা পড়েছিল টিকিটের জন্য? সাড়ে চার লাখ!
বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। হলুদ শিবিরের হলুদ রাজ্য। রবার্ট লেভানদস্কি, মারিও গোৎজে, মার্কো রয়েসদের বিশ্ব চিনেছে হলুদ সাফল্যেই। চিনেছে মাখতারিয়ান আবেমেয়াংদের। অখ্যাত ইয়ুর্গেন ক্লপ বিখ্যাতের তকমা সাঁটেন সিগনাল ইদুনা পার্কের ডাগআউট থেকে। শতবর্ষী ফুটবল ক্লাবটির আছে নানা ইতিহাস, সাফল্য ব্যর্থতার গল্প। কখনো বায়ার্ন নামক দৈত্যবধ, সাথে লিগ শ্রেষ্ঠত্বে তৃপ্ত সমর্থকদের হাসি কখনো বা ব্যর্থতায় হতাশ ভক্তকূল। একটি ক্লাব এমনই। সুখ দুঃখ, হাসি কান্না একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এভাবেই এগিয়ে যায় সবকিছু, যুগ যুগান্ত পেরিয়ে মহাকালের পথে। মহাকালের সে পথে ক্লাবের সঙ্গে যারা সদা সর্বদা থাকেন তারা ভক্ত।
সদস্য বা ভক্ত অনুসারীর সংখ্যায় জার্মানির অন্যতম বৃহত্তর ক্রীড়া সংস্থা বা ক্লাবটির নামডাক দুনিয়াময়। ইদুনা পার্কে খেলা চলাকালীন সময়ে একেবারে আনকোরা কোন ব্যক্তি ঢুকে পড়লে সময় নেবেন শুধু এতটুকু বুঝতে- ‘তিনি কি ভুল করে সর্ষে ক্ষেতে এলেন’? গড়ে প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের হলুদ মিলনমেলায় এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। ফুটবলে সেরা ফ্যানবেজের তকমা তাদের গায়ে এমনি এমনি সাঁটেনি। ১০৮ বছরের পুরনো ডর্টমুন্ডের সাফল্যের পেছনের গল্পের অর্ধেকটাজুড়ে নম্র, অতিথিপরায়ণ এবং ক্লাবের জন্য উন্মাতাল শুভাকাঙ্ক্ষীদেরই বসবাস।
২. লিভারপুল
ইস্তাম্বুলের আতার্তুক স্টেডিয়াম, ২০০৫ সাল। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মুখোমুখি মিলান-লিভারপুল। ০-৩ গোলে পিছিয়ে ইংলিশ জায়ান্টরা। গোটা দুনিয়া তখন মিলানের জয়োল্লাস দেখার আশায় মত্ত। তিন গোলে পিছিয়ে থেকে লিভারপুল ট্রফি ছিনিয়ে নেবে এটি পাগলেও বিশ্বাস করার কথা নয়। কিন্তু অলরেড ভক্তরা পাগলের চাইতেও সরেস। দলকে অনবরত অনুপ্রেরণা দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। প্লেয়াররা কতক্ষণ আর চুপ থাকতে পারে? নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষে ৩-৩, পেনাল্টি শ্যুট আউটে মিলানের বাড়া ভাতে ছাই ফেলে ছোঁ মেরে কাপটা ইংল্যান্ডে নিয়ে আসা! চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা কামব্যাক রচিত হয় ওই রাতে। মিলানিজদের হতাশার, অলরেডদের উচ্চাশার।
১৯৯১/৯২ মৌসুমের পর লিভারপুলের হাতে আর কখনোই ওঠেনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের রাজদণ্ড। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন-‘আমি ইউনাইটেডকে লিভারপুলের চাইতে বেশি শিরোপা জেতাব’। ওই সময় ইউনাইটেডের লিগ টাইটেল ৭টি মাত্র, লিভারপুলের সংখ্যা ১৮! তারপর থেকে ১৮তেই বন্দী ক্লাবটি। স্যার ফার্গি কথা রেখেছেন। ইউনাইটেডের শিরোপা কুঁড়িটি!
আপনি সাপোর্ট করবেন এরপর? যাদের কাছে ট্রফি জেতা ছিল পান্তাভাত, তাদের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। লিভারপুল সাপোর্টাররা নুনের অপেক্ষাতেই পান্তা নিয়ে বসে আছেন। ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’। এটি স্রেফ একটি স্লোগান নয়। বিশ্বাস, ভালবাসা, আকাঙখা। যাতে ভর দিয়ে প্রত্যেকটা নতুন মৌসুমে স্বপ্ন আঁকে মার্সিসাইডের ক্লাবটি।
৩. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের ক্লাব ইউনাইটেড। ফুটবলের পরাশক্তি। যুগে যুগে এখানে খেলে গেছেন রথী মহারথীরা। জর্জ বেস্ট কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ওয়েইন রুনি অথবা অ্যালেক্সিস সানচেজ; লালের রাজত্বে ওরা নিজেরা যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, ক্লাবের ইতিহাসও পেয়েছে পরিপূর্ণতা। পরিপূর্ণতায় প্রলেপ দিয়ে ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়েছে ভক্তকূল। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’, কবিতার লাইনটি সবার মনে আছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অনেকাংশে তেমন। তাদের পাঠশালা ফুটবল, ছাত্ররা ভক্ত।
ফুটবলে ইউনাইটেড একটি ব্র্যান্ড। আমাদের বাংলাদেশের অলিগলিতেই ঘুরে আসা যাক। তারুণ্যের গায়ে গায়ে লালরঙা জামা। রিয়াল-বার্সার জার্সির সহজলভ্যতার আগেও যেমন, পরেও ব্যঘাত ঘটেনি তরুণদের গায়ে লাল চাপাতে! রিয়াল-বার্সার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ফ্যান ফলোয়ার সবচাইতে বেশি। অনলাইনের হিসেব কেউ গোনায় না ধরতে চাইলেও ক্ষতি নেই। বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভক্তরা। এশিয়া, আফ্রিকা, নর্থ আমেরিকায়ও লাল শয়তানদের আবেদনে চক্ষু চড়কগাছে লাফ মারে!
৪. বায়ার্ন মিউনিখ
এফসি বায়ার্ন মিউনিখ। জার্মানির মিউনিখ শহরের এই ক্লাব ছোট বড় সব দলের জন্যই আতঙ্করূপ এক নাম। ধারে, ভারে, গুণে যেমন সমৃদ্ধ, এদের রয়েছে রাজসিক এক ভক্তসমাজ। যারা গলা ফাটায়, সম্মুখ সমরে সামনে থেকেই দলের পিঠ চাপড়ে দেয়।
৮০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার অ্যালিয়্যাঞ্জ এরেনায় প্রতি খেলায় গড়ে দর্শক সমাগম সংখ্যা ৭১ হাজার। পরিসংখ্যান বলছে এটি বিশ্বে চতুর্থ, ডর্টমুন্ডের পর জার্মান ভূমিতে দ্বিতীয়। গ্যালারির প্রায় ৯০ শতাংশ ভরপুর থাকে। ফুটবলের অন্যতম সফল এই দলের ভক্ত অনুসারী ছড়ানো এশিয়া থেকে আফ্রিকা, এমনকি আরব সাম্রাজ্যেও! বাভারিয়ানদের মার্কেটিং প্রতিনিধি দল বেশ দক্ষতার সঙ্গেই ক্লাবের বাজার প্রসারিত করেছে ভারত, অারব, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায়।
৫. গালাতাসারে
‘আমি কখনোই এখানকার মত এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি। খেলা শুরুর দুই ঘন্টা আগে আমরা মাঠ পর্যবেক্ষণ করতে যাই, গিয়ে দেখি গ্যালারি ততক্ষণে হাউজফুল’!
কথাগুলি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের তারকা ফুটবলার রায়ান গিগসের, তুরস্কের ক্লাব গালাতাসারের ফ্যানবেজ সম্পর্কে। দুই ঘন্টা আগেই যাদের গ্যালারি কানায় কানায় ভরা থাকে তখন আর প্রশ্ন তোলার দরকার নেই। একটা অনলাইন জরিপও দিচ্ছে অভিন্ন মত, গালাতাসারের ফ্যানবেজ তুরস্কের বিখ্যাত ফ্যানবেজ।
৬. সেল্টিক
স্কটল্যান্ড এর ১৩০ বছর বয়সী ক্লাব সে সেল্টিক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিরোপাজয়ী দল। একবার সেল্টিকের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ শেষে কিংবদন্তি ফুটবলার মেসি বলেন– ‘জীবনে বহু অসাধারণ স্টেডিয়ামে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, কিন্তু কোনটিকেই গ্লাসগোর সাথে তুলনা দেয়া যাবে না’। মেসি বাড়িয়ে বলেননি মোটেও।
সেল্টিক পার্কে দর্শকদের স্থান অনেক উপরে। ক্লাবের সৌভাগ্যের প্রতীক তারা। ভাল সময়ে উল্লাসে মাতেন, ভাগ করেন দুঃখের মূহুর্ত। ভক্তদের ভালবাসার প্রতিদান ক্লাব দিবে না তা কি হয়! স্কটিশ ক্লাব সেল্টিকের দ্বাদশ প্লেয়ার কে বলতে পারেন? ‘ভক্তরা’!
৭. লেক পোজনান
আমাদের কাছে অচেনা ঠেকতে পারে। কিন্তু ক্লাবটি পোল্যান্ড নাগরিকদের বাপ দাদার সম্পত্তি! একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই যখন নির্দিষ্ট কারো সাপোর্টার, তখন একে বাপ দাদার সম্পত্তি বলা ছাড়া আর কী বিশেষণেই বা বিশেষায়িত করা যায়?
পোজনান ক্লাবের ম্যাচ মানেই গ্যালারিতে হাজার চল্লিশেক মানুষের ‘দ্য পোজনান দ্য পোজনান’ চিৎকার। তারা পোল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ফুটবল দল। তারপরো ইউরোপিয়ান মঞ্চে আহামরি কোন অর্জন নেই! অতটুক পর্যন্ত অাসতেও পারেনি তেমন। তাদের কট্টরপন্থি ভক্তকূলের বৈশ্বিক সাফল্য নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। বরঞ্চ ব্যস্ত নিজেদের প্রাণের ক্লাব নিয়ে। লেক পোজনানের ইউটিউবাররা খেটে যান দিনভর, অনলাইন ব্র্যান্ডিং ও ক্লাবের প্রসারের ভাবনায়।