শিশুর হাঁপানি রোগে করণীয়

শিশুর হাঁপানি রোগে করণীয়

অ্যাজমা বা হাঁপানি হলো ইমিউনজনিত শ্বাসনালির এক ধরনের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া। বংশগতভাবে এ রোগে আক্রান্ত শিশু যাদের শ্বাসনালি খুবই সেনসেটিভ, বিভিন্ন উত্তেজক বস্তুর সংস্পর্শে এসে উত্তেজিত হয়ে ফুলে ওঠে। ফলে তাদের শ্বাসনালির ভেতরে কফের নিঃসরণ বেড়ে যায়, শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শুরু হয় লাগাতার কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ ইত্যাদি।

এক হিসাবে দেখা গেছে, ছেলেদের মধ্যে ১০-১৫ ও মেয়ে ৭-১০ শতাংশ এ রোগে ভোগে। জীবনের প্রথম বছরের মধ্যে ৩০ ও ৪-৫ বছর বয়সের মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশ হাঁপানি রোগের প্রকাশ ঘটে। হাঁপানি রোগের সূচনা ও প্রকাশের কারণগুলো বেশ জটিল। বংশগত ধারা ও পরিবেশের নানা উপাদানের সংযোগে রোগের উজ্জীবন ঘটে। শিশুদের বেলায় এ রোগের সংজ্ঞা নিরূপণ করা খুব সহজ নয়। কেননা সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি রোগে ঘন ঘন আক্রান্ত শিশু হাঁপানির মতো লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। কোনো শিশুকে পরীক্ষা করে যদি নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্টজনিত অস্বাভাবিক আওয়াজ যা সব সময় অথবা কিছুদিন পর পর শোনা যায় যার সঙ্গে সচরাচর কাশি থাকে তাহলে সে হাঁপানিতে ভুগছে বলে ধরে নিতে হবে।

হাঁপানি রোগের কারণ : হাঁপানি কোনো সংক্রামক রোগ নয়। সাধারণত বাড়ির আশপাশে যদি কোনো পরিবেশ দূষণকারী কলকারখানা থাকে বা অতিরিক্ত ধোঁয়া, ধুলা, ফুলের রেণু ইত্যাদি থাকে তাহলে শিশুর হাঁপানি হতে পারে। শীতের সময় কুয়াশা, সোয়েটার, লেপ-কম্বলের মাইট বা কাপড়ের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা এ রোগের অন্যতম কারণ।

হাঁপানি রোগ নির্ণয় : হাঁপানি বা অ্যালার্জির পারিবারিক ইতিহাস, শিশু বার বার শ্বাসকষ্টজনিত কষ্টে ভুগছে এবং সাঁ-সাঁ শব্দ শোনা গেলে, সব সময় অথবা বারে বারে কাশি লেগে থাকলে, রাতে শোয়ার সময় বা ভোরের দিকে কাশি বা শ্বাসকষ্টের আওয়াজ ইত্যাদি হলেই।

চিকিৎসা : হাঁপানি রোগের স্থায়ী কোনো প্রতিকার নেই। এমন কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি যা শুরুতেই নির্মূল করে দেয়। এ রোগের আদর্শ চিকিৎসা হলো নেবুলাইজার বা ইনহেলারের মাধ্যমে ব্রংকোডাইলেটর জাতীয় ওষুধের মাধ্যমে শ্বাসকষ্টের উপশম করা। মুখে খাওয়ার থিওফাইলিন বা সালবিউটামল জাতীয় ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। যেহেতু ইনহেল করা ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছায় সেহেতু ওষুধের খুব সামান্য অংশের প্রয়োজন হয় এবং তা তাড়াতাড়ি কাজ করে। অনেকে অজ্ঞানতাবশত ইনহেলার ক্ষতিকর চিকিৎসা মনে করে থাকেন। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। চিকিৎসকরা দু’ধরনের ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। তা হলো প্রশমনকারী বা রিলিভার (সালবিউটামল) ও প্রিভেন্টার কিংবা প্রতিরোধক। প্রিভেন্টার হলো স্টেরয়েড। এর কাজ হলো শ্বাসনালির সংবেদনশীলতা ক্রমেই কমিয়ে আনা। তাই এ ধরনের ওষুধ নিয়মিত নিতে হয়। যদি কোনো অ্যান্টিজেন বা অ্যালার্জেন শ্বাসনালি উত্তেজিত করে, কাশি শুরু হয় বা নিঃশ্বাসের কষ্ট হয় তাহলেই রিলিভার জাতীয় ওষুধগুলো নিতে হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী (রিলিভার ও প্রিভেন্টর) দুটির মাধ্যমেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। প্রিভেন্টার বা প্রতিরোধক প্রথমে দিনে দু’বার করে শুরুর পর যদি ন্যূনতম ৬ মাস রোগমুক্ত থাকা সম্ভব হয় তাহলে চিকিৎসক এ ওষুধের ডোজ কমিয়ে আনেন। এই কম ডোজ একবার করে দিয়ে রোগী যদি দিব্যি ভালো থাকেন তাহলে তা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়া হয়। হাঁপানির সমস্যা যেন কম হয়, এ জন্য মন্টিলুকাস্ট জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শও দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এছাড়া শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত কষ্ট লাঘব করে সে যেন ঘরে ও স্কুলে স্বাভাবিক কার্যকর জীবনযাপন করতে পারে। ফুসফুসে স্বাভাবিক কার্যাদি বজায় রাখা। শ্বাসকষ্ট দূর করতে ওষুধের অতি নির্ভরতা কমানো। শিশু স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ যাতে ঠিক থাকে এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যতটা সম্ভব এড়ানো।

রোগ প্রতিরোধ : হাঁপানি ঘন ঘন দেখা দিলে শিশুর শরীর পরিমিত অক্সিজেন পায় না। এতে দেহের বিভিন্ন কোষের গঠন বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। তা তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি দীর্মেয়াদি হাঁপানির কারণে তার বুকের গড়ন কবুতরের বুকের খাঁচার আকার ধারণ করতে পারে। এ জন্য হাঁপানি প্রতিরোধের ব্যাপারে শিশুর মা-বাবাকে বেশি নজর দিতে হবে। শীতের সময় গরম কাপড় ধুয়ে অথবা রোদে দিয়ে পরতে হবে। অ্যালার্জিক বা উত্তেজক বস্তু, খাবার, ধুলাবালি থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে। নিজের সাবধানতা, তথা স্বাস্থ্য সচেতনতায় শিশু হাঁপানি-জাতীয় কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। এছাড়া হাঁপানিতে আক্রান্ত শিশুর মা-বাবা, অভিভাবক এবং পরিবারের সবাইকে ওই অসুখ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিতে হবে ঠিকমতো যত্ন করতে পারেন।

অন্যদিকে প্রথম থেকেই যদি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় এনে শিশুকে চিকিৎসা করানো হয় তাহলে খুব সুফল পাওয়া যায়। সাধারণ মাত্রার হাঁপানির প্রায় ৭৫ শতাংশ শিশুর ১৪-১৫ বছর বয়সের দিকে ভালো হয়ে যায়। আর মাঝারি মাত্রার হাঁপানি আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ ওই বয়সের কাছাকাছি সময়ে ভালো হয়।