সুবিধা করতে পারছে না পুলিশ ও ছাত্রলীগ

গতি পাচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন

সুবিধা করতে পারছে না পুলিশ ও ছাত্রলীগ

প্রথমশ্রেণীসহ সব ধরনের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্রমে ত্রিমুখী চরিত্র নিচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী অংশ নিলেও সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চাপ রয়েছে ছাত্রলীগের ওপর। ফলে ছাত্রলীগ আন্দোলনের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে। অন্যদিকে পুলিশ ব্যাপক পরিমাণ সাধারণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মুখে তাদের উপর চড়াও হলেও সুবিধা করতে পারছে না। সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ও পুলিশ, এই তিন পক্ষের মধ্যে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগ ও পুলিশকে অসহায় অবস্থায় দেখা গেছে।

সোমবার ভোরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে একটি মিছিল ক্যাম্পাস ঘুরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে পৌছালে সেখানে সাধারণ ছাত্রদের তোপের মুখে পড়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। মিছিলে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে লাঠি, রডসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনসহ প্রায় তিনশ নেতাকর্মী ছিলেন মিছিলটিতে। টেলিভিশনের খবরে দেখা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হুসাইনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী দৌড়ে পালাচ্ছেন। পরে তারা মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেন।

ছাত্রলীগের মারমুখী অবস্থান সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুদফায় মিছিলে অংশ নেন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে মিছিলগুলো ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে দুপুরে আবারও টিএসসিতে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত টিএসসিতেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করেছে। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে অবস্থান করছেন।

অন্যদিকে গত রাতে পুলিশের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকে উপাচার্যকে সরাসরি প্রশ্ন করেন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর কেন গুলি চালানো হল। এ সময় বাসার ভেতরে ভাঙচুর চালানো হয় এবং বাসভবনের সামনে থাকা দুটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

পরে সোমবার সকাল দশটায় নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অবস্থার বর্ণনা দেন উপাচার্য। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে এই হামলার কোন যোগাযোগ নেই, বরং তাকে হত্যা করতেই হামলা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপাচার্যকে টেলিফোন করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীকেও নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কার কথা জানান।

সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়বেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

গতকাল রোববার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে হাজির হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কাটাবন হয়ে শাহবাগে গিয়ে অবস্থান নেন তারা। ফলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে অত্র এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। রাতে শাহবাগ থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। পুলিশি প্রতিরোধের মুখে সে সময় শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে পড়তে বাধ্য হয়। পরে সারা রাতই ঢাবি ক্যাম্পাস এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে। থেকে থেকে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলতে থাকে রাতভর।

মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রতিরোধ ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে এলে আন্দোলন নতুন করে গতি ফিরে পায়। এবং ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করলে অনেকে আহত হন। অনেকে ছাত্রী ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সেফবুকে পোস্ট দিয়েছেন। ছাত্রীদের অভিযোগ, তাদের ওপর বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে হামালা চালানো হয়েছে।

শহীদুল্লাহ হলে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোঁড়া হয়েছে। কতজন নতুন করে আহত হয়েছেন তা জানা যায়নি। তবে এই ঘটনায় শহীদুল্লাহ হলের প্রক্টর ড. মাইনুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিস্ময় নিয়ে পুলিশকে বলেন, “আমার সামনে আমার ছাত্রদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়ছেন? একি করলেন আপনারা?”

সোমবার এই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। জেলায় জেলায় যে যার মতো করে সংগঠিত হচ্ছে । ছড়িয়ে চড়িছে কোটা সংষ্কার আন্দোলন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রেয়ী নেতানারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করেছেন। বহিরাগত ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাধঅরণ ছাত্র ও ছাত্রীদের মারধর করেছেন। কমপক্ষে ১০ জন ছাত্রী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই ঘটনার জের ধরে অনেক আন্দোলনকারী ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ফেসবুকে নিজেদের নতুন অবস্থান জানান দিয়েছেন। এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১৯৭২ সালে কোটা চালু করেছিলেন উপহার হিসেবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে হত্যার পর এই কোটা বাতিল করা হয়। পরবর্তী ২৪ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের এই কোটা দেওয়া হয়নি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আবার কোটা চালু করেন। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু আছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর জেলাওয়ারি কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।