ফররুখের ‘মৃত্যু’ আগেই স্বপ্নে দেখেছিলেন শামসুর রাহমান?

ফররুখের ‘মৃত্যু’ আগেই স্বপ্নে দেখেছিলেন শামসুর রাহমান?

স্বপ্ন কি সত্যি হয়? হতে পারে? বিজ্ঞান কি স্বপ্নকে স্বীকার করে? করে কি না করে, তা নিয়ে হতে পারে বিস্তর বিতর্ক, তবুও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা অশরীরী ঘটনার মুখোমুখি হই। এমনটা কখনো কখনো ঘটে বিখ্যাতজনদের জীবনেও।

হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। যে ঘটনা ঘটার পরে সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের মনেও আমার মতো প্রশ্ন জেগেছিল; যেই ঘটনা নিয়ে হুমায়ূন নিজেই বলেছেন, ‘সব ঘটনার পেছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে। আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ার পিছনেও নিশ্চয়ই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। থাকলেও আমি তা জানি না’।১

মূল ঘটনায় আসি- হুমায়ূন আহমেদের পিতা শায়িত আছেন পিরোজপুর। নানা বাস্তবতার কারণে দীর্ঘ ৩০ বছর পরে পিতার কবর জিয়ারতে গিয়েছিলেন লেখক। সেই ঘটনাটি লেখকের ভাষাতেই তুলে ধরা হলো–

“আমরা যাচ্ছি বরিশালে। গাড়ি করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছেন আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান এবং অভিনেত্রী-গায়িকা শাওন। ত্রিশ বছর পর এই অঞ্চলে প্রথম যাত্রা। সবকিছু বদলে গেছে। আমি যাচ্ছি ঘুমুতে ঘুমুতে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে বললাম, ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান। গাড়ি থামান।

আসাদুজ্জামান নূর বললেন, সমস্যা কী? শরীর খারাপ লাগছে?

আমি বললাম, শরীর খারাপ না, তবে কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি অতিপরিচিত জায়গায় এসেছি।

গাড়ি থামল। আমি ঘোরলাগা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামলাম। কিছুই চিনতে পারছি না। খুলনা-বরিশাল হাইওয়ের একটি অংশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুব কাছে কোথাও আমার বাবার কবর।

জাহিদ বলল, কী বলেন হুমায়ূন ভাই?

শাওন বলল, উনি যখন বলেছেন তখন একটু খুঁজে দেখলে হয়।

বেশি খোঁজাখুজি করতে হলো না। একজন বলল, সামান্য পেছনে গেলেই পিরোজপুর গোরস্থান। আমি সবাইকে নিয়ে গোরস্থানে ঢুকলাম। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। শাওন বলল, আমি আমার জীবনে অতি রহস্যময় একটা ঘটনা দেখলাম। ছেলে পাশ দিয়ে যাচ্ছে দেখে বাবা ছেলেকে ডেকে পাঠালেন”।২

হুমায়ূন আহমেদ এই ঘটনাতে “Supernatural touch” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।৩

এমন একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের জীবনে। কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুর দেড়মাস আগে তিনি একদিন স্বপ্নে একজন কবির মৃত্যু দেখতে পান। তারপর ঘুম থেকে উঠেই তা তিনি কবিতায় আবদ্ধ করেন, কিন্তু কবিতাটি থেকে যায় অসমাপ্ত– মানে তিনি শেষ করতে পারেননি তখন। কবিতার নাম দেন “একজন কবি: তার মৃত্যু”। কবিতাটি লেখেন ১৩ই আগস্ট ১৯৭৪ইং তারিখে এবং ১৯শে অক্টোবর ১৯৭৪ইং তারিখে কবি ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেন। এ বিষয়ে কবি শামসুর রাহমান নিজেই লিখেছেন, “প্রায় দেড় মাস আগে একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার স্বপ্নে ভেসে উঠেছিল একজন কবির মৃত্যুশয্যা। স্বপ্নে আমি সেই মৃত কবির চেহারা শনাক্ত করতে পারিনি। পরদিন সকালে আমি সেই স্বপ্নকেন্দ্রিক কয়েকটি পংক্তি লিখে ফেললাম হঠাৎ। তারপর আর এগনো সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। কবিতাটি অসমাপ্ত রয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমাদের সবাইকে গভীর বেদনায় বিদ্ধ করে লোকান্তরিত হলেন ফররুখ আহমদ। তাঁর মৃত্যুর ছায়ায় হয়ে উঠল এই কবিতা, যার কয়েকটি পংক্তি দেড়মাস আগেই আমার মনে এসেছিল। এই কবিতায় যে কবির কথা বলা হয়েছে তাঁর সঙ্গে ফররুখ আহমদের সাদৃশ্য থাক বা না থাক, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুই যে সেই আরদ্ধ কবিতাটিকে আজ এক পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।”৪

পাঠকদের কাছে সেই কবিতাটি পূর্ণাঙ্গ তুলে ধরা হলো–

একজন কবি: তার মৃত্যু

___ শামসুর রাহমান

সে নয় ঘরের কেউ, তবু ঘরেই ঘুমন্ত। অতিশয় শীর্ণ
অবয়ব, এলোমেলো দীর্ঘ চুল, গালে দু’দিনের
না-কামানো দাড়ি
এবং শরীর তার নিঃস্পন্দ নিঃসাড়, যেন তারহীন বীণা,
বাজবে না কোনোদিন আর!
দেয়ালের গোয়েন্দা খানিক দেখে তাকে সুদর্শনা
পতঙ্গের দিকে
ধীরে-সুস্থে অগ্রসর হয়। অকস্মাৎ জানালায় ছায়াচ্ছন্ন
বকুলতলার এক সঙ্গীতপ্রবণ পাখি এসে বলে গেলো–
নেই, নেই, নেই।
পুড়ছে আগরবাতি, বিবাগী লোবান। ঘরে নড়ে নানা লোক,
প্রবীণ, নবীন ছায়া পাঁশুটে দেয়ালে।
অনুরাগী কেউ আসে কেউ যায়, দ্যাখে তার সমস্ত শরীরে
উচ্চারিত মৃত্যুর অব্যয় মাতৃভাষা।

আসেন সমালোচক, পেশাদার; বন্ধু কেউ কেউ, জুটে যায়
বেজায় ফেরেববাজ প্রকাশক। অনুরক্ত পাঠক নোয়ায় মাথা আর
বারান্দায় ভিড়ে
বলপয়েন্টে ক্ষিপ্র নিচ্ছে টুকে জীবনীর ভগ্নাংশ নিপুণ
নৈর্ব্যক্তিক স্টাফ রিপোর্টার।
কোন্‌ সালে জন্ম তার, কী কী গ্রন্থের প্রণেতা, ক’জনই-বা
পুষ্যি রইলো
পড়ে ঘোর অবেলায়, নাকি সে অকৃতদার ইত্যাদি সংবাদ
দ্রুত প্যাডে জমা হয়, তবু
উন্মোচিত জীবনের আড়ালে জীবন খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে যায়।

এইদিন তার নয়, এই রাত্রিও তো নয়, এখন সে শোকাশ্রুর
কেউ নয়, লোবানের নয়, বকুলতলার সেই মুখ্য
সুরেলা পাখিও কেউ নয়। স্বপ্নময় সোনালি রূপালি মাছ
ফিরে যাবে না পেয়ে সংকেত; এখন তো ভাঙাচোরা
তৈজসপত্রের মতো ইতস্তত রয়েছে ছড়ানো তার সাধ, বিফলতা।
প্রজাপতি কোথায় কোথায় বলে বারবার উড়ে যায় দূরে।
ক’জন রমণী আসে উদ্বেলিত বুক আর কান্না নিয়ে চোখে,
কেউ কেউ গোপন প্রেমিকা
হয়তো বা; কারো হাতে ফুল তরতাজা, রাখবে কি দ্বিধাহীন
নিরালা শিয়রে?
কার বুকে শূন্যতার স্বেচ্ছাচারিতা প্রবল হয়, কার ভীরু
সত্তাময় জেগে রয় একটি অব্যক্ত ধ্বনিঃ হে মেধা, হে কাল
পাইনি, পাইনি।
কেউ আসে কেউ যায়, যথারীতি দ্যাখে ঝুঁকে, কী যেন বিহ্বল
খোঁজে তার চোখে-মুখে, নিথর আঙুলে, টেনে নেয় কী উদাস
ধূপের সুগন্ধ বুকে। শূন্যে ঝলসিত পাখসাট,
কখন হঠাৎ এক ঝাঁক হাঁস নামে ঘরে, পুশিদা, সফেদ;
মায়াকাননের শোভা প্রস্ফুটিত চারদিকে, যে আছে ঘুমিয়ে
তাকে ক্রমাগত স্নেহে করাচ্ছে কোমল স্নান সমুদ্রের নীল জল,
পায়ের পাতার কাছে একটি প্রবালদ্বীপ, শালবন, দীর্ঘ
তরুময় পথরেখা, ঝোপঝাড় সমেত খরগোস জেগে ওঠে–
কেউ দেখলো না।
হাতে ফোটে পদ্মকলি, রাশি রাশি, বুকে ঝরে পাপড়ি গোলাপের;
চকিতে হরিণ আনে ডেকে দূরস্মৃতি দিগন্তের, ঠোকে খুর
ঘরের মেঝেতে, নাচে; ঝিরিঝিরি, ঝরনা তার কানে বন্দনামুখর–
কেউ দেখলো না।
পদাবলী উজাড় পথের মতো ঠোঁটে একে একে দ্যায় এঁকে
বিদায়ী চুন্বন।
দৃষ্টির প্রখর দীপ্তি, আনন্দ বিষাদ কিংবা উচ্ছল কৌতুক,
ঈর্ষা, ক্রোধ, অথবা বস্তুর জন্যে কাতরতা, কলহ, বিলাপ
এবং দুর্মর ইচ্ছা আমৃত্যু কবিতা রচনার, রৌদ্র আর
জ্যোৎস্নার ঈষৎ কম্পনের সঙ্গে কথোপকথনে মাঝে মাঝে
অত্যন্ত গভীর মেতে থাকার অভ্যাস নিরিবিলি হৃৎস্পন্দন-সবই তো
ছেড়ে গেছে তাকে একযোগে। শুধু আত্মা তার একটি অদৃশ্য
মালা হয়ে দোলে ঘরে অগোচরে; বকুলতলার পাখি
আবার বসলো এসে জানালায় একা, গানে গানে বলে গেলো–
নেই, নেই, নেই।
ভিড় কৃশ হলে, থেমে গেলে পাঁচমিশালি গুঞ্জন, সুনসান
নীলিমার থেকে এলো নারী কেমন আলাদা।
অলক্ষ্যে সবার
একান্ত নিভৃত
দাঁড়ালো শয্যার পাশে কী সঙ্গীতময় অস্তিত্বের তেজে ঋজু,
একাকিনী; অদৃশ্য সে মালা তার গলায় এখন। কিছুক্ষণ
রাখে চোখ শেষ দৃশ্যে, অনন্তর নিলো সে বিদায়; শব্দহীন
পদধ্বনি কোথায় মিলায়।
একটি অনাবশ্যক, স্মৃতিহীন স্বপ্নহীন নিঃসঙ্গ শরীর
পড়ে থাকে
অনেক চোখের নিচে। মনোভূমিপ্লাবী অলৌকিক
জ্যোৎস্না বলে, যাই।৫

হয়তো অনেক আশ্চর্য ঘটনার মতো আমাদের স্মৃতিতে স্থান করে নেবে এই ঘটনাগুলিও, অথবা এর ব্যাখ্যা খোঁজার জন্য আমরা যাবো বিজ্ঞানের কাছে, আবার কেউ হয়তো যাবো ধর্মের কাছে। কে কার কাছে যাবে, তা না হয় থাকুক পাঠকদেরই ইচ্ছাধীন।

 

তথ্যসূত্র

১. হুমায়ূন আহমেদ, বলপয়েন্ট, অন্যপ্রকাশ- ২০০৯
২. প্রাগুপ্ত
৩. প্রাগুপ্ত
৪. ফররুখ (সংকলন), বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ- ২০০৯
৫. শামসুর রাহমান, আমি অনাহারী (১৯৭৬)