লেখক সাহিত্যিকেরা সবসময়ই আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখেন তাদের লেখার মাধ্যমে। তারা এমন চরিত্র সৃষ্টি করেন যা আমাদের মনে যায়গা করে নেয়। আমরা মনে করি এসব বাস্তব। কিন্ত তাদের গড়া চরিত্রগুলা আমাদের যতটা কাছে অবস্থান করে, তারা আমাদের থেকে ততটাই দূরে থাকেন। যেসকল লেখক আমাদের মনে আনন্দের খোরাক যোগান দেন তাদের সম্পর্কে আমরা কমই জানি। আর যখন আমরা জানতে আগ্রহ দেখাই তখনই অনেক চিত্তাকর্ষক খবর বের হয়ে আসে। অনেক সময় সবচেয়ে সৃজনশীল মননই সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পাগলামি করে থাকে। তেমনই কিছু বিষয় আজ আমরা জানব–
আর্থার কোনান ডয়েল পরীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে সাহিত্য জগতের অঘোষিত সম্রাট বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক, ঔপন্যাসিক, অপটোমেট্রিস্ট, অতিপ্রাকৃত এবং আধ্মাতিকতায় বিশ্বাসী। তিনি তার বিখ্যাত শার্লক হোমস চরিত্রের জন্যে অমর হয়ে আছেন।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের কাছে অতিপ্রাকৃত ছিল শুধুমাত্র আগ্রহের থেকেও বেশি কিছু। এক সময় এই আগ্রহ তার মোহ হয়ে পড়ে। তার পুত্র কিংসলে এবং ভাই ইনস এর মৃত্যুর পর তিনি অতিপ্রাকৃতের পেছনে টাকা ঢালতে শুরু করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এভাবে তিনি তার হারানো ছেলে ও ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
১৯২০ সালে ডয়েলের নজরে একটা ফটোগ্রাফ আসে যেখানে দেখা যায় দুই জন কিশোরী নাচে মগ্ন একদল পরীর সাথে। কাকতালীয়ভাবে ডয়েল তখন পরির অস্তিত্ব নিয়েই বই লিখছিলেন যা ১৯২২ সালে প্রকাশ হওয়ার কথা। ওই সময় ডয়েল ছাড়াও আরো অনেকের নজরে ছবিগুলা আসে এবং অনেকেই মেনে নেয় যে এই ছবিগুলা থেকে পরীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। এবং ডয়েলও সমালোচিত হন কারণ কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তিনি এই ছবির সত্যতাকে মেনে নেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে ছবির কিশোরীদের একজন, এলসি জানান, ছবিগুলো আসলে ভুয়া ছিল।
এডগার অ্যালান পো বিয়ে করেন ১৩ বছর বয়সী কিশোরীকে
এডগার অ্যালান পো-কে বলা হয় সেরা ভৌতিক গল্পকারদের মধ্যে একজন। তিনি লেখক হিসেবে যতটা সফল ছিলেন মানুষ হিসেবে ছিলেন ততটাই অভাগা। এক বছর বয়সে তার পিতা তাকে ছেড়ে চলে যান, দুই বছর বয়সে মা মারা যান। পরবর্তীতে তার দত্তক পিতামাতাও তাকে ছেড়ে দেন।
তার অনেক লেখা ছিল সমালোচিত, শত্রুদের জন্যে তার লেখা প্রকাশ করতেও অনেক সময় বেগ পেতে হতো। কিন্ত লেখক তার ভালোবাসার জীবনে সফলতা পান যখন তার ১৩ বছর বয়সী দূর সম্পর্কের বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের ১১ বছরের সুখী দাম্পত্যের ইতি ঘটিয়ে ক্লেম যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে চব্বিশ বছর বয়সে মারা যান।
চার্লস ডিকেন্স অতিপ্রাকৃতে আগ্রহী ছিলেন
চার্লস ডিকেন্সকে গণ্য করা হয় এযাবতকালের সেরা ভিক্টরীয় যুগের লেখক হিসেবে। তার লেখায় সবসময় শ্রেণী ব্যবস্থায় জর্জরিত দরিদ্রের দুর্দশা ফুটে উঠত। এছাড়াও ডিকেন্সের অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল অতিপ্রাকৃত। তার কিছু কাজেও পাওয়া যায় এর প্রমাণ। যেমন, দ্য ক্রিসমাস কেরল উল্লেখযোগ্য; এছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট গল্প রয়েছে।
ডিকেন্সের আরো একটা আগ্রহের জায়গা ছিল সম্মোহন করা। তিনি জন এলিয়টসন এর শো এর নিয়মিত দর্শক ছিলেন। জন এলিয়টসন ছিলেন একজন নামকরা সম্মোহনকারী। এলিয়টসন এর মতামত ছিল সম্মোহনের মাধ্যমে ক্যান্সারের মত রোগ থেকেও নিরাময় পাওয়া যায়। এটা দেখে ডিকেন্সও অনুপ্রেরণা পান। তিনি সম্মোহনের উপর গবেষণা করেন এবং চর্চা করেন তার পরিবার পরিজনদের ওপর। ডিকেন্স ১৮৪৪ সালে সম্মোহনের মাধ্যমে অগুস্টা ডে-লা-রু এর দুশ্চিন্তা দূর করেন এবং বিভিন্ন সময় তার স্ত্রীর ওপর সম্মোহনের চর্চা করে বিভিন্ন সমস্যা দূর করেন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন বুলফাইটিং-এ দক্ষ
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরেণ্য লেখক। তাকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর সেরা সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন মদ্যপানের জন্যে বিখ্যাত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ছিলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক, মাছ ধরায়ও ছিলেন অভিজ্ঞ; একবার ৫৩০ কেজি মারলিন মাছ শিকার করেন হেমিংওয়ে।
এইসবকিছুর বাইরেও হেমিংওয়ের আগ্রহ ছিল বুলফাইটিং বা ষাঁড়ের লড়াইয়ে। সে তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই বুলফাইট দেখতে যেতেন এবং একসময় বুলফাইটারদের সাথে তার আন্তরিকতা এবং ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। তিনি বুলফাইটিংয়ে তালিম নেন এবং অপেশাদার প্রতিযোগিতায় অংশও নেন কয়েকবার। পরবর্তীতে তার লেখায় বুকফাইটিং এর প্রতিফলন পাওয়া যায়; যেমন : দ্য সান অলসো রাইজেস।
উইলিয়াম বুরোর হাতে নিহত হন তার স্ত্রী
উইলিয়াম বুরো ছিল তার সময়ের বিতর্কিত লেখকদের একজন। তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন উপন্যাস ‘ন্যাকেড লাঞ্চ’ এর জন্যে, যা ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কয়েকবার নিষিদ্ধ হয়।
বুরো ছিলেন তীব্র মাত্রায় মাদকাসক্ত। স্ত্রী পুত্র থাকতেও তিনি স্বঘোষিত সমকামী ছিলেন। তার মানসিক অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ছিল অনেকের। কিন্ত তার সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ছিল যখন তার ২৮ বছর বয়সী স্ত্রী তার হাতে নিহত হন। যদিও তার স্ত্রী জোয়ান ভলমার এর উপর সহিংসতার কোনো অতীত প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তারপরেও ১৯৫১ সালের এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আজব একটা খেলায় মেতে ওঠেন বুরো। মাতাল অবস্থায় তিনি তার স্ত্রীকে গুলি করেন। বুরোর কথামতে জোয়ান ভোলমার, তার স্ত্রী, তিন মিটার দূরে মাথায় গ্লাস রেখে দাঁড়ায় এবং বুরো গ্লাস লক্ষ করে গুলি চালায়। তখন গুলি গ্লাসে আঘাত না করে তার স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে।
বুরো পরবর্তীতে দাবি করেন, এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল কারণ বুরোর গুলি চালানোর কথা ছিল না এবং তার বন্ধুদের মতে দুর্ঘটনাবশত বন্দুক চালিয়ে ফেলেন তিনি। বুরো বলেন এই ঘটনা তার লেখালখির সফলতাকে আরো ত্বরান্বিত করে।
শিশু সাহিত্যিক এনিড ব্লাইটন শিশুদের অপছন্দ করতেন
এনিড ব্লাইটন ছিলেন তার সময়ের জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল শিশু সাহিত্যিক। সে তার জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার বই প্রকাশ করেন, যার মধ্যে অনেকগুলো এখনো শিশুদের জন্যে ধ্রুপদী বই হিসেবে পরিচিত। ব্লাইটনের অনেক ভক্তকূল থাকলেও তিনি সমালোচিত ছিলেন শিশুদের থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং নিজের সন্তানদের ওপর কৃত অত্যাচারের কারণে।
ব্লাইটনের প্রতিবেশীদের মতে, ব্লাইটন প্রায়ই প্রতিবেশী বাচ্চাদের ওপর রাগ করে চিৎকার চেচামেচি করতেন। বিধবা ব্লাইটন তার সন্তানদের বাবার সাথে দেখা করতে অনুমতি দিতেন না এবং তার কন্যাদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করতেন যার প্রমাণ ছিল তার কন্যা ইমোগেনের জীবনীগ্রন্থে।
চিরকুমার লুইস ক্যারল কিশোরীদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন
লুইস ক্যারল ছিলেন বিখ্যাত কবি এবং গল্পকার। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ছিল এলাইসের অভিযান, যেখানে একজন কিশোরী মেয়ে আয়নার মধ্য দিয়ে জাদুর শহরে গমণ করে। এই সিরিজের দুইটা বই ছিল। তিনি এই গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত হন একই নামের তিন বছর বয়সী কিশোরীর মাধ্যমে।
ধ্রুপদী ভিক্টরীয় এবং শিশু সাহিত্যিক ক্যারলের লেখা থেকে তার ব্যাক্তিগত জীবনকে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও কখনো শারীরিক অপব্যবহারের কথা জানা যায়নি কিন্ত অনেকের মতে বাচ্চাদের প্রতি ক্যারলের অসংগত দূর্বলতা ছিল; বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের প্রতি। ক্যারলের ঘরে অসংখ্য কিশোরীর উলঙ্গ ছবি ছিল।
ক্যারল সবসময়ই প্রাপ্ত বয়ষ্কদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেন এবং বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করতেন; বিশেষ করে মেয়েদের। এছাড়া ক্যারল চিরকুমার ছিলেন বলে সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এলাইস এর এগারো বছর বয়সে ক্যারল তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব জানায় কিন্ত এলাইসের পরিবার নাকচ করে দেয়।
স্টিফেন কিং এর ১৩ সংখ্যার নিয়ে কুসংস্কার
স্টিফেন কিং সমসাময়িক ভৌতিক গল্প লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, বিখ্যাত এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল। শাইনিং (১৯৭৭), কুজো (১৯৮১), পেট সেমেটারি (১৯৮৩), আইটি (১৯৮৬) এবং মাইজেরি (১৯৮৭) এর মত বিখ্যাত ভৌতিক গল্পের নির্মাতাকে বলা যেতে পারে এই ঘরানার গডফাদার। তার গল্প উপন্যাস পড়ে মনে হতে পারে তিনি সকল ভয়-ভীতিকে জয় করে ফেলেছেন কিন্ত তিনিও আসলে ভয় পান। ধ্রুপদী এই লেখক ১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানান তিনি ১৩ সংখ্যাকে ভয় পান।
১৩ সংখ্যা নিয়ে ভয়কে ‘ট্রিসকাইডেফোবিয়া’ বলা হয় এবং এটা কোনো হেসে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় না। এই ১৩ সংখ্যার ভয় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় পরিণত হতে পারে এবং স্টিফেন কিং এর মত আমেরিকার প্রায় দশ শতাংশ মানুষ তেরো সংখ্যার ভয়ে আক্রান্ত।
স্টিফেন কিং সবসময় ১৩তম সিড়ি লাফ দিয়ে পার হন। এছাড়া কিং কখনো কোনো বইয়ের ৯৪, ১৯৩ এবং ৩৮২ নাম্বার পৃষ্ঠায় পড়া থামান না কারণ এই সংখ্যাগুলোর যোগফল হয় তেরো। কিন্ত কিং এর জন্যে সুখের খবর হল বেশিরভাগ আবাসিক হোটেলে ১৩তম ফ্লোর থাকে না। এমনকি অনেক বিমানে ১৩তম আসনও থাকে না।