তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল?

ইবরাহিম কালিন -এর কলাম

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল?

গত ৭ই এপ্রিল সিরিয়ার দৌমায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে নতুন কোন যুদ্ধের দামামা বাজছে কিনা, সে প্রশ্ন সবার। এটি কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগমন? একে ঘিরে সব পক্ষই বিশাল বিশাল হুমকি-ধামকি দিলেও, আসলে বিষয়টি তেমন নয়। বরং, এই লড়াই কেবল পুরানা স্নায়ুযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজগুলোকেই বারবার সামনে আনছে।

৭ই এপ্রিল আসলেই যে বাশার আল আসাদ সেখানে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার পক্ষে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, কমপক্ষে ৫০০ মানুষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক কেমিক্যালের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সংস্থাটির মতে, সেদিন কমপক্ষে ৭০ জন এই রাসায়নিক হামলায় নিহত হয়েছে। এবং এই মৃতদের সবার শরীরেই বিষাক্ত কেমিক্যালের উপস্থিতি ছিল।

সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার আজকে নতুন না। ২০১৩ সালে এরকম হামলা ঘটার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আসাদকে সাবধান করে দেন। কিন্তু আসাদের এই শাসনকে কোন জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র করেনি, কিংবা রাসায়নিক হামলার মত বর্বর ঘটনা যেন আর না ঘটায় সে বিষয়েও বলা হয়নি। বলা যায়, এটি আসলে ওবামার ব্যর্থতা যার সুযোগে ইরান-রাশিয়া এই লড়াইয়ে ভাগ বসাতে পেরেছে। আসলে ইরান-রাশিয়ার এই লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়েই যেন আসাদ নতুন করে জীবন পেয়েছে। অথচ শুরুর দিকটাতে যদি কৌশলী এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া যেত, তাহলে হয়ত সিরিয়ার এই ক্ষত আরো কমিয়ে আনা যেত, রাসায়নিক হামলাগুলো ঠেকানো যেত।

তবে এই রাসায়নিক হামলাগুলো যেগুলো আসলে যুদ্ধাপরাধ বলেই গণ্য হওয়ার মত, সেসব আসলে পুরো সিরিয়া ট্র্যাজেডির একটা দিক মাত্র। হাজার হাজার প্রাণনাশ এবং লক্ষ লক্ষ ঘরহারার জন্ম দেওয়া এই যুদ্ধ একুশ শতকের সবচেয়ে নিষ্ঠুর যুদ্ধ বলেই গণ্য হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঠিকই বলেছেন, এ যুদ্ধে অস্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার ফলে যে পরিমাণ হতাহত হয়েছে, তার বহুগুণ হতাহত হয়েছে সিরিয়াকে আসাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে এবং দায়েশসহ নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে। সিরিয়া যুদ্ধে সেখানকার বাসিন্দারা এই দুই দানবের কারো হাতেই পড়তে চায় না।

তুরস্কের মত কয়েকটি দেশ ছাড়া কেউই সিরিয়ার মানুষের কথা ভাবছে না। কিন্তু এপ্রিলের ৭ তারিখের রাসায়নিক হামলার পর আসাদের শাসনের ওপর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা বাঞ্ছনীয় ছিল। দরকার হলে এই হামলা ঠেকাতে এবং রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে যেকোন সামরিক পদক্ষেপও নেয়া যেতে পারে। এই হামলা তদন্তে জাতিসংঘে উত্থাপিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তুরস্ক সমর্থন দিয়েছিল। রাসায়নিক অস্ত্র বিলোপ সংগঠন (অপিসিডব্লিও) এর একটি দল দৌমাতে রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা করতে যাচ্ছে। এই দলটিকে কাজ করার পূর্ণ সহায়তা দেওয়া হোক।

তবে ট্রাম্প প্রশাসন এই হামলা বিষয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্দে আছে। আমেরিকা-রাশিয়াকে ঘিরেও রয়েছে উত্তেজনা, কিন্তু তা কখনো বিশ্বযুদ্ধে গড়াবে না। গত চার বছর ধরে, সিরিয়ার এই সংকটকে প্রত্যেকে তার নিজের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের কাজে ব্যবহার করছে। এবং এর কোন পরিবর্তনও চোখে পড়ছে না। কারণ, এদের কারোরই এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামানোর কোন চেষ্টা নেই, আছে শুধু সিরিয়া, ইরাকসহ সেই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করার ইচ্ছা। তাই দায়েশকে রুখ দেওয়ার নামে এই বিশ্বনেতৃত্ব দেওয়া দেশগুলো আসলে নিজেদের প্রভাব এবং শক্তিমত্তাই বিস্তার করছে। এবং এক্ষেত্রে আসাদ এবং তার বন্ধুরাষ্ট্ররাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে, শাস্তি পাচ্ছে সেদেশের জনতা।

আমি এই লড়াইকে স্নায়ুযুদ্ধের অসমাপ্ত লড়াই বলছি কারণ আমরা জানি দুইপক্ষের স্নায়ু যুদ্ধের পর নতুন কোন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে রাশিয়া-চীনের মত অপশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার এই অসাম্যে পুরো বৈশ্বিক ব্যবস্থাতে বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। ফলে শান্তি, স্বাধীনতা এবং উন্নতি ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা ৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের ভুগিয়েছে। প্রথম উপসাগর যুদ্ধ, বসনিয়া-রুয়ান্ডা গণহত্যা, ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র লড়াই, আফ্রিকা-এশিয়া জুড়ে অজস্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ছড়াছড়ি, সন্ত্রাবাদের উত্থান, ধনী-গরবের ব্যবধান এসবই সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার পেট থেকে জন্ম নেওয়া।

রাশিয়া এখনো মনে করে স্নায়ুযুদ্ধে তারা হেরে গেছে; আবার তারা উঠে দাঁড়াবে। ফলে এই লড়াইয়ে সিরিয়া একটা কেবল রণক্ষেত্রে প্রমানিত হয়েছে। তাই, সিরিয়াসহ সকল চলমান যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামীদিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। এছাড়া আমরা কিভাবে শান্তি এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করব, তার উপরও নির্ভর করে।

রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার সুত্র ধরে বলা যায়, আমেরিকা সিরিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে বিমান হামলা করবে, খান শাইখুনের যেমনটা হয়েছিল। তখনও এই হামলার ফলে যেমন ভুল বার্তা গিয়েছে দুনিয়ায়, এবারো সেরকমই হবে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প এই বার্তাও দিলেন, আমি ওবামা নই, সীমার বাহিরে গেলেই হামলার সাহস সে রাখে। উল্টো দিকে রাশিয়া সিরিয়াকে সমর্থন দিয়েই যাবে, উত্তেজনাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে যাতে হামলার মাত্রা অতিরিক্ত না হয়।

এসব কৌশলের সাথে সাথে আমাদের মাথায় রাখতে হবে কারো কাছে যদি বিশাল সক্ষমতার কোন অস্ত্র থাকে, এর মানে এই না যে তার যুদ্ধের কৌশল বেশ উন্নত। ফলে সিরিয়ার এই যুদ্ধ থামাতে আমাদের প্রক্সি যুদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক জবরদস্তি বন্ধ করতে হবে। সিরিয়ায় নৈতিকতা, গণতন্ত্র এবং সবার জন্যে উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আসাদ এবং নানা সশস্ত্র সংগঠন আই এস, আল কায়েদা, ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) এবং পিপলস প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি) এর বিকল্প আমাদের ভাবতে হবে।

 


তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ও বিশেষ পরামর্শক ইব্রাহিম কালিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক। কালিনের এই লেখাটি তুরস্কের ডেইলি সাবাহ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের উপসম্পাদকীয়তে ১৩ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়।