ফুটবল ইতিহাসের সবচাইতে মর্মান্তিক দিন

ফুটবল ইতিহাসের সবচাইতে মর্মান্তিক দিন

খেলার ময়দান এমন জায়গা যেখানে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ থাকে না। সবাই সেখানে সমর্থক, সকলের একমাত্র লক্ষ্য নিজের পছন্দের দলকে সমর্থন জানানো। খেলাপাগল মানুষগুলো অধীর অপেক্ষায় থাকে নিজের পছন্দের দলের খেলার জন্যে। ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন থেকে ফুরসত পেলেই সময় বের করে নেয় প্রিয় দলের খেলা উপভোগ করতে। ধর্ম-বর্ণ ভুলে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গিয়ে জড়ো হয় সমর্থন জানাতে। আর উপলক্ষ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, তখন কোন কথাই নেই। বিভিন্ন দেশের ফুটবলপাগল মানুষের সমর্থনে ফুটবল বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। দুঃখের ব্যাপার হলো, নির্মল আনন্দ লাভ করতে যেয়েও মানুষের জীবনে নেমে আসে দুর্দশা। নিছক দুর্ঘটনা, কিংবা সহিংসতায় বিভিন্ন সময়ে ফুটবল মাঠে নানা কারণে হতাহত হয়েছে হাজারো মানুষ। ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তেমনই এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় ফুটবল বিশ্ব।

★ গোধূলীর প্রথম প্রহর

১৫ই এপ্রিল ১৯৮৯। ব্রিটিশ ফুটবলের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতা এফএ কাপের সেমি-ফাইনালে মুখোমুখী ইংল্যান্ডের দুই বড় দল লিভারপুল ও নটিংহাম ফরেস্ট। সমর্থকদের জন্য আনন্দঘনই হওয়ার কথা ছিল দিনটি। কিন্তু হয়ে যায় লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের জন্য বেদনাতুর এক দিন। এদিন অলরেডদের ৯৬ জন ভক্ত সেমি-ফাইনাল দেখতে এসে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন। লিভারপুলের লাল জার্সি সেদিন আক্ষরিক অর্থেই রঞ্জিত হয় লাল রক্তে! ‘হিলসবোরো ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত ঘটনাটি ব্রিটেনের ফুটবল ইতিহাসের করুণতম ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গ্যালারিতে সমর্থকদের প্রবল চাপ ও ভিড়ে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং আরো ৭৬৬ জন গুরুতর আহত হন। হিলসবোরো স্টেডিয়াম বিপর্যয়কে ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিদারুণ দুঃখজনক ঘটনা হিসাবে ধরা হয়।

★ ঘটনার সূত্রপাত

এফএ কাপ এর নিয়ম অনুযায়ী সেমি-ফাইনাল খেলা নিরপেক্ষ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হত। ১৯৮৯ সালের লিভারপুল বনাম নটিংহাম ফরেস্টের মধ্যকার খেলার জন্য ফুটবল এসোসিয়েশন শেফিল্ড ওয়েডনেসডে ক্লাবের মাঠ হিলসবোরো স্টেডিয়ামকে নির্বাচিত করে। অন্যসব বড় ম্যাচের মতোই দু’দলের বিপুল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই লিভারপুল ভক্তরা দল বেঁধে এগোতে শুরু করেন তাদের জন্য নির্ধারিত লেপিংস লেন স্ট্যান্ডের দিকে। এই স্ট্যান্ডে প্রবেশের একটি মাত্র পথ থাকায় ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকে এবং গেটে প্রচুর চাপ থাকার ফলে তারা বেশ ধীর গতিতে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করছিল। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খায় পুলিশ। এদিকে প্রিয় দলের ম্যাচ দেখতে প্রচুর মানুষ তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে।

সমর্থকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এরইমধ্যে সেন্ট্রাল পেন দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করলে গেটমুখী সমর্থকদের চলাচল এর গতি আরও কমে যায় এবং তারা ঠাসাঠাসি ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। এতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বলা বাহুল্য, লেপিংস লেন স্ট্যান্ড এর দিকে সাতটি ঘুর্ণায়মান প্রবেশ পথ ছিল, যা দিয়ে একে একে ১০ হাজার দর্শক প্রবেশ ও প্রস্থান করতে পারত। সময়ের সাথে সাথে লেপিংস লেন স্ট্যান্ড মুখে অতি মাত্রায় দর্শক জমতে থাকে এবং সবাই খেলা শুরুর আগে মাঠে প্রবেশ করার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় চিফ সুপারিনটেনডেন্ট ‘ডাকেনফিল্ড’ খেলার কর্তৃপক্ষকে আবেদন করেন খেলা শুরু হওয়ার সময় বিলম্বিত করতে। পুলিশ চিফ আবেদন নাকচ করে দিলে সমর্থকদের চাপ কমাতে তিনি একটি এক্সিট গেট খুলে দেওয়ার আদেশ দেন যা স্ট্যান্ডিং বরাবর অবস্থিত।

এক্সিট গেট খুলে দেয়া হলে সমর্থকদের প্রবল জনস্রোত ওই গেটের দিকে ঢলে পড়ে এবং কোন নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা ছাড়াই এগোতে থাকে। বেশির ভাগ দর্শকই স্ট্যান্ডিং বরাবর এগোয়, যা তাদের ৩ ও ৪ নং স্ট্যান্ডে নিয়ে যায় এবং এক্সিট গেট দিয়ে ঢুকায় তারা জানত না ৩ ও ৪ নং স্ট্যান্ড ইতিমধ্যেই দর্শকপূর্ণ হয়ে আছে! ফলে নতুন জনস্রোতের জন্য তিল পরিমাণ জায়গাও ছিল না। ওদিকে সমর্থকেরাও মরিয়া খেলা দেখতে। তাই তারা সামনের দর্শকদের প্রবলভাবে ধাক্কা দিতে লাগল। সামনে জায়গা না থাকায় পেছনের প্রবল চাপে বেষ্টনীর সাথে সেটিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হতে থাকলো সামনে থাকা মানুষগুলো! একপর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ উঠে যেতে চাইলেন উপরের গ্যালারিতে। কিন্ত উপরের গ্যালারিও দর্শকপূর্ণ। অপরদিকে পেছন থেকে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাপ থামার নূন্যতম লক্ষণ নেই। মানুষের এই প্রবল স্রোত সইতে না পেরে একপর্যায়ে ভেঙ্গেই গেল সামনের নিরাপত্তা বেষ্টনী!

★ অবেলার অপরাহ্ন

ম্যাচ ঘড়িতে তখন মাত্র সাত মিনিট! পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ার মতোন একের পর এক রেডস ভক্ত পড়তে শুরু করলেন নিচে। পেছনের মানুষের চাপে ভিড়ের সামনের অংশ দ্রুতই এগিয়ে গেল আরো সামনে। আর মানুষের এই স্রোত পেছন থেকে ধাক্কা দিতে থাকলো লিভারপুলের সমর্থকে ভর্তি গ্যালারির ঐ অংশকে। ফলাফলটা হলো ভয়াবহ। চাপে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হলো অনেকের! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ মাঠে ঢুকে এবং রেফারিকে নির্দেশ দেয় খেলা বন্ধ করতে। খেলোয়াড়দের নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতদের বহন করার জন্য মাঠে অ্যাম্বুলেন্স আসে। এত বিপুল সংখ্যক রোগী দূর্ঘটনাস্থল থেকে অপসারণ করা ভলান্টিয়ারদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সাধারণ সমর্থকেরাও এগিয়ে আসেন। স্ট্রেচারের বদলে তারা বিজ্ঞাপনের বোর্ড ব্যবহার করে এবং দুর্ঘটনাস্থলেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। অধিকাংশ মানুষ আহত হয় ভিড়ের নিচে চাপা পড়ে এবং ঠাসাঠাসি অবস্থায় শ্বাসকষ্টে ভুগে। এত বেষ্টনীতে মানুষ এমনভাবে সেটিয়ে গিয়েছিল যে শ্বাসও নিতে পারছিল না দর্শকরা। পুরো স্ট্যান্ড জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লাল-সাদা স্কার্ফ, লাল-সাদা টুপি আর লাল-সাদা পতাকা।

ধীরে ধীরে আহতদের সঙ্গে স্তিমিত হয় সেদিনের সূর্যও। গোধূলীর বাতাসে ভেসে বেড়ায় লাশের গন্ধ, কানে বাজে অব্যক্ত আর্তনাদ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ৯৫জন দর্শক, আহতের সংখ্যা ঠেকে ৭৬৬ জনে। এছাড়াও ১৪ জনকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। দুর্ঘটনার পর চার বছর কোমায় থেকে আরো একজন মারা গেলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৬তে। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল তরুণ। ৯৬ জনের যারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকেও দীর্ঘদিন ভুগতে হয়েছিল অসহ্য যন্ত্রণায়। আহতদের মধ্যে অনেকেই কোমায় চলে গিয়েছিল বাকি জীবনের জন্যে।

★ মৃত্যু

মৃতদের মধ্যে ৭৮ জনের বয়সই ৩০ এর নিচে, ২০ এর কম ৩৮ জনের! মোট ৮৯ জন পুরুষ, নারী ৭ জন যার মধ্যে ছিল দুই বোনও। স্রেফ দুই বোন নয়, একসঙ্গে দুই ছেলেকে হারিয়ে আর্তনাদে গুমোট হয়েছে ছয় ছয়টি পরিবার। ছিল পিতা-পুত্র, ছিল প্রথমবার পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়া তিন হতভাগ্য জনক। ৯৬ জনের মধ্যে ৯৪ জনের মৃত্যু হয় ঘটনার দিনই। কেউ স্টেডিয়ামেই, কেউ অ্যাম্বুলেন্সে, কেউ বা হাসপাতালে নেবার খানিক বাদে ত্যাগ করেন শেষ নিঃশ্বাস।

মাঠে খেলা দেখতে এসে নির্মমভাবে প্রাণ হারানো ৯৬ জন। Hillsborough Inquests/PA Wire

ঘটনার চারদিন পর, ১৯শে এপ্রিল লাইফ সাপোর্টে থেকেও পরপারে পাড়ি জমান ১৪ বছর বয়সী লি নিকোল। যখন মৃতের যাত্রা থেমে গেছে বলে স্বস্তির শ্বাস নিয়েছে মানুষ, তখন ১৯৯৩ সালের মার্চে শেষ ব্যক্তি হিসেবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন ২২ বছরের তরুণ অ্যান্থোনি ব্ল্যান্ড। মৃতের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ, কাকতালীয়ভাবে দুজনই দুই লিভারপুল তারকার অাত্নীয়। দশবছর বয়সী সর্বকনিষ্ঠ হতভাগা শিশু জন-পল গিলউলি সম্পর্কে সাবেক লিভারপুল অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ডের কাজিন। আর ৬৭ বছরের জেরার্ড ব্যারন তো ছিলেন ১৯৪৪-৪৫ মৌসুমে লালজার্সিতে মাঠে নামা কেভিন ব্যারনের বড়ভাই! হিলসবোরো ট্র্যাজেডির সময় জেরার্ড সবে আট বছরের শিশু। তবে তা নাড়া দিয়েছিল তাকেও! তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা এবং গিলউলির মৃত্যু আমাকে দেশের জন্য কিছু করার তাড়না দেয়। ফুটবলার জেরার্ডের উত্থান তখনই হয়েছিল।’

★ অপয়া হিলসবোরো

হিলসবোরো স্টেডিয়াম, লেপিংস লেন স্ট্যান্ড আর এফএ কাপের সেমি, যেন তেলে আর জলে! কখনো মিশ খায় না। ১৯৮১-১৯৮৯, আশির দশকে টূর্ণামেন্টের মোট পাঁচটি সেমি ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ভেন্যুটিতে। একাশিতে টটেনহাম বনাম উলভারহ্যাম্পটনের ম্যাচ দিয়ে শুরু অপয়া উপাখ্যানের। লেপিংসের ছাদ থেকে পড়ে ৩৮ জন আহত। কারো কনুই, কারো পা, কারো ভাঙ্গে পাঁজরের হাঁড়। তারপর একই মাঠে ‘৮৪ এবং ‘৮৬তে ছোটখাট ভয়ের ভেলকি নাড়া দেয়। ১৯৮৭ সালে তো পরপর দুই ম্যাচেই ভূত চাপে হিলসবোরোর গ্যালারিকে! শেফিল্ড ওয়েডনেসডে-কভেন্ট্রি সিটি, এরপর সেমির মঞ্চে কভেন্ট্রি বনাম লিডস এর খেলায়ও ঘটে অপ্রিয় দূর্ঘটনা। তবে, ৮৯ এর ১৫ই এপ্রিলের কাছে সেসব অতি নগণ্য।

★ তহবিল ও সঙ্গীত

দূর্ঘটনার শিকার হওয়াদের জন্য সরকারের তরফ থেকে ৫ লাখ ডলার দেয়া হয়। লিভারপুল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ, শেফিল্ড ও নটিংহাম ক্ষতিগ্রস্তদের তহবিলে ২৫ হাজার ডলার করে দান করে। তহবিল গঠনের মাত্র একদিনের মাথায় অর্থের অংক ১ মিলিয়ন ছোঁয়! স্কুল, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে যে যার মত করে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে। মোটামুটি এক বছরের মাথায় যখন তহবিলের সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ হয়, ফান্ডে তখন ১২ মিলিয়নের বিশাল অংক জমানো। দূর্ঘটনায় প্রাণ হারানো, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ফিরে আসাদের উৎসর্গ করে ইংরেজ গায়ক গ্যারি ম্যাডিসনের গাওয়া ‘ফেইরি ক্রস দ্য মার্সি’ গানটি সঙ্গীত টপচার্টের শীর্ষে ছিল প্রায় তিন সপ্তাহ। ১৯৮৯ সালেই গাওয়া ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ গানটি এখন মিশে গেছে অলরেড সমর্থকদের রক্তে।

★ অদ্ভুতুড়ে অজুহাত

নিরাপত্তাকর্মীদের কাঁদা ছোড়াছুড়ি ঘটনার আকস্মিকতায় যখন বিশ্ব হতভম্ব তখন নিরাপত্তাকর্মী তথা পুলিশ নিজেদের কাঁধের বোঝা হালকা করতে সব দায় চাপায় সমর্থকদের ওপর। ওইদিনের নিরাপত্তার ভার ছিল ইয়র্কশায়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পুলিশ চীফ সুপারিন্টেনডেন্ট ডাকেনফিল্ড এর ওপর। নিজের ব্যাখ্যায় তিনি চরম একটি মিথ্যা কথা বলেন। তিনি বলেন যে, দর্শকদের তাড়াহুড়ার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, সমর্থকেরা মাতাল অবস্থায় ছিল। শুধু তাই নয় পুলিশ আরো দাবি করে, অলরেড সমর্থকেরা মৃতদেহ এবং পুলিশের ওপর মুত্র বিসর্জন করে, মৃতদেহ থেকে মানিব্যগ এবং মূল্যবান জিনিস চুরি করে নিয়ে যায় এবং উদ্ধারকাজেও পুলিশকে বাঁধা প্রদান করে।

তারা আরো দাবি করে, লেপিংস লেনের দশটা মৃতদেহ থেকে অনেকগুলো মানিব্যাগ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে মার্সিসাইডের ভক্তরা আসলে ভিড়ের সুযোগে পকেটমারে অন্য সমর্থকদের। নিজেদের ব্যর্থতা লুকাতে সকল দোষ চাপায় সমর্থকদের উপর এবং দারি করে উগ্র, মদ্যপ লিভারপুল সমর্থকরাই দুর্ঘটনার কারণ! অথচ যাদেরকে মদ্যপ বলে পুলিশ দাবি করে তাদের মধ্যে অনেক কিশোরও ছিল। মৃতদের মধ্যে দশ বছর বয়সী বাচ্চাও ছিল। তখন হয়ত মৃতের পরিবারের শূন্য ঘরের কোনে বসে অশ্রু বিসর্জন ছাড়া কিছু করার ছিল না।

★ ক্ষমা প্রার্থনা

ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য সান’ সেসময় শিরোনাম করে, ‘দ্যা ট্রুথ’, এবং পুলিশের মিথ্যে জবানবন্দী সকলের কাছে সত্য বলে উপস্থাপন করা হয়। ‘কিছু ভক্ত ক্ষতিগ্রস্থদের পকেটমারে, কিছু ভক্ত সাহসী পুলিশদের ওপর মুত্র বিসর্জন করে, কিছু সমর্থক উদ্ধারকর্মীদের মারধর করে।’ এসব অভিযোগে আস্থা রেখে দ্য সান পত্রিকাটি পুরো দোষ লিভারপুল সমর্থকদের ওপর চাপিয়ে দেয়। যাকে বলে আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া! দ্য সান এর তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন ক্যালভিন ম্যাকেঞ্জি।

এই ন্যাক্যারজনক কাজের জন্য তিনি পরবর্তীতে ক্ষমা চান সমর্থকদের উদ্দেশ্যে। হিলসবোরো দুর্ঘটনার তিক্ত সত্য থেকে কর্তৃপক্ষ নিজের গাঁ বাঁচানোর জন্য সব দোষ লিভারপুল সমর্থকদের ওপর চাপিয়ে দিলেও ঘটনার তেইশ বছর পর আসল সত্য সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়। লিভারপুলের বিশপ জেমস জোনসকে প্রধান করে ‘হিলসবোরো ইন্ডেপেনডেন্ট প্যানেল’ নামে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শেফিল্ড পুলিশের সাহায্য নিয়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ নথিপত্র ঘেটে ৩৯৫ পৃষ্ঠার একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে উক্ত কমিটি। যা লিভারপুল সমর্থকদের ওপর সকল দায়ভার চাপানোর কারণে ফুটবল এসোসিয়েশনের দিকে আঙুল তোলে। যেহেতু তাদের মদ্যপ বলা হয়েছিল তাই ভুক্তভুগিদের রক্তে এলকোহলের উপস্থিতি মাপা হয়। এছাড়া ভুক্তভুগীদের অনেকেই ছিল কিশোর বয়সী তাই বলাই বাহুল্য সমর্থকদের মাতাল হওয়ার যেই দোষ দেয়া হয়েছিল তা মিথ্যা ছাড়া কিছুই না। এছাড়া বিবিসির ভিডিও ফুটেজে দেখা সমর্থকদের উগ্র আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং দেখা যায় তারা উদ্ধার কাজে সাহায্য করেছে। ১৯৮৯ সালের আগস্টে, বিচারপতি টেইলর তখন সমর্থকদের ওপর আনা দায়কে খারিজ করে দেন এবং তিনি ফুটবল এসোসিয়েশনকে দোষারোপ করেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া সত্যেও শেফিল্ডের হিলসবোরোকে ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত করার কারণে।

★ শাপমোচন

তদন্তে আরো দেখা যায় অনভিজ্ঞ পুলিশ চিফ ডাকেনফিল্ডের ভুল সিদ্ধান্তই দুর্ঘটনাকে ত্বরান্বিত করেছিল। এছাড়াও পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা যদি সুষ্ঠভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করত তাহলে কমপক্ষে আরো ৪১ জনের জীবন বাঁচানো যেত। কিন্ত তারপরও কর্তৃপক্ষ তাদের অক্ষমতাকে স্বীকার না করে সমর্থকদের দোষারোপ করে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। তখন অ্যার্টনি জেনারেল ডমিনিক গ্রিভ এই মামলা হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন অবশেষে ২৭ বছর পর ২০১৬ সালে, ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ তদন্তের পর মঙ্গলবার সেই মামলার রায় দেওয়া হয়। নয় সদস্যের জুরিবোর্ড ৭-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলেন, সেদিন ৯৬ জনের মৃত্যু আসলে নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর দায় কর্তৃপক্ষের। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পুলিশের ভুলেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন ম্যাচের কমান্ডিং অফিসারের সিদ্ধান্তের ভুলেই ভেঙে পড়েছিল নিরাপত্তা বেষ্টনী। দায়মুক্ত হয় লিভারপুল সমর্থকদের বিদেহী আত্মা, তাদের পরিবার, দুর্ঘটনায় ভুক্তভুগী সকল সমর্থক এবং সকল লিভারপুল ভক্ত।