শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই নিজ দেশ পাকিস্তানে ফিরেছেন। প্রায় ছয় বছর আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পর এই প্রথম দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি। দেশে ফিরে আসায় পাকিস্তান সরকারসহ অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অন্যদিকে একটি গোষ্ঠী ‘মালালা বিরোধী দিবস’ও পালন করেছে। এতে বোঝা যায়, তার যেমন অনেক ভক্ত রয়েছেন ঠিক তেমনি অনেক নিন্দুকও রয়েছে।
জিন্স পরার অভিযোগে ২০১৭ সালের অক্টোবর অনলাইনে মালালাকে নিয়ে উপহাস (ট্রোল) করা হয়। এর কিছুদিন আগে পাকিস্তানের এক মন্ত্রী মালালার ওপর হামলার ঘটনাটিকে সাজানো বলে দাবি করেন। তিনি একাডেমিকভাবে ভালো পাকিস্তানের কয়েক তরুণীর তালিকা তৈরি করেন যেখানে মালালাকে রাখেননি। এদিকে ‘সর্বপাকিস্তান বেসরকারি স্কুল ফেডারেশন’-এর প্রধান কাশিফ মির্জা উল্লেখ করেছেন, ‘মালালার ওপর হামলার পর যখন তার আত্মজীবনী প্রকাশ হয় তখন ফেডারেশনভুক্ত প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার বেসরকারি স্কুল ওই বইটি পড়াতে রাজি হয়। কিন্তু এখন তারা এটি বাতিল করতে চাচ্ছেন। এক সময় মালালা ছিলেন শিশুদের কাছে আদর্শের প্রতীক। কিন্তু ওই বই তাকে বিতর্কিত করে ফেলেছে। তিনি এখন পশ্চিমা শক্তির এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছেন।’
পাকিস্তানিদের এ ধরনের মালালা বিরোধী মানসিকতাকে প্রাক-আধুনিক চেতনা হিসেবে দেখেন পশ্চিমারা। মালালা বিরোধী যে কোনো সমালোচনা মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড বলে ধরে নেয়া হয়। এ কারণে বর্তমানে ন্যায়বিচারের জন্য ‘মানবাধিকার’ একটি প্রভাবশালী শব্দে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া মালালা বিরোধী যে কোনো কথাবার্তা নারী অধিকার বিরোধী কথাবার্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবুও এই প্রবন্ধে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে কেন পাকিস্তানিরা মালালাকে পশ্চিমা মিডিয়ার তৈরি মনে করেন, পাকিস্তানিদের এমন ধারণা কি ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসের ফল, নাকি ঈর্ষা অথবা নারী বিদ্বেষী মনোভাব?
মালালা বিরোধী মানসিকতার মধ্যে কাজ করার জন্য তাদের সঙ্গে সূক্ষ্ম সম্পর্ক তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। কেননা পাকিস্তানি ও মুসলমানদের মধ্যে যারা অসহনশীল তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করে আনার কাজটি বেশ কঠিন। এঙ্গোফোন মিডিয়া কালচার (ইংরেজি মিশ্রিত ভাষা প্রয়োগের মিডিয়া কালচার)-এর রাজনীতি মালালা বিরোধীদের মানসিকতা বোঝার জন্য বেশি সহায়তা করবে।
কালচারাল স্টাডিজের পণ্ডিত স্টুয়ার্ড হল মনে বলেছেন, ‘একটি জিনিসের নির্দিষ্ট কোনো অর্থ নেই, প্রকৃত অর্থে সঠিক কোনো মানেও হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়। উপস্থাপনা বা প্রতিনিধিত্ব বলতে বোঝায়, তাদের নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব দিয়ে দেয়া অথবা তারা যদি কোনো বিষয় উপস্থাপন করতে চান তাহলে ওই সুযোগ তাদের দেয়া।’
আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজের পণ্ডিত আলেকজান্ডার উইহিলিই প্রতিনিধিত্বের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ক্ষমতার অসাম্যতার পরিপ্রেক্ষিত উন্মুক্ত করে দেয়া, এর মধ্যে কিছু উপমা কেন অগ্রাধিকার পাবে তা তুলে ধরা, তাদের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক ও মতাদর্শিক স্বার্থটিকে পুনরায় তালিকাভুক্ত করা।’
এঙ্গোফোন মিডিয়া কালচার-এ মালালার প্রতিনিধিত্বকারীরা তার অবদান তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ, তারা স্থানীয় পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। মালালার পক্ষে ওই বক্তব্য পশ্চিমে বেশি জনপ্রিয়। কারণ এটি তাদের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ। তারা দেখিয়েছেন, পাকিস্তানি ও মুসলমানরা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপারে উদাসীন। ইসলামোফোবিয়া, বর্ণবাদ ও ক্ষমতার সঙ্গে উপনিবেশিক সম্পর্কের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মালালাকে ‘ক্ষমতার কন্যা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
অন্যদিকে মালালা নিজেকে এমন এক নারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যিনি পাকিস্তানের প্রচলিত সংস্কৃতির যুক্তি ত্যাগ করেছেন। তিনি এখন পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিকতা প্রতিস্থাপন করতে চান। কেননা নারীদের আত্মনির্ভরশীলতা, নিজস্বতা, স্বাধীনতা ও লৈঙ্গিক সমতার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। অথচ সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় পাকিস্তানি ও মুসলমানদের কাছে তিনি সাহসের প্রতীক হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতায় এর উল্টো হচ্ছে।
মালালার ভাবমূর্তি উত্তমরূপে তুলে ধরা হয় ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা। তার সাহস ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাকে। তিনি সব খারাপের বিরুদ্ধে সফল ব্যক্তি।
টাইম ম্যাগাজিনের ভাষায়– নারীদের জন্য মালালা ‘চ্যাম্পিয়ন’। তাকে মহান করে তোলার জন্য ‘মালালা দিবস’ পালন করা এবং নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করেই বই (আই অ্যাম মালালা : দি গার্ল হু স্টুডআপ ফর এডুকেশন অ্যান্ড ওয়াজ শট বাই দি তালেবান ২০১৩)’ বের করা হয়েছে।
মালালাকে এমন এক ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র মুসলিম নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে যেখানে স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি থেকে তিনি আলাদা। এছাড়া তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, সফলতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। অন্যদিকে তার অবস্থান তৈরি করা হয়েছে স্থানীয় প্রথা ও সংস্কৃতি বিরোধী অনন্য শক্তি হিসেবে।
মুসলমান ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে মালালার ধারণার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তা হলো পাকিস্তানি মুসলিম পুরুষদের সন্ত্রাসী এবং মুসলিম নারীকে ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরে। এছাড়া তিনি মুসলিম অন্য নারীদের থেকে আলাদা। একই সঙ্গে প্রতিবাদী ও ভুক্তভোগী নারী এবং তার অবস্থান শক্তিমান নারী হিসেবে।
মালালাকে এমনভাবে উপস্থাপন করায় ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সমপর্যায়ের মুসলিম অন্য নারীদের থেকে আলাদা করে ফেলেছে। এতে ‘ইসলাম একটি বর্বর ধর্ম এবং পাকিস্তানিরা পিছিয়ে পড়া জাতি’ এ কথাই প্রতিষ্ঠা পায়। তাই পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এখন পাকিস্তানে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ জরুরি ও অপরিহার্য।
এসব বিষয় বাদ দিয়ে ‘আই অ্যাম মালালা’ বইটি পড়লে খুব শক্তিশালী সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, অসংখ্য স্বাধীনচেতা নারীদের সন্ধান এবং অনেক চিন্তাশীল পুরুষদের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই বইটি পশতুন অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জনগণের প্রেক্ষাপটে রচনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের আতিথেয়তা, মুখে মুখে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী কবিতা, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, দয়াপূর্ণ কাজ এবং পাহাড়ি সমাজের সৌন্দর্য ও অনিশ্চয়তার কথা জানা যাবে। এতে ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট ও উদারতা এবং ইসলাম যে শান্তির ধর্ম তা তুলে ধরা হয়েছে।
আই অ্যাম মালালা বইয়ে এমন নারীদের সন্ধান পাওয়া যায় যারা ভুক্তভোগী নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ওই ভুক্তভোগী নারীরা কোনো ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে মালালার মিতা মাইওয়ান্দের মালালা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তার দাদি পুত্রের মুক্তির জন্য স্পাল বান্দির এক নারীর কাছে আপিল করতে পাহাড়ি রাস্তায় একা প্রায় ৪০ মাইল পথ হেঁটে গিয়েছিলেন।
ওই দেশে মুসলিম নারীদের জীবনযাত্রার জটিলতা এবং প্রচলিত ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে কাজ করা বেশ কঠিন। এখানে মানবাধিকার কর্মীরাও শুধু কিছু স্থানীয় আচার-প্রথার বিরেধিতা করে থাকেন। নারীরা সংগঠনের অনুশীলন ও ক্ষমতায়নের স্বাদ লাভ এবং স্থানীয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে আপস করেন আবার কৌশলগত ভূমিকা পালন করেন। মালালার লেখায় দেখা গেছে, পাকিস্তানের নারীরা স্থানীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে এবং দেশীয় ও বৈশ্বিক অনুশীলনের বিরোধিতা করেই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান।
এর বাইরেও বিভিন্ন চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান পুরুষরা সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি তারা স্থানীয় তালেবান প্রভাবিত উগ্রপন্থীদেরও সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মালালার পিতা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই (মানবাধিকার কর্মী), জিহান ইউসুফজাই (জিয়াউদ্দিনের চাচাতো ভাই যিনি মালালার জন্মদিনে উপহার প্রদান করেছেন), আংকেল দাদা (একজন ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক), নাসির পাশা (জিয়াউদ্দিনকে তার কলেজ শিক্ষা সমাপ্ত করতে সহায়তা করেছেন), আকবর খান (জিয়াউদ্দিনের পরামর্শক), উসমান ভাইজান (প্রিয় স্কুল বাসচালক) ও ডক্টর জাভিদ (পাকিস্তানি-ব্রিটিশ ডাক্তার মালালাকে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন)-এর নাম।
ওই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে তালেবানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে ফাজলুল্লাহ, সুফি মোহাম্মাদ ও মুফতিকে। তারা প্রত্যেকেই জিয়াউদ্দিনের স্কুল বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং তারা স্থানীয় নারী-পুরুষ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এরপরও ফাজলুল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ তার সমাজ থেকেই আসে। পশতুনরা তাদের বিরোধিতা করতে প্রবীণদের সমাবেশ ডাকে। প্রথমে যারা ফাজলুল্লাহর উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন তারাও যৌক্তিকতা না পেয়ে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।
মালালা গত কয়েক বছরে ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কর্তৃক সন্ত্রাসবাদী হামলার সমালোচনা ও গাজায় স্কুল সংস্কারের জন্য অর্থ দান করেছেন। এছাড়া আফগানিস্তান ও কাশ্মিরে বোমা হামলার বিরোধিতা করেছেন এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন।
এভাবেই মালালা নিজের মানবিকতার ব্যবহার করেছেন বিশেষত যারা বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ, ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদের স্বীকার হয়েছেন তাদের পক্ষে। এছাড়া স্থানীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে অসাধারণ অনুগ্রহ, দক্ষতা ও জ্ঞানের গভীরতা প্রদর্শন করেছেন। তাই তার যে কোনো সমালোচনা অবশ্যই ব্যক্তি মালালা ও এঙ্গোফোন মিডিয়া কালচারে উপস্থাপিত মালালার মধ্যকার উঠে আসবে।
শেনিলা খোযা-মুলযি’র লেখাটি আলজাজিরার মতামত পাতায় গত ১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়। জবানের পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করে দেয়া হল।