সময় বদলেছে, বদলেছে কন্যা বা বর বাছাইয়ের পদ্ধতিও। প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরণের ম্যারেজ মিডিয়া। কিন্তু আগেকার দিনে বর-কন্যা বাছাইয়ের পদ্ধতি কী ছিল? বা ধরুন আপনার দাদা-দাদীর মধ্যকার পরিচয় কিংবা বিবাহ কীভাবে হয়েছিল?
আজকে আমরা আপনাদের দাদা-দাদীর বিবাহ বিষয়ক অনুসন্ধান না করে অনুসন্ধান করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের বিবাহের ইতিহাস। কী প্রক্রিয়ার তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তার জীবন সঙ্গী সাজেদা খাতুনকে। সেই মজার ইতিহাস আজকের আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে।
তার আগে মোতাহার হোসেনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা জেনে নেব। তিনি ছিলেন একজন পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তার জন্ম কুষ্টিয়া (তখনকার নদীয়া) জেলার কুমারখালি থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে, তার মামাবাড়িতে ১৮৯৭ সালের ৩০শে জুলাই। তার পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ এবং মাতা তাসিরুন্নেসা। জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন তার পুত্র, এছাড়াও তিনি আরও তিন পুত্র ও সাত কন্যার জনক।
তিনি ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ, ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএ এবং ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। যুগপৎভাবে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। মজার ব্যাপার হলো পি.এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য তিনি কোন তত্ত্বাবধায়ক গ্রহণ করেননি, যা ছিল বিরল ঘটনা।
১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং ১৯২৩ সালে একজন সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। উনার হাত ধরেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে এম.এ কোর্স চালু হলে নতুন এই বিভাগে যোগ দেন তিনি। গণিত বিভাগেও ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রথম পরিচালক হন তিনি। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
এবার মূল কথায় ফিরে আসি, কাজী মোতাহার হোসেনের বিবাহ সম্পন্ন হয় ১৯২০ সালের ১০ই অক্টোবর। ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তার ক্লাসমেট ছিলেন আরেক বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ কাজী আকরাম হোসেন। তারা উভয়ে কলকাতার বেকার হোস্টেলের নিকটে ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেন একবার কাজী আকরাম হোসেনের নিকট ওয়াদা করলেন যে, তিনি কোন না কোনও সময়ে তাদের বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। সেই অনুসারে একবার তিনি আকরাম হোসেনের বাড়িতে দেখা করতে গেলেন। আকরাম হোসেনের চাচার বাড়িতে (মৌলবি বাড়িতে) একটা মসজিদ ছিলো। সেই মসজিদে তিনি আসরের আজান দেওয়ার সুযোগ পান এবং নামাজ আদায় করেন। (গ্রামীণ মসজিদে এখনো অপেশাদার কেউ বা কোন মেহমান আজান দিতে পারেন)। এই মসজিদেই তার ভবিষ্যৎ শ্বশুর কাজী মুহম্মদ আবদুল্লাহ এবাদাত করতেন। তিনি তার আজান শুনে খুব খুশি হন। তবুও তাকে আরও পরীক্ষা করার জন্য ‘শাহনামা’-র কোনও এক স্থান থেকে পড়তে বললেন। মোতাহার হোসেন এর আগে কখনো ‘শাহনামা’ পড়েননি। তার ভাষাও ফার্সি নয়, তবুও কোনো রকমে তিনি পড়লেন। কাজী মুহম্মদ সাহেব বললেন, ‘হাঁ, পড়েছ ঠিকই, কিন্তু ‘শাহনামা’ পড়তে হয় জোশের সঙ্গে, ভাবের অনুগমন করে’, এই বলে তিনি নিজেই চমৎকারভাবে সেই অংশটা কাজী মোতাহার হোসেনকে পড়ে শুনালেন।
এর কিছুদিন পরে আকরাম হোসেন চিঠি লিখে মোতাহার হোসেনকে জানান, ‘বড় চাচাজান তোমাকে খুব পছন্দ করেছেন, আর আমাকে বলেছেন, তোমার মতো ছেলের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জল। তাই সম্ভব হলে তোমাকে আত্মীয়রূপে গ্রহণ করতে পারলে উনি খুশি হবেন। এই ইঙ্গিত পেয়ে আমি তোমাকে জানাচ্ছি, বর্তমানে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দুজন সুযোগ্য মেয়ে আছে। একজন আলীপুর চিৎলের (চেতলা) জমিদার-কন্যা, কিছু কম হলেও দেখতে বেশ সুশ্রী। আর একজন কলকাতা ওলিউল্লা লেনের (তালপুর এলাকার) শামসুল ওলামা আতাউর রহমান খানবাহাদুর সাহেবের পুতনী। যে কিনা উর্দু, বাংলা এবং কিছু ইংরেজীও জানে। আর বঙ্কিমবাবুর “যুগলাঙ্গুরীয়” ও “রাধারাণী”-র উর্দু অনুবাদ করে উর্দু পত্রিকায় ছাপিয়েছে, এর বর্ণ কিছুটা মলিন হলেও চেহারায় দীপ্তি আছে’।
এই সময়ে মোতাহার হোসেন এবং আকরাম হোসেন দুজনেই সুপাত্রী খুঁজছিলেন। মোতাহার হোসেনের ভাষায়, ‘আমি ওদের মধ্যে মলিন কন্যাটাকেই পছন্দ করলাম, আর আকরাম নিজে সুন্দরী কন্যাকেই পছন্দ করলো’।
এবার নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছা করবে, তাহলে মলিন কন্যা নিয়ে কি মোতাহার হোসেন সুখী ছিলেন? মোতাহার হোসেন নিজেই লিখেছেন, ‘আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি জিৎ আমারই হয়েছিল’।
এর কারণও অবশ্য তিনি বর্ণনা করেছেন। যেমন মোতাহার হোসেন সারাদিন শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন আর তার স্ত্রী সংসারের সকল কাজের আঞ্জাম দিতেন। এমনকি যখন বাড়ি করা হয়, তার পুরোপুরি দায়িত্বও তার স্ত্রী পালন করেন। মোতাহার হোসেনের ভাষায়, ‘কোথায় ইটের গাঁথনি শিথিল হলো, কোথায় চূনকাম হলো না, কোন মজুরটার কাজে ঘাটতি হলো, এসব তদারক উনিই পূর্ব-অভিজ্ঞতার দরুন সুচারুরূপে করতে পারতেন। অর্থাৎ কত ধানে কত চাল হয়, এসব উনি কলকাতার দালান বাড়িতে বসতকালেই লক্ষ্য করেছিলেন, তাই বিল্ডিং-এর কনট্রাকটর ওস্তাগারদের গাফলতি চট করে ধরে ফেলতে পারতেন। কাজ খুব সুষ্ঠুভাবে অগ্রসর হয়েছিল। এর জন্য তিনি রোজ অন্ততঃ ৩/৪ ঘন্টা করে সরেজমিনে উপস্থিত থাকতেন আর আমি সর্বদা নিশ্চিন্তভাবে লেখাপড়ার কাজ করে যেতে পারতাম- নইলে হয়তো শিক্ষাক্ষেত্রে আমি অধিক উন্নতি করতে পারতাম না’। এই হচ্ছে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের বিবাহের গল্প।
১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল ‘শিখা’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি বাংলা একাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তাকে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ এবং বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে সম্মানিত করে।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের নামকরণও তার নাম অনুসারে, ‘কাজী মোতাহার হোসেন ভবন’ করা হয়।