দিনকে দিন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত

টি জে এস জর্জ এর কলাম

দিনকে দিন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত

প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতের জন্যে অশুভ বার্তা বয়ে আনছে। ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায় সাধারণ মানুষের মনোভাবে নজিরবিহীন পরিবর্তন এসেছে। সেসব দেশে নতুন ভূ-রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়ে গেছে, যে খেলায় ভারত এখন অনুপস্থিত। এটি নিয়ে ভারত যা বলছে না বা যা বলতে চাইছে না তা হলো, দেশপ্রেমের নতুন নতুন সংজ্ঞায়নে তারা এসবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের লক্ষ্যহীন বৈদেশিক নীতি মার খাওয়ায় সেসব নীতিকে সংকুচিত করে আনতে হচ্ছে।

ভারতের এমন দিশেহারা হয়ে পড়ার বেশ কিছু কারণও আছে, প্রথমত জওহরলাল নেহেরুর সময়ে ভারতের বিদেশ নীতি বেশ মজবুত এবং কার্যকর ছিল, যেখানে ভারতের ছোট ছোট প্রতিবেশীদের গুরুত্ব না দেওয়ার মানসিকতা ছিল। ফলে শুরু থেকেই ভারতের প্রতি অপছন্দ কাজ করেছে সেদেশগুলোতে। দ্বিতীয়ত, বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর ভারতের আচরণেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন, যা তার পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে সন্দেহ এবং উপহাসের জন্ম দিয়েছে। তৃতীয়ত, চীন এখন বিগ ব্রাদারের মতো করে সারাবিশ্বে খেলছে।

ফলে মালদ্বীপ খুব সহজেই অন্তর্গত সঙ্কটে ফেব্রুয়ারিতে ডাকা জরুরি অবস্থা জারির কালে প্রকাশ্যে ভারতের দোষ ধরার সুযোগ পায়। চীন সে সুযোগের সদ্বব্যবহার করে বলে দেয়, মালদ্বীপে ভারতের যেকোন ষড়যন্ত্র রুখে দেবে তারা। দিল্লী অবশ্য শেষমেশ চুপচাপ সব গিলে নিলো। বর্তমানে সেখানকার প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন চীনকে তাদের ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ বলেই বিশ্বাস করেন।

নেপালেও ভারতের অবস্থা তো যায় যায়। নেপালের রাজতন্ত্র পতনের পর সেখানে যখন গণতন্ত্র চলে এলো, ভারতের উচিৎ ছিলো প্রতিবেশী হিসেবে নেপালকে অতীতের চেয়ে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া, সম্মান প্রদর্শন করা। তার পরিবর্তে, নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় সেখানে ভারতীয় সাহায্য গ্রহণে বেশ জটিলতা পোহাতে হয় নেপালকে, যার ফলে কাঠমুন্ডুতে সাধারণ জনতা ভারত-বিরোধী বিক্ষোভেরও আয়োজন করে। অথচ ভারতের মিডিয়ার বরাত দিয়েই বলা যায়, সেই সাহায্য সময়মত না পৌছানোর পেছনে ছিল কেবল মাত্র ভারতের রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঐতিহ্যবাহী ধারা।

তারপর নেপাল-ভারতের নীতিতে আসলো হিন্দুত্ববাদী প্রভাব। রাজতন্ত্রের অধীনে ৮০ শতাংশ হিন্দুর দেশ নেপাল ছিল একটি হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু ২০১৫ সালে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রেক্ষিতে নেপালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে যুক্ত করা হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশ নেপালের সেই সিদ্ধান্তকে কোন প্রকার সম্মান না দেখিয়ে মোদি সরকার নেপালের বিরুদ্ধে সেদেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালি ‘মধ্যেশী’ জাতিগোষ্ঠীকে নেপালের বিরুদ্ধে নতুন সঙ্কট তৈরিতে লেলিয়ে দেয়। সেখানে মধ্যেশীদের সংবিধান পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে সেদেশে ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধ অচলাবস্থা সৃষ্টি করে, অথচ নেপালকে খাবার থেকে পেট্রোল সবকিছুই সীমান্ত দিয়ে আমদানি করতে হয়। ভারতের অনেকগুলো আহাম্মকি কাজের মধ্যে সবচেয়ে আহাম্মকি ছিল এটি। সে সুযোগে সেখানে হাজির হয় চীন।

এমনকি নেপালে আবার সমাজতান্ত্রিক ভাবাপন্ন সরকার ক্ষমতায় আছে। এবং চীন সবসময় তার চতুরতার উদাহরণ হিসেবে ছোট ছোট প্রতিবেশীদের মূল্যায়ন করে। ফলে তাদের সাহায্য-প্রকল্প এবং নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা শেষমেশ সেসব দেশকে চীনের পক্ষে আনতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। যদি চীনও আবার মুরুব্বির মতো আচরণ শুরু করে তখন হয়তো ভিন্ন কিছু হতে পারে।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, হিন্দু-প্রধান দেশ নেপালই যখন ভারতের হাতছাড়া হয়ে যায়, বাকিদের অবস্থা কী। ভারতে নির্মম জীবনযাপনকারী ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে এবার মৃত্যুকূপ মায়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায় ভারত। সীমান্ত-ব্যবসা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে অং সাং সুচি চীন সফর করলে চীন তার ঐতিহাসিক বেল্ট এণ্ড রোড ইকোনমিক করিডোরের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারকে বেশকিছু লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও সুচির সাথে ভারতের সাথে একদা সম্পর্কে বেশ উষ্ণতা ছিল, সুচি সেখানেই পড়াশোনা করেছেন, তবে এসব স্মৃতি ভারত-মিয়ানমার সম্পর্কে কোন আশা সৃষ্টি করতে পারছে না।

এবার আসি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, সেদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মুহুর্তে ভারতের সবচেয়ে কাছের। কিন্তু ব্যক্তিগত উষ্ণতা সেদেশের সাধারণ মুসলিমদের হিন্দুদের প্রতি মনোভাব বদলাতে কোনপ্রকার সাহায্য করতে পারেনি। আরেকদিকে ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশের যে অস্থিরতা চলছে, সেই অস্থিরতাকে মূলত জিইয়ে রাখছে তৃতীয়পক্ষ। এই পক্ষ এই অবাধ্য সীমান্ত দিয়ে খাবার, গৃহপালিত প্রাণী, ঔষধ এমনকি মাদকদ্রব্য পর্যন্ত পাচার করতে পারছে। মোদ্দাকথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশে ভারতের বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যা অন্য যেকোন দেশের তুলনায় বেশি।

শ্রীলঙ্কায় চীনের আধিপত্য বোধহয় সমকালীন সময়ে ভারতকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্থ করেছে। শ্রীলঙ্কার উত্তরের সমুদ্রাঞ্চলে হাম্বান্টোটা বন্দর চীন কিনে নেওয়ার পর সেখানে চীন ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধা অর্জন করে নিয়েছে। কলোম্বোর সমুদ্রপাড়ে নতুন কলম্বো প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হচ্ছে আবার। পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়ে আজ যেখানেই তাকানো যায়, কেবল চীন আর চীন।

চীনের চিন্তা তার সময় থেকে কমপক্ষে ১০০ বছর এগিয়ে থাকে। আর ভারতের দৃষ্টি পরের নির্বাচনের চৌকাঠ পর্যন্ত পেরোতে পারে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি লেখিকা তাহমিমা আনামের মন্তব্যের দিকে ভারতের নীতিনির্ধারকদের চোখ রাখা খুব দরকারি হতে পারে। তিনি ভারতকে “মারাত্মক স্বার্থবাদী” বলে আখ্যায়িত করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে “দুর্বলের প্রতি বিকৃত মস্তিস্কের এক সবলের আচরণ” বলে দাবি করেছেন। তাহমিমা আরো বলেছেন, “আমরা ভারতকে ভালবাসতে পারি না, কারণ কোন অসম সম্পর্কতেই ভালবাসা থাকা সম্ভব নয়।” কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীন তো ভারতের চেয়ে বেশি স্বার্থপর। তবুও কেউ বলছে না, “চীন, তোমাকে আমরা ভালবাসতে পারব না।” আপনাদের কাছে কি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত ঠেকছে না? হয়ত ভাবলে এতটাও অদ্ভুত না সেটি।

 


ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর কলামিস্ট টি জে এস জর্জ এর লেখাটি ১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়। কলামটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান।