আমির খসরু একাধারে একজন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সূফি ও দার্শনিক। তার আসল নাম আবুল হাসান ইয়ামিন আল-দিন মাহমুদ। জন্ম বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের ইতাহ জেলার পাতিয়ালিতে। পিতার নাম আমির সাইফ-উদ-দীন।
চেঙ্গিস খানের আক্রমণের সময়ে সাইফ-উদ-দীন সমরকন্দের কাছে নিজ শহর কেশ থেকে বলখে চলে যান। তিনি তখন হাজারার শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান সামস-উদ-দিন আলতামাস তাদের দিল্লিতে স্বাগত জানান। গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজপুত রাওয়াত আরজ এর কন্যা বিবি দৌলত নাজ ছিলেন আমির খসরুর মাতা। মাত্র ৭ বছর বয়সে, ১২৬০ সালে তিনি তার পিতাকে হারান, এরপর তিনি তার নানা ইমাদুল মুলকের তত্ত্বাবধানে দিল্লিতে বড় হন।
‘সেতারা’ ও ‘তবলা’র আবিষ্কারক তিনি। মূলত প্রাচীন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ঢোল ও বীণা থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খসরু সেতার ও তবলা সৃষ্টি করেন। সূফিদের গাওয়া ধর্মীয় সঙ্গীত কাওয়ালির জনক তিনি। তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন ‘তোতা-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা পাখি’ হিসাবে।
তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ২০ বছর বয়সের সময়ে তার নানা মারা যান। তিনি তখন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ভাইপো মালিক ছাজ্জুর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। এ সময়ে তিনি তার কবিতা দ্বারা রাজ দরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। সুলতানের পুত্র বুগরা খান তার প্রতিভায় মুগ্ধ হন এবং তার পৃষ্ঠপোষক হন।
১২৭৭ সালে বুগরা খান বাংলার শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হলে তিনি দিল্লিতে আসেন। ১২৭৯ সালে আমির খসরু বাংলায় ঘুরতে আসেন। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে জালাল-উদ্দীন ফিরুজ খিলজি দিল্লির মসনদে আসীন হলে তিনি ‘সেক্রেটারি টু দ্যা কিং’ নিযুক্ত হন। তখন ফিরুজ খিলজি তার নাম দেন ‘আমির খসরু’।
এই দরবারি সুযোগ সুবিধা তার সাহিত্য সাধনার দিগন্ত উন্মুক্ত করে দেয়। তার গজল বিখ্যাত হয়ে ওঠে। প্রতি রাতেই তিনি নতুন নতুন গজল লিখতেন, যা সুলতানের সামনে গাওয়া হতে থাকে।
১২৯৫ সালে আলাউদ্দিন খিলজি ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। আমির খসরু তাকে নিয়ে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘শাহনামে মুন’ রচনা করেন। আলাউদ্দিন খিলজির কাজকর্ম, যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘খাজিনাউল-ফুতুহ’। মাত্র ১৫ দিনে রচনা করেন ৩৩১০ চরণের কাব্যগ্রন্থ ‘মাত্তা-উল-আনোয়ার’। এছাড়াও ৪ হাজার চরণের কাব্যগ্রন্থ ‘শিরিন’ রচনা করেন।
লাইলি-মজনুর বিখ্যাত প্রেম কাহিনি নিয়ে রচনা করেন ‘লাইলি-মজনু’। আলেকজান্ডার দি গ্রেটের বীরত্বগাঁথা নিয়ে রচনা করেন ‘আয়না-ই-সিকান্দারি’। রাজা বাহারাম গৌড়ীকে নিয়ে রচনা করেন ‘হাস্ত বাহিস্ত’।
আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পরে ক্ষমতায় আসীন হন তার পুত্র কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ। তিনি তার সম্মানে রচনা করেন ইতিহাসভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ ‘নাহসি পাহার’। এতে তার কবিতাগুলি নয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেন। তৃতীয় অধ্যায়ে ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতি, পরিবেশ, ঋতু, ফুল-ফল-উদ্ভিদ, প্রতিভা ও অন্যান্য বিষয় তুলে ধরেছেন। এ সময়ে তিনি আরও রচনা করেন পাঁচ খণ্ডের বই ‘ইজাজে খুশরভি’।
এরপর ক্ষমতায় আসেন গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। আমির খসরু তাকে ও তার পরবর্তী তুঘলক শাসকদের নিয়ে রচনা করেন ‘তুঘলকনামা’।
আমির খসরু তার বিপুল কর্মযজ্ঞে আরও যোগ করেন ‘তুহফাতুস সিগর’, ‘কিরানুস-সাদিন’, ‘মিফতাহুল ফুতুহ’, ‘ঘুররাতুল-কামাল’, ‘খামাসা-ই-নিজামি’, ‘দুবলারানী-খিজর খান’ ইত্যাদি।
তিনি লিখেছেন মূলত ফারসি ও হিন্দুস্থানি ভাষায়। তাকে উর্দু ভাষার জনক বলা হয়। পাঞ্জাবী ভাষায় তিনি লিখেছেন যুদ্ধের শোকগাঁথা। ভারত ও পাকিস্তানের অনেক সূফি-দরবেশের আস্তানায় তার গান আজও গাওয়া হয়। বাংলাদেশেও তার কাওয়ালি গাওয়া হয়ে থাকে।
আমির খসরু ছিলেন নিজামুদ্দিন আওলিয়ার শিষ্য। নিজামুদ্দিন আওলিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী হচ্ছে–
আট বছর বয়সের সময়ে আমির খসরুকে তার মা জোর করে নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরবারে নিয়ে যান কিন্তু আমির খসরু তখন মায়ের সাথে দরবারে প্রবেশ না করে গেটের সামনে বসে থাকেন। তিনি মূলত একটি পরিক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। গেটে বসে মনে মনে তিনি একটি কবিতা রচনা করে তা আওড়াচ্ছিলেন। কবিতাটির ভাবানুবাদ হচ্ছে–
‘তুমি সেই রাজা প্রসাদের রাজা
যেখানে কবুতর হয়ে যায় বাজপাখি
গরিব পথচারী এসেছে সে দুয়ারে
সে ঢুকবে না ফিরে যাবে জানাবে তা কি?’
নিজামুদ্দিন আওলিয়া তৎক্ষণাৎ একজনকে গেটে পাঠিয়ে বলেন, গেটে যে বালকটি বসে আছে তাকে নিচের কবিতাটি পড়ে শোনাতে–
‘অহে অস্তিত্ববান মানুষ ভেতরে এসো
তুমি বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে থেকো
বোকা যদি এসে থাকে কেউ
ফিরে সে যাক-তা মনে রেখো’
এ কবিতা শুনে আমির খসরুর মনে হলও, তিনি সঠিক জায়গায় এসেছেন। ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
নিজামুদ্দিন আওলিয়ার প্রতি ছিল তার অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা এতই গভীর ছিল যে, লক্ষণাবতীতে থাকাকালে তিনি তার শায়েখ নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মৃত্যুর সংবাদ শুনে দ্রুত ফিরে আসেন এবং কবরে যেয়ে বিলাপ করতে করতে ধুলোয় গড়াগড়ি করতে থাকেন। শরীরের কাপড় পর্যন্ত ছিড়ে ফেলেন। শোকের তীব্রতায় শায়েখের মৃত্যুর ছয় মাসের মধ্যেই ১৩২৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আমির খসরু উপমহাদেশের প্রচলিত সংগীত ধারার সঙ্গে আরবি-পারসিক সংগীত ধারার সংমিশ্রণ ঘটান। তিনি পারস্য সংগীতে প্রচলিত বারো মোকাম, চব্বিশ শোবা ও আটচল্লিশ গোস্বা– এ দেশের সংগীতে সংমিশ্রণ করে দুটি পৃথক রূপকে একটি রূপের মধ্যে আনেন। আরবি-পারসিক রাগ-রাগিণী যেমন, ইয়ামন, জিলফ, সনম, ঘনম, সাজগিরী, ঘার, সরফর্দ, ফিরুদস্ত, কাফি, বাহার ইত্যাদি এ দেশের সংগীতে পরিচিত করেন। বিভিন্ন তাল যেমন, যৎ, খামসা, সাওয়ারি, কাওয়ালি, ঝুমতাল, জলদ-ত্রিতাল, সুর-ফাক্তা, আড়া-চৌতলা প্রবর্তন করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতে তেলেনা বা তারানা, খেয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কাওয়ালির এই জনক আরও অনেক ধরনের গান জানতেন, যেমন– কলবানা, নকশ, নিগার, গুল, হাওয়া, বাসিত, সুলিহা ইত্যাদি।
কাশ্মির নিয়ে আমির খসরুর বিখ্যাত কবিতার দুটি লাইন–
“আগার ফিরদাউস বার রুয়ে জামিন আস্ত
হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত-ও হামি আস্ত”
‘বেহেশত যদি থেকে থাকে
তবে তা এখানে, এখানেই, এখানেই’
সূফি-সাধকদের রহস্যময়তা হচ্ছে ব্যক্তির গভীর অনুভূতি প্রকাশ। সেই অনুভূতি নিয়ে আমির খসরু লিখেছেন (ভাবানুবাদ):
‘বলতে পারবো না কেমন জায়গা ছিল–
রাতে যেখানে ছিলাম আমি।
চারদিকে সবাই জিকিরে রত–
হৃদপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন ছটফট করছিল
রাতে যেখানে ছিলাম আমি।
কতো নিখুঁত সুন্দর ছিল তাঁদের চেহারা
দৈহিক গঠনও ছিল অপূর্ব অনন্য
মানব মনের জন্য তারা ছিল একটি পরীক্ষা
রাতে যেখানে ছিলাম আমি।
স্বয়ং আল্লাহ ছিলেন সভার সভাপতি
ভেতরে, ঠিকানাহীনে ছিল খসরু
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ছিলেন
সেই সভার আলোক-রশ্মি
রাত্রে যেখানে ছিলাম আমি’।
তার লেখা বিখ্যাত অনেক গান সাম্প্রতিক সময়ের কিংবদন্তিরা গেয়েছেন। যেমন ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খানের কণ্ঠে–
‘আজ রঙ হ্যায় মা রঙ হ্যায় / মোরে মেওহবুব কে ঘর রঙ হ্যায়’
আমির খসরুকে ভারতের প্রথম জাতীয় কবিও বলা যায়। তিনি হিন্দিতেও অনেক কবিতা লিখেছেন। এটাকে তিনি বলতেন ‘হিন্দাবি’। উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে তার অবদান চিরস্মরণীয়।
সূত্র
১. সোহেল ইমাম খান, গজল কথা, ২০১৬
২. দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৭ নভেম্বর ২০১৬
৩. সচলায়তন, ১ জুলাই ২০০৯