৮১ ভাগ মার্কিন নাগরিক গ্রন্থ প্রণেতা হতে চান

৮১ ভাগ মার্কিন নাগরিক গ্রন্থ প্রণেতা হতে চান

অনেকে মনে মনে আশা রাখেন তিনি হয়তো একসময় একটি বইয়ের লেখক হবেন। গ্রন্থ প্রণেতা হওয়ার গোপন বাসনা অনেকেরই মনের কোনে ঠাঁই নিতে পারে। কিন্তু এই গোপন বাসনা পোষণকারীর সংখ্যা কত হতে পারে? আমাদের দেশের অবস্থা বিবেচনা করলে সংখ্যাটা বেশি হবে না স্বাভাবিক ভাবেই। আমাদের দেশের শিক্ষার হার এখনও অশঙ্কাজনক। কাগজে কলমে সংখ্যাটা যেমনই দেখানো হোক, অর্ধেক জনগোষ্ঠি এখনও শিক্ষার বাইরে। আর শিক্ষার হার নিয়ে যে সরকারি প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাতেও শিক্ষার প্রকৃত হার বুঝে ওঠা মুশকিল।

অন্যদিকে আমাদের শিক্ষা যতটানা জ্ঞানমূখী তার চেয়ে বেশি ভাগ্যমুখী। চাকরী মূখী। ফলে আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতটা ঠিক শিক্ষার হার দিয়ে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। আপনি শুনলে চমকে উঠবেন, ৮১ ভাগ আমেরিকান নাগরিক মনে করেন তারা কখনও না কখনও একটি গ্রন্থের জনক হবেন। গ্রন্থপ্রণেতা হওয়ার এই বাসনা সত্যিই আবাককরা। ছাপা হরফে নিজের নাম দেখবার বাসনা অনেকেরই আছে। তাই বলে এই বিপুল ৮১ ভাগ নাগরিক যখন মনে করেন ছাপা গ্রান্থের মোড়কে তাঁর নিজের নামটি থাকা উচিৎ -এটা সারা দুনিয়াতে অতুলনীয়। অন্যকোন দেশের নাগরিকদের মধ্যে এমন বাসনার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

এই ৮১ ভাগ মার্কিন নাগরিকের গ্রন্থপ্রণেতা হওয়ার বাসনাকে গ্রন্থ বিলাস বলতেই পারেন। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই হাস্যকর নয়। ১ হাজার ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের উপর জেনকিনস গ্রুপের একটি জরিপ থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। মিশিগান ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা জেনকিনস গ্রুপ এই জরিপটি পরিচালনা করেন। এবং এর মধ্যে একটা অংশ মূলত অশিক্ষিতই। তারপরেও তারা মনে করেন তাদের মনের মধ্যে এমন সব আইডিয়া আছে তা গ্রন্থবদ্ধ হলে তারা বেস্ট সেলার লেখকে পরিণত হবেন। অনেকে এইসব আইডিয়া গ্রন্থের মাধ্যমে প্রসবের জন্য খুবই উদগ্রীব।

নিউ ইয়র্কের একজন দ্বাররক্ষী কার্লোসের কথা বলা যায়। সবুজ পোশাক পরিহিত এই দারোয়ান নিজেকে একজন লেখক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তিনি নিজে নিজে তৈরি হওয়া একজন লেখক বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, এই বিশাল বাড়ির গেটে বসে বসে পাহারা দেয়াই আমার একমাত্র কাজ না। এই বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দার নানান সমস্যার সাথে আমাকে মোকাবেলা করতে হয়। এবং এটা করতে করতেই আমি একজন গবেষক হয়ে উঠেছি। এদের নানান খুটিনাটি সমস্যা নিয়ে আমি গবেষণা করি। এভাবেই আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি নিজের লেখকত্ব প্রকাশ করেন। যদিও তার কথা শুনে অনেকের মুখে মুচকি হাসি ভেসে ওঠে।

illustration: Graham Roumieu/Dutch Uncle

জেনকিনসের জরিপে আরও বলা হয়েছে, ৬ মিলিয়ন আমেরিকান নাগরিক পান্ডুলিপি তৈরি করেন। এই বিপুল পান্ডুলিপি থেকে বছরে মাত্র ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হয়। কাজেই এই বিপুল পান্ডুলিপি থেকে যারা লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তাদের সংখ্যাকে খুবই নগণ্য বলতে হবে। যদিও এখন প্রযুক্তির কল্যাণে নিজেই নিজের বই প্রকাশ করা যায়। তারপরেও এই শতাব্দীতে বই প্রকাশের বাণিজ্য এখনও প্রসার লাভ করে চলেছে। লেখকরা এখনও মূলত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মাথায় রেখেই লেখালেখিতে সফল হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে থাকেন। খুব কম সংখ্যক লেখকই সেল্ফপাবলিশিংয়ে আগ্রহী। জেনকিনস এর জরিপে আরও বলা হয়, এর মধ্যে তিনভাগের একভাগ গ্রন্থবিলাসী নাগরিক মনে করেন, তারা সুযোগ পেলে ফিকশন করবেন। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, এই গ্রন্থ প্রণতা হতে চাওয়া বেশির ভাগ লেখকই মনে করেন, তারা নন-ফিকশন লিখবেন। তারা মনে করেন কল্পনা নির্ভর সাহিত্য না লিখে তারা এমন কিছু লিখবেন যা মানুষকে সরাসরি সাহায্য করবে। যেমন, অনুপ্রেরণামূলক সেল্ফ হেল্প নিয়ে বই, নিজের কাজ নিজে করার পদ্ধতি নিয়ে বই, অথবা রান্নার বই।

আর আমরা যদি আমেরিকার বই বাজারের দিকে লক্ষ্য করি দেখব, এই ধরনের বইগুলোই আমেরিকাতে বেস্ট সেলিং তালিকায় থাকে। এগুলোর কাটতি থাকে সবার উপরে।

আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি হওয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে অনেক ধরনের মন্তব্য হতে পারে। কিন্তু এই ট্রাম্প আমলের কথাও যদি ধরি। অনেক গবেষক মনে করেন, যে দেশে মানুষ মনে করে যে কেউ (এমনকি ট্রাম্পের মতো ব্যাক্তি প্রেসিডেন্ট) হতে পারেন। তাহলে সেই দেশের নাগরিকরা তো মনে করতেই পারেন, এমনকি প্রত্যেকে লেখক হতেও পারেন। এটা গণতন্ত্রের যে অতি ফাঁপানো আশাবাদের প্রচারের ফল তাতে কোন সন্দেহ নাই। প্রত্যেক নাগরিক সমান এই জোয়ার জনমনেও এমন একটা মনোভাব তৈরি করেছে যে, সে যা খুশি তাই হতে পারে। এই অতি আত্মবিশ্বাসী মনোভাবই তাদের নিজেদের প্রকৃত যোগ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত আকাঙ্খার দিকে নিয়ে যায়। এই বিপুল সংখ্যাক গ্রন্থ প্রণেতা হওয়ার বাসনার ব্যাপারটিও তাই।

 

সূত্র: শশী থারুর, বুকলেস ইন বাগদাদ, পেঙ্গুইন