ওয়ান ডে স্ট্যাটাস পেয়ে উজ্জীবিত হিমালয়পুত্ররা

ওয়ান ডে স্ট্যাটাস পেয়ে উজ্জীবিত হিমালয়পুত্ররা

নেপালের নামটা নিতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আকাশ ছুতে চাওয়ার অবাধ্যতা দেখানো অপূর্ব হিমালয়ের কথা। এক হিমালয়কে নিয়ে কত কল্পনা, কত কৌতুহল। শেষ পর্যন্ত তিন অদম্য সাহসী আদমির কল্যাণে হিমালয়ের রহস্যভেদ হলেও আজ অব্দি হিমালয়ের আবেদন, আকর্ষণ কমেনি এতটুকুও। ছবির মতো সুন্দর দেশ নেপাল বিবিধ কারণে বহুবারই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পাতায় উঠে আসলেও খেলার পাতায় কখনো পা পড়েনি সেভাবে। ক্রীড়া জগতের কোনো মাধ্যমেই নেপাল সে অর্থে সমীহা জাগানিয়া কোনো নাম না।

আইসিসির সহযোগী সদস্য এই দেশটি এখন আইসিসির সর্বশেষ ওয়ান ডে স্ট্যাটাস লাভ করা সভ্য। ১৯২০ সালের দিকে লে. জে. মদন সমশের জেবিআর, প্রধাণমন্ত্রী মহারাজা চন্দ্র সমশের জংবাহাদুর রানার কনিষ্ঠ পুত্রের হাত ধরেই নেপালিদের পরিচয় ঘটে ‘জেন্টলম্যান’দের খেলা ক্রিকেটের সাথে। কথিত এই জেন্টলম্যান শব্দটিই খেলার প্রচার এবং প্রসারে বাঁধা হয়ে দাড়ায়। প্রাথমিক পর্যায়ে নেপালের ক্রিকেট সীমাবদ্ধ থাকে ক্ষমতাশীল রানা পরিবার এবং সমাজের সম্ভ্রান্তদের মাঝেই। কতকাল, কত ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে নেপাল আজ নব্য সভ্য একদিবসীয় ক্রিকেটের।

এ পর্যায়ে আসতে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা নেপাল জাতীয় দলের অল-রাউন্ডার সম্পাল কামি’র উঠে আসার গল্পটা শুনলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। নেপালের ঘুমলি জেলার এক দরিদ্র দলিত পরিবারে জন্মান কামি। আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগেই যারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়। ক্রিকেট পাগল কামির পরিবারের সাধ্য ছিলো না তার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সাধ পূরণ করবার। পাঞ্জাবে বেড়ে ওঠা শচীন টেন্ডুলকারের অন্ধভক্ত কামি নিজেই জানান তার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প। তার বাবার মাসিক রোজগার ছিলো ভারতীয় মুদ্রায় ১০ হাজার রুপি, আর একাডেমিতে সার্বিক খরচ পড়তো সাত হাজার রুপি। দশ হাজার রুপিতেই যেখানে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য সেখানে ক্রিকেট একাডেমির অংশ হতে চাওয়াটা এক অলীক বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। কামির পরিবার স্বাভাবিকভাবেই চাইতেন ছেলে পড়াশোনায় মন দিয়ে ভালো একটি চাকরি যোগাড় করে দুর করবে এই কষ্ট।

অদৃষ্ট নাকি অাগে থেকেই লেখা থাকে। প্রয়োজন হয় উসিলার। ক্রিকেটার হবার স্বপ্নে বিভোর খামি একাডেমির মাঠের বদলে মাতাতে লাগলেন পাড়া-মহল্লা। উত্তরোত্তর উন্নতি করা কামির ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, এবং ক্রিকেটকেই জীবনের অংশ করে নেয়ার মনোবাসনা পূরণে সাহায্য করল স্কুল কতৃপক্ষ, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকবৃন্দ এবং স্থানীয় কোচেরা। অথচ সাত বছর আগে যখন ভারত ছেড়ে ক্রিকেট খেলার জন্য নেপালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হন কামি, নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না কাজটি কতটা ঠিক হচ্ছে তা নিয়ে। কিন্তু নেপালে আসার পরেই বদলে যায় দৃশ্যপট। তিনমাস জেলা এবং রাজ্য পর্যায়ে খেলেই কামি ডাক পান অনুর্ধ্ব ১৯ দলে এবং তারপরই জাতীয় দলে।

গতমাসে কামিসহ নেপাল জাতীয় দলকে বহন করা বিমানটি যখন ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করলো ততক্ষণে কামি ইতিহাসের অংশ। তিনি সেই দলের সদস্য যে দলটি অর্জন করেছে একদিবসীয় ক্রিকেট খেলার মর্যাদা। কামিরা কেবল স্বপ্ন পূরণের প্রাথমিক ধাপটা পার করেছেন। নেপালের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর ঠিক কী প্রয়োজন সেটিই জানার চেষ্টা করেছে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম অাল-জাজিরা। যারা মুখোমুখি হয়েছিল নেপাল দলের অধিনায়কসহ সাধারণ জনতার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মতই নেপালের ক্রীড়াঙ্গনও রাজনীতির কষাঘাতে জর্জরিত। ২০১৬ সালে তো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে নেপাল ক্রিকেট বোর্ডকে নিষিদ্ধই করেছিলো আইসিসি। এমন অবস্থা থেকে মনোবল না হারিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য প্রশংসা দাবিই করতে পারেন নেপালের ক্রিকেটাররা।

অধিনায়ক পরেশ খাড়কার মতে নেপালের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে এখন প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উন্নত ঘরোয়া ক্রিকেট। সাথে প্রয়োজন খেলোয়াড়দের যত্ন নেয়া। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন কামি। তিনি বলেন, অধিকাংশ খেলোয়াড়ই জানে না তাদের ভবিষ্যত কি। ক্রিকেট খেলে যা আয় হয় তা দিয়ে ভদ্রস্থ জীবন যাপন কষ্টসাধ্য। প্রায় দশ পনেরো বছর ধরে খেলে অাসা একজন ক্রিকেটার এখনো নিশ্চিত না যে, খেলা ছাড়ার পরে সে ঠিক কি করবে।

বোর্ডের ভূল ভূমিকা যে পুরো সাফল্যটাই নস্যাৎ করে দিতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করেছেন নেপাল ক্রিকেট দলের ভক্ত অরুণ বুধাথোকি। তিনি বলেন এটা আমাদের জন্য অসাধারণ এক অর্জন, কিন্তু পুরোটাই বৃথা হয়ে যাবে যদি ক্রিকেট বোর্ড সঠিক ঘরোয়া অবকাঠামো তৈরি করতে না পারে। ইয়াজেন্দ্রা অধিকারী নামের আরেক ভক্ত বলেন, বহুদিন ধরেই ওয়ান ডে স্ট্যাটাসের স্বপ্ন দেখে আসছে নেপালের সাধারণ ভক্তরা। এখন ক্রিকেট বোর্ডের উচিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বেপারে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে নেপালের ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিশ্চিত করা। এটি নেপালের ক্রিকেটের জন্য হবে নতুন এক যুগ।

নেপালের মানুষ ক্রিকেটকে ভালোবাসে। এবং প্রত্যেকটা ম্যাচেই দর্শক সমাগম হয় দেখার মতো। আইসিসির উচিত নেপালে একটি ক্রিকেট সিরিজের আয়োজন করা। এমনটি মনে করেন অরুণ বুধাথোকি। নেপালের মানুষ যে ক্রিকেটকে আসলে কতটা ভালোবাসে সেটি দেখা গিয়েছে কামিদের বহন করা বিমানটি অবতরনের আগে। যখন, সাধারণ দর্শকরা সরকারে বিপক্ষে ঘরোয়া অবকাঠামো নির্মাণে উদাসীনতার বিপক্ষে স্লোগান দিচ্ছিলো তখনই।

বড় কিছু স্পন্সরের সহায়তায় নেপালে দুটি টি টোয়েন্ট লিগ চালু রয়েছে। যা একই সাথে সাধারণ দর্শকদের মাঠে টেনে আনছে এবং তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছে ক্রিকেটের প্রতি। কিন্তু সমালোচকরা এইটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করেন না। তারা চাচ্ছেন শক্তিশালী অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু এই অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টি এত সহজ হবে বলে মনে হয় না। এক যুগের যুদ্ধের পর যুগব্যাপি রাজনৈতিক অচলাবস্থা নেপালের অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গুই করে দিয়েছে বলা চলে। এমন অবস্থায় বড় অংকের বিনিয়োগ যে কষ্টসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়।

নেপালের ক্রিকেটের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইংগিত দিচ্ছেন ১৭ বছর বয়েসি লেগ স্পিনার সন্দিপ লামিচান্নে। যিনি ইতোমধ্যেই ডাক পেয়েছেন আইপিএল এর দল দিল্লী ডেয়ার ডেভিলসে।

Posted by Nepal Cricket Team on Friday, March 9, 2018

সম্ভাবনা অনেক সময় সত্য হয় না শুধুমাত্র সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে। নেপালের উঠে আসা ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই সুখবর। তবে সেটি যেনো সাময়িক না হয় সে জন্য দরকার সবার সমর্থন, বিশেষ করে আইসিসির।

প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের নামটাও উঠে আসে। গেল দিন আইসিসি ট্রফি জয়ের ২১ বছর পূর্তি হল। অথচ, এখনো ধুকে ধুকে চলছে বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগগুলো। সদ্যই ওয়ান ডে স্ট্যাটাস পাওয়া নেপালের একজন সাধারণ সমর্থকও যেখানে ঘরোয়া অবকাঠামোকে প্রাধাণ্য দেয়ার আকুতি জানাচ্ছেন একুশ বছর পরেও আমরা কেমন যেন আশ্চর্য রকমের নিরুত্তাপ থেকে যাই।