স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারির আদ্যপান্ত

স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারির আদ্যপান্ত

• কেপটাউন টেস্টের ৩য় দিন, টিভি ক্যামেরায় ব্যানক্রফটের বল ট্যাম্পারিং এর দৃশ্য
• ‎আম্পায়ারের  সামনে মিথ্যাচার, অধিনায়ক স্মিথের সহায়তা
• ‎সংবাদ সম্মেলনে স্মিথের ট্যাম্পারিং এর অভিযোগ স্বীকার, লিডারশিপ গ্রপের সিদ্ধান্তেই এটি হয়েছে বলে জানান তিনি
• ‎ম্যাচের মাঝেই স্মিথকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি, ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বগ্রহণ টিম পেইন এর
• ‎সিএ’র ক্ষমা প্রার্থনা ও তদন্ত কমিটি গঠন
• ‎অভিযুক্ত স্মিথ-ওয়ার্নার এবং ব্যানক্রফটকে ১ বছর এবং ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা
• ‎কোচ ড্যারেন লেম্যান এর পদত্যাগ
• ‎দেশে ফিরে তিন জনের আলাদা সংবাদ সম্মেলন, ক্ষমা প্রার্থনা
• ‎শাস্তির মেয়াদ নিয়ে বিভক্ত সাবেক ক্রিকেটার এবং বিশ্লেষকরা
• ‎শাস্তি কমানোর দাবি ক্রিকেটারদের সংগঠনের
• ‎আপিল না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে স্মিথ-ব্যানক্রফটের টুইট

উল্লেখিত বিষয়গুলোর সাথে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত। বহুল সমালোচিত ‘স্যান্ডপেপার স্ক্যান্ডালের’ সংক্ষিপ্ত ঘটনাক্রম এটি। ঘটনার সাথে জড়িত তিনজনের মধ্যে সিংহভাগ সহানুভূতিই যেন বরাদ্দ সদ্য সাবেক অধিনায়ক স্মিথের জন্য। আর কিছুটা ব্যানক্রাফটের। ওয়ার্নারের বেলায় বিষয়টি পুরো বিপরীত। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন পরিষ্কার ভাবেই বলে দিয়েছেন ওয়ার্নারের জন্য তার সামান্য সহানুভুতিও নেই। এত কড়া ভাষায় না হলেও সমালোচনা করেছেন নাসির হুসেইনসহ আরো বড় বেশ কিছু নাম। একই ঘটনায় জড়িত দুজনের বিচারের মানদন্ড দুরকম হয়ে যাচ্ছে কেন দেখা যাক সে বিষয়টি।

স্টিভ স্মিথ

দেশে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন স্মিথ। নিয়েছেন পুরো ঘটনার দায়ভারও। সংবাদ সম্মেলনে তার কান্না ছুয়ে গিয়েছে অনেককেই। স্মিথের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো কিন্তু কম গুরুতর নয়, তারপরও বেশিভাগ ক্রিকেট বোদ্ধার সহানুভুতি তার জন্যই কেন বরাদ্দ হলো প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক। সে প্রশ্নের উত্তর খোজার আগে একটু দেখা যাক স্মিথের অপরাধটা কি সেটি।

• প্রতারাণার বিষয়ে জ্ঞাত থাকার পরেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সম্মতি প্রদান
• ‎আম্পায়ের সাথে মিথ্যাচার
• ‎অস্ট্রেলিয়ান দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা

শেষের অভিযোগটিই স্মিথের সহানুভূতি পাবার মূল কারণ। শুনতে অদ্ভুৎ শোনালেও বিষয়টি সত্য। নাসের হুসেইন থেকে শুরু করে যারাই ‘সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া’ দলটির বিপক্ষে খেলেছেন তাদের অধিকাংশই বলছেন যে, স্মিথ যেটি করেছেন সেটি সাবেক অধিনায়কদের সিলসিলা রক্ষা মাত্র। এ বিষয়টি পরিষ্কার হবার জন্য একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে। সর্বজয়ী দলটির প্রথম অধিনায়ক ছিলেন স্টিভ ওয়াহ, যিনি স্মিথদের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। তার বিপক্ষে মাটি থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে ক্যাচের আবেদনের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। এবং জেতার জন্য সব কিছুই জায়েজ, এই যে মানসিকতা তার শুরুও তার জামানা থেকেই। তার অধিনায়কত্বের সময়ই ক্রিজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান শেরউইন ক্যাম্পবেলকে রান আউট হতে বাধ্য করেছিলেন পেস বোলার জুলিয়ান। এমন শুধু দুটোই না আরো অসংখ্য ঘটনা আছে ওয়াহর অধিনায়কত্বের সময়টায়। তার হাত থেকে নেতৃত্বের ব্যাটন পাওয়া পন্টিং ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাইকেই। তার সময়কালে অস্ট্রেলিয়ান খেলোড়রা কোড অফ কন্ডাক্ট ভেঙ্গেছেন আঠারোবারেরও বেশিবার। যা ওয়াহর পূর্বসুরী মার্ক টেইলরের জামানার দ্বিগুণেরও বেশি। পন্টিংয়ের জামানায় তর্ক শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। একাধিকবার বসচায় জড়িয়েছেন আম্পায়ারদের সাথে। একটি মাত্র উদাহারণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। অ্যাশেজে পাকিস্তানের এক আম্পায়ারের দেয়া কলে অসম্মতি প্রকাশ করে রিভিউ চান পন্টিং। রিভিউতেও আম্পায়ের কল বহাল থাকার বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে মাঠেই আম্পায়ারের সাথে লিপ্ত হন তর্কে। এ ঘটনাটির বর্ণনা তিনি নিজের আত্মজীবনীতেও দিয়েছেন, এবং ক্ষমাও চেয়েছেন। এসব ঘটনা থেকেই স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় কোন সিলসিলায় বহাল রাখতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন স্মিথ। এ ঘটনায় পদত্যাগ করেছেন কোচ ডেরেন লেম্যানও। অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো মূল্যেই জিততে হবে এ মানসিকতা বদলানোর জন্য আর যেই হোক লেম্যান উপযুক্ত ব্যাক্তি নন। তিনি নিজেও মাঠে বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এবং খেলেছেন এ মানসিকতার সূচনা যাদের হাত ধরে তাদের অধীনে। তিনি ট্যাম্পারিংয়ের সাথে জড়িত থাকতে না পারেন, কিন্তু স্মিথদের সঠিক পথ দেখাতে না পারার ব্যর্থতা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না তিনি।

ডেভিড ওয়ার্নার

অজি ক্রিকেটের ব্যাডবয় খ্যাত ওয়ার্নারের সহ-অধিনাকত্ব পাওয়াটাই ছিলো এক আশ্চর্য বিষয়। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়ই বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছেন তিনি। আমলনামায় আছে মাঠের বাইরে বর্তমান ইংলিশ অধিনায়ক জো রুটকে ঘুষি মারার ঘটনাও।

মাঝে কিছুদিনের আচরণে মনে হচ্ছিল শেষ পর্যন্ত বোধয় শুধরেছেন ওয়ার্নার। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত সিরিজের শুরু থেকেই দেখা গিয়েছে পুরোনো সেই ওয়ার্নারকে। প্রথম টেস্টেই চা বিরতির পর ড্রেসিং রুমের সিড়িতে তর্ক জুড়ে দেন আফ্রিকান কিপার ডি ককের সাথে। এরপর আবারো ঝামেলায় জড়ান এক দর্শকের সাথে। সিরিজটা এবং সম্ভবত নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটার শেষ করেছেন ট্যাম্পারিং ঘটনা ঘটিয়ে। সিএর তদন্তানুযায়ী এ ঘটনার মূল পরিরল্পনাকারী ওয়ার্নার। দেশে ফেরার পরে সংবাদ সম্মেলনে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে সমস্ত ঘটনার দায় নিজের কাধে তুলে নিলেও সহানুভূতি পেয়েছেন খুব কম মানুষেরই। সাবেক দুই ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইন এবং মাইকেল ভন তো কঠর ভাষাতেই তিরস্কার করেছেন তাকে। হুসেইন তো ওয়ার্নারের লোভী চরিত্রটাকেই সামনে নিয়ে এসেছেন। তার ভাষ্যমতে ওয়ার্নার পুরো ক্যারিয়ারে প্রত্যেক দলের সাথেই কম-বেশি ঝামেলায় জড়ালেও ভারতের সাথে কখনো কিছু করেননি। এর পেছনের কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন আইপিএল খেলার নিশ্চয়তা, যা থেকে তিনি বেশ ভালো অংকের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। আর মাইকেল ভন স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন ওয়ার্নারের প্রতি সামান্যতম সহানুভুতিও নেই তার। ভন তো ওয়ার্নারের সংবাদ সম্মেলনের ধরণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনটিকে বলেছেন ‘স্ক্রিপ্টেড’। কর্মের ফলাফল এক সময় না এক সময় ভোগ করাই লাগে, এ বাস্তব সত্যটি এখন বেশ ভালো করেই টের পাচ্ছেন ওয়ার্নার। সংবাদ মাধ্যমেও তার সংবাদ সম্মেলনটিকে দেখা হচ্ছে নেতিবাচক চোখে। স্মিথ যেখানে সাবলীলভাবে দোষ স্বীকার করে জওবাব দিয়েছেন সাংবাদিকদের সকল প্রশ্নের সেখানে ওয়ার্নার লিখিত বক্তব্যের বাইরে অধিংকাশ প্রশ্নেই থেকেছেন নিরুত্তর।

ক্যামেরন ব্যামক্রফট

ঘটনাটি ঘটানোর হোতা। মাত্রই আট টেস্ট খেলায় তার সে অর্থে কোনো দাগ ছিলো না। কিন্তু প্রথম হিসাবে যে কাজটি করলেন, এতে আরো একবার মানুষের বিশ্বাস ফিরে পেতে বহু কাটখড় পোহাতে হবে তাকে।

ঘটনা যে সিএর তদন্ত শেষেই থামবে না এমনটা অনুমান করেছিলেন অনেকেই। সে অনুমানকে সঠিক প্রমাণিত করে একের পর ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের অ্যাসোসিয়েশন ক্রিকেটারদেক পাশে দাড়িয়ে বলেছে লঘুপাপে গুরুদন্ড দেয়া হয়েছে তিনজনকেই। আগামী বছরের মে মাসেই বিশ্বকাপ। সেটির কথা উল্লেখ করে তারা বলেছে সিএর তড়িঘড়ি করে তদন্তের কারণে হয়তো সঠিক বিচারটি পাননি তিনজনের কেউই। সিএর উচিত তাদের শাস্তি পুনরায় বিবেচনা করে অন্তত ঘরোয়া লিগ খেলতে দেয়া। সর্বশেষ খবরানুযায়ী আলাদা আলাদা টুইট বার্তায় স্মিথ এবং ব্যানক্রফট আপিল না করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। স্মিথের গায়ে যে কালিমা পড়েছিলো সেটি দুর করার জন্য এখন পর্যন্ত তার নেয়া প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তই তার পক্ষে গিয়েছে। এখন সিএর ভূমিকাটা কেমন হয় সেটিই দেখার বিষয়।