বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রীড়া জগত রাজ করছে ক্রিকেট। এর পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও রয়েছে। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে আজকের এই অবস্থানে উঠে আসার পেছনে বোর্ড কর্তা থেকে শুরু করে ক্রিকেটারদের অবদান সমান। মাঝে মধ্যে যে বিতর্কিত কোনো ঘটনা ঘটে না এমন না, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেটি সামাল দেয়ার দক্ষতাও বোর্ড বেশ ভালোমতোই আয়ত্ব করেছে।
অথচ ক্রিকেট না বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। আশির দশকে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা এখনো অনেকেরই চোখে ভাসে। সেখানে থেকে এগিয়ে যাবার বদলে ফুটবল ধাবিত হয়েছে ক্রমাবনতির দিকে। যার ফলে বোর্ড সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন যখন কাতার বিশ্বকার খেলার স্বপ্নের কথা শোনান সেটি বাকিদের কাছে পরিণত হয় পরিহাসের বিষয়ে। তারপরও ফি বছর ফুটলাররা কামিয়ে নেন ৫০-৬০ লক্ষ টাকা। এ পরিমাণ অর্থ পাবার যোগ্যতা, এবং প্রতিনিয়ত পত্রিকার শিরোনামে আসার মতোন কোনো কীর্তি তারা করেছেন কি না সেটি নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। মাঠে যেমনই করুক মাঠের বাইরে বিনোদনের খোরাক যোগানোর জন্য বাফুফে পুরষ্কার দাবি করতেই পারে।
সতেরো মাস আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে থাকার পর লাওসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে মাঠে ফিরেছে বাংলাদেশ ফুটবল দল। সে ম্যাচে ড্র এর পর বোর্ড কর্তাদের হাবেভাবে মনে হয়েছে ড্র না, বাংলাদেশ কাতার বিশ্বকাপ খেলার নিশ্চয়তা পেয়ে গিয়েছে। ক্রিকেট টিম যেখানে ফাইনাল হারেই মুষড়ে পড়ছে সেখানে একটি ড্র এর পর এমন মনোভাবই বলে দেয় ফুটবলের হালত কি। এরপর ঘটলো আরো মজার বিষয়। ম্যাচ শেষেই কোচের সাথে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই জানা গেলো কোচ মহাশয় এ দেশমুখিই হচ্ছেন না আর। এটি অবশ্য নতুন কিছু না। কেউ রাতের আধারে পালায়, তো কেউ দেশে গিয়ে আর ফেরেই না। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবতে বয়েই গেছে বাফুফের।
আরেক অদ্ভুত ফেডারেশন, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। সাধারণ সম্পাদক কে হবে এ দ্বন্দে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে পুরো বছর হারিয়ে যায় কিন্তু যার জন্য এই ফেডারেশন, সেই মাঠে খেলা রাখার দিকে কারোই মনোযোগ নেই। বর্তমান মৌসুমই দেখুন। মূলত হকি ভিত্তিক ক্লাব হবার পরেও ঊষা ক্রীড়াচক্র এবার দলই গড়েনি, দলবদল পেছানোর দাবিতে। অথচ, এই দলবদলের সময় নির্ধারণ হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে, তারিখও জানিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। মোহামেডান যাও এসেছে, সেটিও বহু নাটকের পর।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি ফেডারেশনের চিত্র এটি। যার মধ্যে ক্রিকেট বাদে বাকিরা মাঠের বাইরে থেকে দর্শকদের বিনোদিত করার ব্যাকুল প্রয়াস চালাচ্ছে। ছোট বড় মিলিয়ে বাংলাদেশে ক্রীড়া ফেডারেশনের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এদের মধ্যে অনেকেই অলিম্পিক, কমনওয়েলথসহ বিবিধ বৈশ্বিক আসরে অংশ নিয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য সে অংশগ্রহণ হয় ওয়াইল্ড কার্ড কোটায়। একমাত্র সিদ্দিকুর রহমানের সুবাদে সরাসরি অলিম্পিকও যে খেলা যায় সেটি জেনেছিলাম আমরা।
এবারের কমনওয়েলথ গেমসের হালতটাই দেখুন। দুই বক্সার পুরো প্রস্তুত থাকার পরেও রিংয়েই নামতে পারেননি। কারণ, নিয়মানুযায়ী ইভেন্ট শুরুর আগের দিন টেকনিক্যাল কমিটির সভাতে উপস্থিত থেকে নিশ্চিত করতে হয় দেশের অংশগ্রহণ। অথচ, সে সভাতে বাংলাদেশের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এমন অভিনব ঘটনা কখনো কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না। দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তি যদি নিজের দায়িত্বই না জানেন তাহলে ঠিক কোন যোগ্যতায় তিনি সফর সঙ্গী হয়েছেন সেটি প্রশ্নের দাবি রাখে।
বাকি যে সকল ইভেন্টে কর্তারা অন্তত নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকে খেলোয়াড়দের মাঠে নামিয়েছেন তাদের নাক কাটার বন্দোবস্ত করেছেন খেলোয়াড়রাই। প্রত্যেকের চালান যে হিটেই শেষ তা বোধকরি না বললেও চলে। তারপরেও উল্লেখ্য যে, হিটে একেকজন চালান শেষ করেছেন শেষের দিক থেকে শীর্ষে থেকে। সেরা টাইমিং, অভিজ্ঞতা অর্জন এইসব হাস্যকর বয়ান জাতি শুনে আসছে বহুবছর ধরে। ফলাফল যাই হোক, আখেরে লাভ কর্তাদের। বোর্ডের খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ সর্বদাই সুখকর কি না!
ক্রিকেট বাদে বিশ্ব পরিমন্ডলে যে দুটি খেলা নিয়তই বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে আসছে সেগুলো হচ্ছে শ্যুটিং এবং দাবা। এবারের কমনওয়েলথেও বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত একমাত্র পদকটি এনে দিয়েছেন শ্যুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকী। বাকিদের নৈপুণ্যও অন্যদের তুলনায় ঢের ভালো। এর মধ্যে সামান্যের জন্য পদক হাতছাড়া করে চতুর্থ হয়েছেন জাকিয়া সুলতানা। অথচ, এ খেলাটি কেমন যেনো এক কোনায় পরে থাকে। শ্যুটাররাও সে অর্থে মিডিয়ার আলো থেকে বঞ্চিত। শুধু কমনওয়েলথই না বৈশ্বিক অন্যান্য আসরগুলোতেও লাজ ঢাকার কাজটুকু করেন এই শ্যুটাররাই।
আরো একটি সম্ভাবনাময় খেলা দাবা। একাধিক গ্রান্ডমাস্টার, ফিদে মাস্টার থাকার পরেও দাবার খবরগুলো ছাপা হয় এক কোনে, অবহেলায়। অথচ, সাফল্যের হার বেশ চমৎকারই বলা যায়। এক ফাহাদই যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তাতে তার যে পরিমাণ প্রচার প্রাপ্য তার ছিটেফোটাও তিনি পান না।
ক্রিকেটকে আজকের পর্যায়ে কেউ ধরে এনে বসিয়ে দেয়নি। বোর্ড এবং খেলোয়াড়দের মিলিত প্রচেষ্টায়ই ফুটবলের ছায়া থেকে বেড়িয়ে ক্রিকেট আজ রাজ করছে ক্রীড়াঙ্গন। এ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত শ্যুটিং এবং দাবা ফেডারেশনের। খেলোয়াড়রা তাদের কাজ করলেও বোর্ড সে অর্থে সামনে নিয়ে আসতে পারছে না তাদের সাফল্যগুলো। নতুবা, পচে গলে যাওয়া ফুটবল না; ক্রিকেটের পর তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কথা এ দুটি খেলার। কমনওয়েলথের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে শ্যুটিং ফেডারেশন যদি সঠিকভাবে প্রচারণা চালাতে পারে তাহলে ফুটবল বা রাজনীতিতে জর্জরিত হকি না, খেলার পাতার অনেকটাই দখল করে নিতে পারবে শ্যুটিং। এখন শুধু প্রয়োজন কর্তাদের বোধদয়।
এ বোধটাকি জাগ্রত হবে এ দুই ফেডারেশনের কর্তাদের?