আমাদের দেশের মতই সাহরির অনুষ্ঠান। সাহরি খেতে খেতে অনেকেই চ্যানেল বদলাতে বদলাতে এসব অনুষ্ঠানে এসে স্থির হন। ২২ ফেব্রুয়ারি সাহরির সময় সামা টিভির এমনি এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন বেশ কয়েকজন নামজাদা আলিম ও গায়ক। আলোচনার বিষয় কবরের আযাব। নানান বিষয়ে হালকা ধাঁচের আলোচনা হলো। তাদের অনুরোধেই একসময় মাইক্রোফোন এসে পড়লো তার হাতে। তিনি চোখ বন্ধ করে দরাজ কণ্ঠে গাইতে শুরু করলেন,
ম্যয় কবর আধেরি মে…ঘাবড়াউনগা যব তানহা
ইমদাদ মেরি করলে আ জানা ইয়া রাসুলুল্লাহ
(কবরের গভীর অন্ধকারে– যখন আমি ঘাবড়ে যাবো একলা/ আমাকে সাহায্যের জন্য আপনি আসবেন ইয়া রাসুলাল্লাহ)
সময় যেন ক্ষণিকের জন্য থেমে গেল। উপস্থাপক, অতিথি আর স্বয়ং গায়কের চোখে জল। বোঝা মুশকিল হয়ে গেল তারা কাঁদছেন কিসের জন্য? গভীর অন্ধকার কবরের কথা ভেবে নাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যার বিচ্ছেদ অনুভব করি আমরা– মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ভেবে?
হামদ-নাত-কাওয়ালির এই যাদুকরের নাম আমজাদ ফরিদ সাবরি। সংক্ষেপে আমজাদ সাবরি। দক্ষিণ এশিয়ার কাওয়ালি জগতে তিনি এক ধ্রুবতারা হয়ে উঠেছিলেন, একনামে সবাই চিনত তাকে। জন্মেছিলেন করাচিতে, কাওয়ালির কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি পরিবারে। বাবা গোলাম ফরিদ সাবরি ছিলেন বিখ্যাত কাওয়াল। জনশ্রুতি আছে তিনি ছিলেন আকবরের রাজসভার মিয়া তানসেনের বংশধর।
আমজাদ ফরিদের আমজাদ সাবরি হবার পেছনে তার বাবা গোলাম ফরিদ সাবরির অবদানই ছিল বেশি। গোলাম ফরিদ বড় মাপের কাওয়াল ছিলেন। তার গায়কদল সাবরি ব্রাদার্স উপমহাদেশ ছাড়াও পাশ্চাত্যে সমানভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গোলাম ফরিদ নিজেই অনেকসময় কাওয়ালি লিখতেন। আধ্যাত্মিক ভাবনায় ঋদ্ধ এসব পঙক্তি শ্রোতাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করত। ছোট্ট আমজাদ বাবা আর চাচার সাথে বসে কাওয়ালিতে গলা মেলাতেন, তালে তালে হাততালি দিতেন কাওয়ালদের বিশেষ ভঙ্গিমায়।
গোলাম ফরিদ সাধনার ক্ষেত্রে খুবই রূঢ় প্রকৃতির ছিলেন। বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। আমজাদ কখনও কখনও মার খেতেন তার হাতে; না খেয়েও থাকতে হত। এসবের ভেতরেই আমজাদ একজন দক্ষ কাওয়াল হয়ে ওঠেন। বাবার ইন্তিকালের পর নিজেই হাল ধরেন সাবরি ব্রাদার্সের। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি। একে একে দরাজ কণ্ঠে উপহার দিয়ে গেছেন অসাধারণ সব কাওয়ালি।
শুরুর দিকে গোলাম ফরিদ আর চাচা মকবুল আহমদের গাওয়া কাওয়ালিগুলোই গাইতেন তিনি। যেমন ‘ভর দো ঝোলি মেরি, ‘তাজেদারে হারম’, ‘ও শরাবি ছোড় দে পিনা’, ‘খাজা কি দিওয়ানি’, ‘বালাগাল উলা বিকামালিহি’ ইত্যাদি। এরপর নিজেই কাওয়ালি লিখতে শুরু করেন। ‘ধুম মাচা দো’, ‘খাস ইয়েদুআ মেরি’, ‘আলি মেরা দিল’, ‘ম্যয় নাজার কারো জানে জিগর’, ‘আল্লাহ আল্লাহ’, ‘ফির দেখা দে হারাম’, ‘আলি কে সাথ হ্যয় যাহরা কি শাদি’, ‘কারাম মাংতা হু’, ‘আয় মুহাম্মদ নুরে মুজাসসাম’ ইত্যাদি।
আমজাদ পূর্বপুরুষের মতো চিশতিয়া সাবেরিয়া তরিকার একজন মুরিদ ছিলেন। কণ্ঠে তাই ঘুরেফিরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কথাই বারবার আসতো। ইসলামপন্থিদের মনে তিনি এভাবেই বিশেষ একটি অবস্থান করে নিয়েছিলেন। চিশতিয়া তরিকার কাওয়ালির ঐতিহ্য ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। ইসলামের সৌন্দর্য প্রচারে সবসময় বলতেন খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতি আজমীরী (র.) এর কথা। একটি স্মৃতিচারণায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তার কাওয়ালি শুনে পুরো হলরুমের শ্রোতাদের সবার একসাথে ইসলাম গ্রহণ। সাবরি ব্রাদার্সের স্ক্যান্ডিনেভিয়া ভ্রমণকালে এ ঘটনা ঘটে।
ধর্মপ্রাণ এই মানুষটিকেও পাকিস্তান তালেবানের একটি গ্রপ ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল। সাহরি অনুষ্ঠানে সেই মর্মস্পর্শী নাতটি গেয়ে যেদিনের রোযা শুরু করলেন; সেই রোযা আর ভাঙা হলো না। খুব কাছ থেকে দুজন ভাড়াটে খুনি তাকে গুলি করল। শাহাদাতের ইফতারি নিয়ে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। অনেকেই বলেছেন, তার সেদিনের কথাগুলো আল্লাহ তায়ালা খুব দ্রুতই কবুল করে নিয়েছিলেন।
আয় সাবজ গুম্বজওয়ালে! মানযুর দুআ করনা।
যব ওয়াকতে নাযা‘ আয়ে দিদার আতা করনা।
হে সবুজ গম্বুজের মালিক, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করুন।
দিদার যেন পাই আপনার- যখন মৃত্যু ঘনাবে আমার।
ম্যায় কবরে আঁধেরি মে ঘাবরাউনগা যাব তানহা
ইমদাদ মেরি কর লে আ জানা মেরে আকা।
একলা গভীর অন্ধকার কবরে যখন ঘাবড়ে যাবো,
আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনি আসুন, হে আমার আকা।
রওশন মেরি তুরবাত কো লিল্লাহ যারা কারনা
যব ওয়াকতে নাযা‘ আয়ে আকা দিদার আতা করনা।
আল্লাহর ওয়াস্তে আমার কবরের মাটি উজ্জ্বল করে দিন
মৃত্যুর সময় আপনার দিদার নসিব করুন।
মুজরিম হো জামানে কা, মেহশার মে ভারম রাখনা
রসওয়ায়ে যামানা হু, কমলি মে ছুপা লেনা।
যুগের কুখ্যাত পাপী আমি– হাশরে আমার পাপ গোপন রাখুন।
যুগের নিকৃষ্টতম আমি– আপনার পবিত্র চাদরে আমায় আবৃত করুন।
মানযুর দুআ মেরি মাকবুলে খুদা করনা
যাব ওয়াকতে নাযা আয়ে দিদাদ আতা করনা।
আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করুন ওহে প্রিয়তম আল্লাহর!
দিদার যেন পাই আপনার- যখন মৃত্যু ঘনাবে আমার।
মাত্র কদিন আগেই পাকিস্তানের আদালত খুনিদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে। কিন্তু তাতে আর আমজাদ ফিরে আসবেন না; আমরাও সেই দরদভরা কণ্ঠের মোহময়ী সুরে নেশাগ্রস্থ হতে পারব না। রমজানও আবার আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। চ্যানেলগুলোতে সাহরির সময় আগের মতই অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু আগে যার কাওয়ালী শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম, সেই আমজাদ সাবরির কাওয়ালি সরাসরি আর শোনা হবে না। তবে কণ্ঠ থেমে গেলেও থেমে যায়নি সুরের ঝঙ্কার। সাবরির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি– কবরের গভীর অন্ধকারে, যখন একাকি ঘাবড়ে যাবো; আমার কবরে আলো হয়ে সাহায্যের জন্য এসো প্রিয় রাসুল। আমার এ আকুতি কবুল করে নিও ও সবুজ গম্বুজের অধিপতি।