সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় তাত্ত্বিকদের মধ্যে স্লাভো জিজেকের নাম সবার প্রথমেই উচ্চারিত হয়। তিনি এত বিষয় নিয়ে কাজ করেন যে সংক্ষেপে তালিকা করাই মুশকিল। তবে নিজেকে সবসময় সাম্প্রতিক ঘটনা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়-আশয়ের একজন সক্রিয় তাত্ত্বিক-কর্মী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তার চিন্তাগত অবস্থান নিয়ে আছে পক্ষ-বিপক্ষ, আছে বিতর্ক ও দার্শনিক সমালোচনা। সবকিছু ছাপিয়ে জিজেকের চিন্তা বা নানা বিষয়কে দেখবার অভিনব ও সৃজনশীল ধরণকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। সম্প্রতি ফিলসফি নাও ম্যাগাজিনে আনজা স্টাইনবাওয়ারকে দেওয়া বিশেষ এক দীর্ঘ স্বাক্ষাতকারে জিজেক কথা বলেছেন সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ এই স্বাক্ষাতকারটি জবানের পাঠকদের জন্যে অনুবাদ করে দেওয়া হল।
আনজা স্টাইনবাওয়ার : তো প্রফেসর জিজেক…
স্লাভো জিজেক : আপনার মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করতে না চাইলে দয়া করে আমাকে প্রফেসর ডাকবেন না। যে কেউ প্রফেসর ডাকা মাত্রই আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগা শুরু হয়। এই ‘প্রফেসর’ কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। এইসব অফিসিয়াল টাইটেল জাতীয় বিষয়ে আমার খুবই আপত্তি আছে। এগুলো নিয়ে এতটুকুও গর্বিত নই, বরং যখন কেউ আমাকে ‘প্রফেসর’ বলে তখন এটিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হিসেবেই নিই।
এটা স্পষ্ট যে, আপনি শুধু একজন দার্শনিকই নন, বরং বেশ পরিচিত দার্শনিক যাকে এক অর্থে দুষ্প্রাপ্য বললেও ভুল হবে না। আপনি ওই খ্যাতি পাওয়াটাকে কীভাবে দেখেন? খ্যাতি পাওয়াটা কি গুরুত্বপূর্ণ?
জিজেক : প্রথমত. খ্যাতির বিষয়টা খুবই আপেক্ষিক। জানেনই তো যে, আমার অনেক শত্রুও আছে। বিশেষত যারা মনে করেন, আমি ভাঁড় কিসিমের মানুষ যিনি ওপরে ওপরে ভালোমানুষি দেখালেও ভেতরে ভেতরে ছদ্মবেশী ফ্যাসিস্ট কিংবা স্টালিনপন্থী কাজ-কারবারের পক্ষে কথা বলেন কিংবা আরো কত কী! তাই আমি মনে করি, ওই তথাকথিত খ্যাতি দিয়ে আমাকে পরোক্ষভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে অথবা এটি আমার কাজকর্মকে আমলে না নেয়ার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার তখনই ভালো লাগে যখন আমার লেখা সবচেয়ে মজার বইটা অর্থাৎ ‘লেস দ্যান নাথিং’-এর প্রসঙ্গে কথা বলি। ওই বইটার সাইজ প্রায় বাইবেলের সমান- জানেন? এটার বিক্রিও বেশ ভালো ছিল। এ থেকেই বুঝতে পারি, গণমানুষকে কখনো ছোট করে দেখতে নেই। প্রকাশকরা আমাকে চাপ দিতে থাকেন আমি যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়েও একটা বেস্ট সেলার বই লিখে ফেলি। কেন তাকে নিয়ে লিখতে যাবো? তিনি আমার কাছে মোটেও নতুন কিছু নন, ট্রাম্প আমার কাছে একটা নিরস আহাম্মক।
আপনার বইগুলো যদি কফি টেবিলের বই হয়ে যায় তাহলে কি চিন্তিত হবেন না? জানেনই তো, মানুষজন শুধু কিনেই রেখে দেয়, পড়ে দেখে না…
জিজেক : শুধু কফি টেবিলের বই নয়, অনেক ঢাউস বেস্ট সেলার আর ক্ল্যাসিকগুলোও মানুষ পড়ে দেখে না। এগুলো মানুষ কেনে শুধু বুক শেলফে সাজিয়ে রাখার জন্যই। যেমন- জন রাওলস-এর ‘এ থিউরি অফ জাস্টিস’ বইটা। এমন ব্যক্তিদেরও চিনি যারা রাওলসের ওপর নিজেই আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছেন। অথচ ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এসে আবার স্বীকারও করেছেন, রাওলসের মূল বইটি তিনি পুরোপুরি পড়েও দেখেননি। আমি মনে করি, তারা ঠিকই আছেন। কারণ রাওলস যেই ঢঙে লেখেন ওই বই যদি আপনি ৫০ পৃষ্ঠায়ও সংক্ষেপ করে ফেলেন এতেও বইয়ের মূল বিষয়ে কোনো হেরফের হবে না। ওই একই সন্দেহটা আমার হেগেল-এর ক্ষেত্রেও হয়। তার ‘লজিক’ বইটাও মনে হয় কেউ পুরোটা পড়ে দেখে না। আর পুরোটা না পড়লেও এতে কিছু যায় আসে না। আপনি ফরাসি লেখক পিয়েরে বায়ার্দ-এর ‘হাউ টু টক অ্যাবাউট দি বুকস ইউ হ্যাভ নট রিড’ বইটা পড়েছেন? তার লেখনীতে ফরাসি ঢঙটা শ্রেষ্ঠ। এটা ব্যঙ্গ করে বলছি না । তিনি খুবই অদ্ভুতভাবে দেখান, সবচেয়ে নামকরা লেখকদের নিয়ে যারা বই লেখেন তারা ওই বিখ্যাত লেখকের বইটাই ঠিকমতো পড়ে দেখেন না। তিনি বলছেন, নিজের যে কোনো লেখা গোছানোর ক্ষেত্রেও শুধু ওই লেখকের যে কোনো একটা ফিচার তুলে নিলেই যথেষ্ট। এরপর ওই ফিচার১- কে রঙ-তুলি দিয়ে এঁকে
আপনার লেখাজোঁকার বাকি কাজগুলোও সহজে এগিয়ে নেয়া যাবে। এভাবে আপনি সম্পূর্ণ নতুন কোনো লেখার প্লটও পেয়ে যেতে পারেন। দর্শনের প্যারাডক্সটাই এখানে যে, আপনার কখনোই এটা পুরোপুরি পড়া লাগবে না, বরং বেশি জানলেই কেমন যেন দিকভ্রান্ত একটা অনুভূতি হওয়া শুরু হয়।
সবাই যদি আপনার বই শুধু কিনে না পড়ে রেখে দেন তাহলে আপনি কি এর মধ্যে কিছুটা ইতিবাচক ইঙ্গিতও দেখতে পাবেন না?
জিজেক : হ্যাঁ, আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আশাবাদের জায়গাটা এখানেই যে, তাদের মধ্যেও এক কিসিমের মানুষজন সব সময় থাকবে যারা আমার লেখার মধ্যে জোকগুলো ছাড়া অন্যকিছুও পড়তে চান। যেমন- আগের সিরিজে বের হয়েছিল দর্শনগত বিষয়ে আমার লেখা বইগুলোর মধ্যে এবসল্যুট রিকোয়েল নামের বইটা (দুঃখিত। কিন্তু এটা বলতেই হচ্ছে যে, কেউ যদি আমার মাথায় কখনো বন্দুক ঠেকায় তখনো আমার শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে এটার নামই বলবো) প্রকাশ হওয়ার পর রীতিমতো এমন মেইল পেয়েছি, যেখানে আমাকে লোকজন প্রশ্ন করেছে, ‘আপনার ওই কৌতুকগুলো কোথায়?’ কয়েকজন মনে করেন, ওইসব অশ্লীল কৌতুকের বাইরে আমি কেবলই প্রচলিত দার্শনিক। এক অর্থে তারা ঠিকই বলেন। এ কারণে প্রায়ই লাঁকার চোখ দিয়ে হেগেল-কে পুনর্ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।২ আমার কাছে দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কান্ট থেকে হেগেলের উত্তরণ।৩
বর্তমানে ‘দর্শন’ আমাদের জন্য কী করছে বা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আর হেগেলকে কি এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
জিজেক : অবশ্যই মনে করি, হয়তো আমাদের উচিত ধুম করেই পৃথিবী পরিবর্তন করে ফেলার নিয়ত বাদ দিয়ে এক কদম পেছন ফিরে তাকানো। এরপর আবার এসব নিয়ে চিন্তা করে দেখা। আমাদের আসলে মার্কস-এর বস্তুবাদের রাস্তায় উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে হেগেলকে আবারও খুঁজে বের করা দরকার। হেগেলের কোন বাক্যটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি জানেন? যখন তাঁর ফিলোসফি অফ রাইট বইয়ে লেখেন, যুদ্ধ এবং জ্ঞানের দেবী মিনার্ভার পেঁচাটা শেষবেলার পড়ন্ত সন্ধ্যাতেই নামে।৪ আমার মতে, ওই সহজ উক্তি দিয়ে হেগেলের নামে একটা বড় মিথ্যাচার চালিয়ে দেয়া সম্ভব এই বলে যে, হেগেল আসলে রক্ষণবাদী ছিলেন। তিনি ফিলোসফি অফ রাইট-এর মাধ্যমে একটা প্রটো-ফ্যাসিস্ট সমাজের দালালি করতে চেয়েছিলেন। যখন হেগেল বলতেন কিছু ঐতিহাসিক পর্যায় (Historical order) সম্পর্কে, একমাত্র তখনই বোঝা সম্ভব হয় তার আয়ু প্রায় শেষের পথে। আপনি কি মনে করেন, হেগেল এতটাই আহাম্মক ছিলেন, ওই একই কথা যে তার ফিলোসফি অফ রাইট-এর স্বীকার্যগুলোর ক্ষেত্রেও খাটে- এটা তিনি বুঝতেন না? আমাদের সমাজের রূপ কেমন হওয়া উচিত সেটির কোনো ছবি তিনি এঁকে দিয়ে যাননি, বরং ওই সমাজের ছবিই এঁকেছিলেন যে সময়টুকু এই সমাজ ইতোমধ্যেই পার করে এসেছে। তাই আমাদের বর্তমান অবস্থায় মার্কসের তুলনায় হেগেলকেই বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। মার্কস দিন শেষে মানবসত্তার এমন একটা নূন্যতম পরম উদ্দেশ্যে৫ বিশ্বাস করতেন। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, আমরা সবাই এমন একটা সময়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে অনেক সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। আর ওই সম্ভাবনাটাই সফল হবে শুধু প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে কিংবা বিশ্ব মানবতার মুক্তির মাধ্যমে যেখানে ঠিক একই প্রশ্নে হেগেল বরং বিপ্লব-পরবর্তী নিয়ে ভাবছিলেন।
ফরাসি বিপ্লবের প্রসঙ্গেই আসি এবার। এক অর্থে এটা ছিল একটা ব্যর্থ বিপ্লব। হেগেল তবুও ফরাসি বিপ্লবের মিটিমিটি আলো জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তার দর্শনের মাধ্যমে। ফরাসি বিপ্লবের বদনাম করে বেড়ানো মোটেও তার উদ্দেশ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল এটাই যে, এত বিপর্যয় বা ব্যর্থ বিপ্লবের পরও যেন এর ধারাবাহিকতাটা চলমান রাখা যায়। আমি মনে করি, আমাদের এখনকার অবস্থাও একদম একই। দেখেন, বিশ শতকের মধ্যে ঘটে যাওয়া সব র্যাডিকাল প্রচেষ্টা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন আমাদের ওই মার্কসিস্ট মেটাফোর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, আমরা সবাই হচ্ছি ইতিহাসের একটা চলন্ত ট্রেনের যাত্রীর মতো। মার্কসবাদীরা এ উদাহরণটি দিয়ে আনন্দ পান, একটা অন্ধকার টানেল যত অন্ধকারই হোক না কেন, ওই টানেলে এগোতে থাকলে এর শেষপ্রান্তে আলো (মানবমুক্তির) খুঁজে পাওয়া যাবেই। যদি ব্যঙ্গ করে বলি, ‘হ্যাঁ, টানেলের শেষে আপনি যেটা দেখছেন তা অবশ্যই আলো তাহলে সেটি হচ্ছে টানেলের বিপরীত দিক থেকে নিজের দিকে ছুটে আসা বিধ্বংসী আরেকটা চলন্ত ট্রেনের হেডলাইট।’ এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা; যেটা হেগেল অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। এ জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কোনোভাবেই পরিকল্পনা করতে পারি না। কারণ ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত বা অসীম।৬
যে আলোর কথা বললেন সেটি তো যেন কিছুই হতে পারে– মানে, এটা তো ওই বিধ্বংসী ট্রেন বাদে অন্য কিছুও হতে পারে? টানেলের শেষে তো সত্যি সত্যিই আলো (মানবমুক্তি) থাকতে পারে, তাই না?
জিজেক : হুম! এ জন্যই তো বললাম, আমাদের পথচলার শুরুটাই হোক এই মেকি আশা থেকে রেহাই পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আজ লেফটদের অবস্থাটাই দেখেন একটু, বিশেষ করে লেফট উইংয়ের মধ্যে ফুকোইয়ামাপন্থীদের কথা বলছি যারা মনে করেন, লিবারেল (উদারনৈতিক) গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদই আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য। তাই এগুলোর সঙ্গে বেশি করে সলিডারিটি, হেলথকেয়ার কিংবা গে-ম্যারেজের আলাপ যোগ করে যত বেশি সংশোধন করে সামনে আগানো যায় ততই ভালো। ফুকোইয়ামা-কে এখানে অন্যভাবে উত্তর দেবো। বলবো- ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক যে, পুঁজিবাদই জিতে গেছে। খেয়াল করে দেখেন, আজকের বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় হর্তাকর্তা কারা? এখনকার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা, তাই না? এখন এই বিষয়টার ফয়সালা কীভাবে করবেন? বিংশ শতাব্দীতে আমরা যে পথে হাঁটতে চেয়েছিলাম ওই সমাপ্তিটা তো আমাদের মেনে নিতেই হবে…।
আপনার কথাবার্তায় নানান লেবেল ব্যবহারে কি কোনো সমস্যা আছে? মানে, আপনি যখন বললেন, ‘ক্ষমতায় বসে থাকা কমিউনিস্টরাই পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় হর্তাকর্তা’ তখন পুঁজিবাদ বলতে কী বোঝাচ্ছেন? কারণ পুঁজিবাদের তো অনেক রকমফের আছে। আর যেসব কমিউনিস্ট পুঁজিবাদের ধারক-বাহক হয়ে বসে আছেন তারা নিজেদের কমিউনিস্ট দাবি করলেও বাস্তবে তো কোনো কমিউনিস্টের পর্যায়েই পড়েন না।
জিজেক : আচ্ছা দেখুন, কেন নিজেকে এখনো কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দিই। ওই পরিচয়টা খুবই সীমিত অর্থেই ব্যবহার করি। সবাই কি বর্তমানে কমিউনিজমের ওই করুণ পরিণতি দেখতে পাচ্ছি না? লেফটদের কাছে কি এখনকার বৈশ্বিক ইস্যুগুলোর কোনো যথার্থ বা স্থায়ী সমাধান পাওয়া যায়? আমার এখনো নিউ ইয়র্কের অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট-এর৭ কথা মনে আছে। ওই মুভমেন্টের সময় তাদের (আন্দোলনকারীদের) সঙ্গে আমি ছিলাম আর প্রতি মুহূর্তে তাদের জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘তোমরা কি চাও’ অথবা তোমাদের আন্দোলনের কি কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে?’ তাদের মধ্যে কেউ আমাকে এর উত্তর দিতে পারেনি। আমার মনে হয়, তারাও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক জানতো না। লেফটরা দিন শেষে তাদের আশ্রয় খুঁজতে থাকে নৈতিকতাবাদ (Moralism) কিংবা পলিটিকাল কারেক্টনেসের (Political Correctness)-এর মতো অন্যান্য সমাধানের মধ্য দিয়ে। আসলে সমস্যাটা মূলত এখানেই যে, একদিকে লেফটরা সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছাড়াই টুকরো টুকরো কিছু জমায়েত করে যাচ্ছে, অন্যদিকে আমরা ধরতে পারছি না, ক্যাপিটালিজম তার ব্যর্থতার শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আমাদের ইকোলজি কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তা দেখতে পাচ্ছেন? হয়তো কার্বন-ট্যাক্স আর রেগুলেশনের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ছোটখাটো একটা সমাধান দেবে। কিন্তু তা কোনোভাবেই একটা স্থায়ী সমাধানে আমাদের নিয়ে আসতে পারবে না। আবার ফিকশনাল ক্যাপিটালের আদান-প্রদানের সম্পর্কটা দেখুন। এরপর আছে শরনার্থী সংকট। ওইসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ একদমই অকার্যকর একটা ব্যবস্থা। যখন বড় আকারের কোনো বিপর্যয় আসে তখন ওই অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের জন্যও বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়। বায়োজেনেটিক্সের কথাই ভাবুন। আমাদের মস্তিষ্ককে এখন কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত করা যাচ্ছে- এটা তো গতানুগতিক মানবসত্তার (human being) ধারণাকেই ভেঙে চুরমার করে দেয়। ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দিন শেষে একটা আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে তাকেই বোঝানো হচ্ছে যেটা একইভাবে গ্লোবাল মার্কেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে। এর সাথে সাথে আইডিওলজির দিক থেকে আবার এথনো-সেন্ট্রিক আচরণ দেখাচ্ছে, মানে স্ব-জাতিত্বের আত্মগৌরবে ভুগে যাচ্ছে। এ জন্য দেখবেন ট্রাম্পের সাথে বিশ্বের অন্যান্য স্বৈরশাসকদের খাতির খুব বেশি। চীনও ঠিক একই কাজ করছে, এমনকি মোদি কিংবা পুতিনও দাবার বোর্ডে একই চালটাই দিচ্ছেন। আমরা এখন পুরোপুরি নতুন একটা পৃথিবীতে আছি যেখানে রাষ্ট্রগুলো কোনো সর্বজনীন নিয়ম-নীতির ধার না ধরেই নিজ নিজ খেয়াল-খুশিমতো গ্লোবাল মার্কেটের অংশ হতে চাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে খুবই বাজে অবস্থা। যাহোক, আপনার প্রশ্নে ফেরত আসি। কেন কমিউনিজমের কথা বলি? কারণ এতক্ষণ ধরে যেসব সমস্যার কথা বললাম এর সবই হচ্ছে কমনস (মার্কসিস্ট অর্থে যাকে সামষ্টিক বলা হয়)-এর সমস্যা। যেমন- ইকোলজি হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের সবার অস্থিত্বেরই একটা অংশবিশেষ। এর ক্ষতি সাধনের পেছনে আমাদের দায়টা অনেক। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে এমন কিছু সামষ্টিক বিষয়-আশয় আছে যেগুলোর সমাধান কখনোই বাজার ব্যবস্থা দ্বারা করা সম্ভব নয়। ওইসব সমস্যাকে কোনোভাবেই ব্যক্তিগতকরণ করা সম্ভব নয়।
ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির৮ ক্ষেত্রেও একই সমস্যাই ছিল। এরপর আছে বায়োজেনেটিকস। এসব জায়গায় কমিউনিজমকে সমাধানের পথ হিসেবে না দেখলেও প্রশ্ন করার উপায় হিসেবে তো ব্যবহার করাই যায়। মার্কেট অবস্থার বাইরে থেকে যখন আমরা কোনো কিছুর সমাধান খুঁজি, তখন এসব সমস্যার আকার বুঝে উঠতে পারাটাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। আমার বন্ধু পিটার স্লতারদাইক তার হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি? বইয়ে ওই একই কথা বলে বইয়ের উপসংহার টানার চেষ্টা করেছে এভাবে- ‘আরে ভাই, জাতিরাষ্ট্রের আগের ওই জমানা এখন কি আর আছে? যেখানে নিজের দেশের নামে জান কোরবানি দেয়াই ছিল সবচেয়ে বেশি সাহসী ব্যাপার। বরং আমাদের বহুজাতিক একটা রূপ দরকার যার মাধ্যমে আমরা বায়োজেনেটিক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মালিকানার ইস্যুতে একটা ভালো ফয়সালা করতে পারবো। এই ক্ষেত্রে গতানুগতিক মার্কসবাদীদের মতো ক্যাপিটালিজমের বিরোধিতা করে যাবো না। আমি মনে করি, ক্যাপিটালিজমই মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে যুগান্তকারী সময় এনে দিয়েছে। একদিকে সবাই এক জাতিতত্ত্বের আত্মগৌরবে ভুগতে থাকবেন, অন্যদিকে বাকিরা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন- এ রকম কিছুতে আস্থা রাখি না। এটা কখনোই কোনো কাজের কথা হবে না! একে টেক্কা দেয়ার জন্য দরকার নতুন আরেকটা বৈশ্বিক লক্ষ্য। আমার পয়েন্টটা হচ্ছে, দিন শেষে নতুন কিছু পেতে হলে আমাদের আগে ক্যাপিটালিজমের মধ্য দিয়েই যেতে হবে এবং একই সাথে ক্যাপিটালিজমকে বিদায় দেয়ার জন্য নতুন একটা রাস্তাও বানিয়ে নিতে হবে। যে এই কথাগুলো বলছি এর মানে এই নয়, আমি একটা গোঁড়া ইউরোপিয়ান। এই কারণে বলছি যে, আজ ইকোলজির মতো বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়াটাই আমাদের ক্যাপিটালিজমের ক্রাইসিসের বিষয়টা পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাই এই ব্যাপারে হতাশাবাদীদের মতো করেই উত্তর দেবো আর বলবো, ক্যাপিটালিজম তার নিজের খাসলতের কারণেই কোনোদিন এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমার কাছে এটাও অযৌক্তিক লাগে যখন মানুষজন বলে, গ্লোবালাইজেশন হলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে।৯ তাদের সাথেও দ্বিমত করবো। কারণ আমার কাছে গ্লোবালাইজেশন হচ্ছে সীমানা ভেঙে আমাদের কাছাকাছি আসার জন্য সবচেয়ে ভালো একটা উসিলা! কেউ-ই এটা বলে না যে, ‘যাক বাবা, কাজের হাত থেকে তো বাঁচলাম এইবার।’ আবার তারা ধরেই রাখে যে, গ্লোবালাইজেশনের ফল হবে ভয়াবহ।
তাহলে এখানে কোনো দার্শনিকের কাজটা কী? আপনি কি নিজেকে তাত্ত্বিক বলতে পছন্দ করেন? আপনি অ্যাক্টিভিজম বিষয়েও মাঝে মধ্যে কথাবার্তা বলেন। ওই থিওরি আর প্র্যাকটিসের মধ্যে কী আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে?
জিজেক : অ্যাক্টিভিজমের গলদগুলো ধরার জন্য তো একটা থিওরি লাগবেই, তাই না? বিশেষত লেফট উইং পলিটিকাল থিওরির কথা বলছি। আর দেখুন, বিশ শতকের পুরো ইতিহাসটাই এই রাজনৈতিক লেফটদের পরাজয়ের ইতিহাস;, তাই না? তাই বলবো, যেসব বই আন্দোলনের ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করতে পেরেছিল সেগুলোই মূলত গত শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই। একই সাথে ওই ধরনের বই প্রকাশিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটাও তো হতাশার বিষয়, তাই না? তাহলে এখানে দর্শনের কাজটা কি ধরতে পারছেন? প্রথমত. শুধু প্র্যাকটিসে বিশ্বাস করি না। কারণ থিওরি ছাড়া প্র্যাকটিস নিজেই অন্ধ। সবকিছুর আগে আমাদের একটা থিওরি দরকার। ওই থিওরি আবার সরাসরি অ্যাক্টিভিস্ট থিওরি হলেও চলবে না।
তাহলে আপনি কি মনে করেন, প্র্যাকটিস সব সময় থিওরির পেট থেকেই বেরিয়ে আসে?
জিজেক : এখানে একটু চালাকি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। কারণ দার্শনিকরা এই মুহূর্তে নতুন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির আমদানি করলে তা কতটুকু কাজের হবে। এটি নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে দেল্যুজের একটা বাক্য যোগ করবো যিনি মনে করেন, ‘সঠিক উত্তর দেয়ার চেয়ে সঠিক প্রশ্ন করতে পারাটা জরুরি।’ আর এই সঠিক প্রশ্ন করার জায়গাতেই দর্শন তার কাজ করে দেখাতে পারে। বর্তমানে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। ওই সমস্যাগুলোর আলাপ যদি এমনভাবে করা হয় যে, এর সমাধান না হয়ে উল্টো আনো বেড়ে যায় তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে সেটিই বলছি।
আপনি পলিটিকাল কারেক্টনেসের বিষয়ে এর আগেও অনেক জায়গায় কথা বলেছেন। আপনি কি এটিকে সমস্যা বলে মনে করেন?
জিজেক : পলিটিকাল কারেক্টনেসের ব্যাপারে আমারও সন্দেহ আছে। তবে এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আমার আপত্তি নেই। ভেবে দেখুন, এমন একটা সমাজে আপনাকে বসবাস করতে হবে যেখানে সবাইকে পলিটিকাল কারেক্টনেসের ভয় দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য তারা ভেতরে ভেতরে সেসব ভয়ানক হয়রানির (তা হোক যৌন কিংবা অযৌন) গুপ্ত-ইচ্ছা আর অপরাধপ্রবণতাকে পুষে রেখেছে। ধরেন, আপনার দিকে দুই সেকেন্ড বেশি তাকিয়ে থাকার জন্য আমাকে সবাই ‘ভিজ্যুয়াল রেইপিস্ট’ বলে গালি দেবে, এমনকি আমারে কাঠগড়ায়ও দাঁড় করাতে পারে এ জন্য। পলিটিকাল কারেক্টনেসের নিজস্ব ধ্যান-ধারণাগুলো খুবই বাজে। এটা ধরেই নেয় যে, প্রত্যেকেই হচ্ছে একেকজন সম্ভাবনাময় ভিক্টিম।
পলিটিকাল কারেক্টনেসের মূল উদ্দেশ্য কি তাহলে এ রকম যে, বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের ভাষার একটা আপসমূলক সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হবে এবং এরপর ধরে নিতে হবে সব সমস্যার ফয়সালা হয়ে গেছে?
জিজেক : ফয়সালা হওয়ার এই প্রক্রিয়াটা কি সমস্যাজনক না? আমার কাছে মনে হয়, বর্ণবাদকে উৎখাত করার জন্য ভাষাকে সংশোধন করার চেয়ে বরং আগের ওই একই বর্ণবাদী জোকগুলোই ভিন্নভাবে আর ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এই খুনসুটিগুলো না থাকলে তো সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যাবে, তাই না?
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। ভাবছিলাম এমন কোনো দার্শনিক প্রশ্ন আছে কি না যা এখনকার সময়ে এসেও খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?
জিজেক : ‘এপিয়ারেন্স’ এর অবস্থার প্রসঙ্গটা নিয়ে এখানে আলোচনা করা যায়। ওই একই জায়গায় কান্টের প্রশ্নটাও এ রকম ছিল, ‘আমরা সব সময় এই এপিয়ারেন্স-এর১০ জগতেই সীমাবদ্ধ থাকবো, নাকি ওই এপিয়ারেন্স-এর জগতকে অতিক্রম করে কোনো একসময় বাস্তবতা (Reality)-কে১১ বুঝে উঠতে পারবো?’ হেগেল ওই সমস্যাটা পুরোপুরি বিপরীত দিক থেকে সমাধানের চেষ্টা করেছেন আর বলেছিলেন, ‘রিয়ালিটি’ বিষয়টা কি এমন যে, এটা নিজের কাছে নিজেই প্রতীয়মান (appear) হয়? কারণ এপিয়ারেন্স নিজেই বড়সড় একটা গ্যাপ তৈরি করে যে, জগতে আমরা যা দেখি (বা অনুভব করি) তা আসলে শুধু সেটিই নয়- বরং তারাই নিজের কাছে প্রতীয়মান হয়।১২ তাই এখানে হেগেলের সাথেই একমত হবো। ‘এপিয়ারেন্স’ এখানে একটা Reflexive-এর মতো কাজ করে যেটা বিমূর্ত আর সর্বজনীন। এই জায়গায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে যেখানে এপিয়ারেন্স ঠিক ততটুকুই পাত্তা পায় যতটুকু পর্যন্ত আমরা তাকে পরিমাপ করতে পারি।
এখানে অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা গলদ থেকেই যায় বলে মনে হচ্ছে, তাই না? কোয়ান্টাম লেভেলের বোঝাপড়ার জায়গাটাই তো আলাদা…
জিজেক : আগেই বলে রাখি, ওইসব আহাম্মক মানুষের পুরোপুরি বিরোধিতা করি যারা মানবমুক্তির প্রসঙ্গের সাথে অসম্ভাব্যতার১৩ সূত্রের আলাপ গুলিয়ে ফেলে। এরপর ‘মানবমুক্তি’র প্রসঙ্গটাকে অনির্ণয়তার দিকে ঠেলে দিতে চায়। বাস্তবতার অসম্পূর্ণতার (incompleteness) আলাপটা বরং আমার বেশি পছন্দ। মানে, রিয়্যালিটি বিষয়টা যদি খোদ নিজেই নিজের কাছে অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাহলে কী বলবেন?
এই নিয়ে খুব মজার একটা গল্প আছে যেটা দর্শনশাস্ত্রের একটা পরিচিতিমূলক বইয়ে পড়েছিলাম। ওখানে কোয়ান্টাম ফিজিক্স বোঝানোর জন্য একটা ছেলের ভিডিও গেইম খেলার উদাহরণ দেয়া হয়েছিল। যখন আপনি একটা গেইমের মধ্যে আছেন তখন ভিডিও গেইমের ভেতরের রিয়ালিটি কখনোই পুরোপুরি বা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখানো হয় না। ধরে নিলাম, কোনো একটা গেইমের ব্যাকগ্রাউন্ডে গাছপালার ছবি দেয়া আছে। এখন গাছপালার প্রতিটা পাতার ছবি তখনই দেয়া থাকবে যখন গেইমে সেটির প্রয়োজন পড়বে। আবার গেইমের ওই মিশন শেষ করার জন্য যদি ওটার প্রয়োজন না হয় তাহলে দেখবেন গাছপালার ছবিগুলো কেমন জানি আবছা আবছা করে দেয়া হয়। তাই প্রশ্ন আসে, গেইমের প্রোগ্রামার কেন সম্পূর্ণ রিয়ালিটিকে সব সময় প্রোগ্রাম করে দেন না? কারণ তার কাছে গেইমের মধ্যে সবকিছুই এমন সূক্ষ্মভাবে ধরে ধরে প্রোগ্রাম করার কাজ করারটা অর্থহীন সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না। আবার একইভাবে গেইমের মধ্যে একটা বাড়ির ভেতরের অংশগুলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে প্রোগ্রাম করে সময় নষ্ট করার দরকার পড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত গেইমের প্লেয়ারকে দেয়া মিশনে ওগুলোর দরকার পড়ে।
আইডিয়াটা খুবই সহজ, তাই না? ঈশ্বরও হয়তো এ মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় একই কাজটা করেছেন যার জন্য সৃষ্টির মাঝপথে এসে অ্যাটমিক লেভেল পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার পর ভেবেছিলেন যে, ‘এই মানব প্রজাতির বোধবুদ্ধি এতটাই কম হবে যে, তারা সাব-অ্যাটমিক লেভেল পর্যন্ত ভাবতেই পারবে না।’ এ ভেবেই হয়তো তিনি গতিবেগ (velocity)-এর সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে অতটা নজর দেননি, বুঝলেন? আইডিয়াটা নিজের মনকে বুঝ দেয়ার জন্য হলেও অন্তত দারুণ। হয়তো ঈশ্বর শুরুর দিকে আমাদের চিন্তা করার সক্ষমতাকেও তেমন পাত্তা দেননি কিংবা তিনি তখন ভাবতেও পারেননি যে, আমরা কোনো একদিন কোয়ান্টাম লেভেল পর্যন্তও ভাবতে পারবো। তাই বলতে গেলে কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে আমাদের এই ভাবতে পারাটা অনেকটা আমাদের হাতে ‘ঈশ্বরের বস্ত্রহরণ’ হওয়ার মতো একটা ঘটনা।
আর এভাবেই বস্তুবাদের (materialism) প্রসঙ্গটা আবারও ফেরত এসে পড়বে আমার কথায়। কারণ এতক্ষণ ধরে আমরা রিয়ালিটিতে যে অসামঞ্জস্য বা অসম্পূর্ণতা দেখতে পাচ্ছিলাম এর আলাপ চালিয়ে নেয়ার জন্য অযথাই ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রসঙ্গ টেনে আনার মানে হয় না। রিয়ালিটি খোদ নিজেই ওই অসামঞ্জস্যতায় ভুগতে থাকে। আমি এভাবেই ওই দার্শনিক সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করি। তবে এই প্রশ্নের অনেক উত্তরও থাকতে পারে।
এবার আপনার ইনকন্টিনেন্ট অফ দ্য ভয়েডঃইকোনমিক-ফিলোসফিকাল স্প্যান্ড্রেলস বইয়ের প্রসঙ্গে আসি। যেখানে আপনি “দর্শনশাস্ত্রের ফাঁকা জায়গাটুকু সাইকো-অ্যানালাইসিস আর রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা দখল করে নিয়েছে” বলে দাবি করেছেন। এই সূত্র ধরে আপনি আবার স্থাপত্যশাস্ত্র থেকে স্পান্ড্রেল (Spandrel) নামের একটা কনসেপ্ট ধার করেছেন। তাহলে কি এর আগে দর্শনের ডিসিপ্লিনগুলোর মধ্যে কোনো কিছুর ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন আপনি যেগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য স্পান্ড্রেল এর প্রয়োজন?
জিজেক : এখানে একটা খটকা আছে, কেন জানেন? আমি বরং উল্টো দিক থেকে এর উত্তর দিয়ে বলবো, ‘বিষয়টা এমনও হতে পারে, যে কোনো কিছুর ছাদ আর স্তম্ভ অস্তিত্বশীল হওয়ার স্বার্থে তাদের মাঝখানের জায়গাটুকুতে স্পান্ড্রেল থাকা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।’ মানববিবর্তন বিষয়ে স্টিফেন জে. গল্ড-এর থিসিসটা মূলত এটি নিয়েই। ঠিক যেমন করে মানবদেহের ফাঁকা জায়গাটায় অ্যাপেন্ডিক্স জায়গা করে নেয়। এর চেয়ে মজার বিষয় হলো, গল্ড মানুষের ভাষাকেও মানব বিবর্তনের পথে অবশ্যম্ভাবী একটা বাই প্রডাক্ট হিসেবে দেখেন।
যে স্তম্ভ আর ছাদের ওপর ভিত্তি করে স্পান্ড্রেল-এর মতো বাই প্রডাক্ট দাঁড়িয়ে থাকে তাদের তো নিজস্ব অভিযোজন ক্ষমতাই আছে।
জিজেক : হুম! কিন্তু তার কাছে এই অভিযোজন বিষয়টা কাজই করে মূলত স্পান্ড্রেলের মাধ্যমে। আমার কাছেও তা-ই মনে হয়েছে। কারণ পৃথিবীতে কোনো কিছুই পুরোপুরি স্বনির্ভর থাকতে পারে না যেটা প্যারাডক্সিকাল মনে হলেও খুবই সত্য। তাই দিন শেষে প্রয়োজন পড়ে একটা বাই প্রডাক্টের। কথাটা আরেকটু সহজ করে বলি, আধুনিকতার সময় দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন ডিসিপ্লিনগুলোর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যেমন ধরুন, সাইকো-অ্যানালিসিসের প্রসঙ্গেই ফেরত আসা যাক। ফ্রয়েড শুধুই নামমাত্র পজিটিভিস্ট সায়েন্টিস্ট ছিলেন না। এটাই ছিল আমার ওই বইটার মূল কথা। ফ্রয়েড কোনো সহজ-সরল ‘প্রকৃতিবাদী’(naturalist) মার্কা দার্শনিক অবস্থান আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি যেখানে শুধু ‘সেক্স’-এর গুরুত্ব নিয়েই আলগা কয়েকটা বুলি আওড়ানো হয়েছে। আমাদের মনের এমন একটা মানচিত্র ফ্রয়েড আঁকতে চেয়েছিলেন যেটা কান্ট-পরবর্তী দর্শনের সাথে খাপ খায়।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, ফ্রয়েড-এর সাইকো-অ্যানালিসিস-কে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে জার্মান ভাববাদকে পুনঃপাঠ করলে হয়তো আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আমরা যেমনটা ভাবি, সাইকো-অ্যানালিসিস তার চেয়ে মজার বিষয়। এটি শুধু আমাদের মনের নির্জ্ঞান (Unconscious) অংশ নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করে না অথবা কথায় কথায় পানির ওপরে ভাসতে থাকা বরফের চাকতির সঙ্গে কনশাস ইগো-র কন্সেপ্টের মিলে-অমিল নিয়ে বুলি আওড়ায় না। বরং ফ্রয়েডের কাছে মনের এই নির্জ্ঞান অংশটা (Unconscious) একটা ফেনোমেনা বা প্রপঞ্চ বাদে অন্য কিছু নয়। সাইকো-অ্যানালিসিসকে যদি আমরা জার্মান ভাববাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি কিংবা উল্টোদিক থেকে জার্মান ভাববাদকে যদি আমরা সাইকো-অ্যানালিসিস দিয়ে চেষ্টা করি তাহলেই ফ্রয়েডকে পুরোপুরি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হবে। এদিক দিয়ে ফ্রয়েড-এর সেক্সুয়ালিটি, সেক্সুয়াল ডিফারেন্সের সাথে ওনার কাজের মূল উদ্দেশ্যের সম্পর্ক তো সবাই জানে। শুধু এর সাথে মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের (Surplus Value) আইডিয়াটা নিজের মতো করে যোগ করে নিতে হবে যেখানে প্রতিটা পণ্য মাত্রই অস্তিত্বশীল হতে পারে তার নিজ উদ্বৃত্ত মূল্যের গুনে। ফলে পরবর্তীকালে ওই একই উদ্বৃত্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবারও ভোগ করার একটা বাসনা তৈরি হয়।
বইটার দ্বিতীয় অংশে ওই দুইটা আইডিয়াকে সমান্তরালভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য লাঁকার সারপ্লাস ইনজয়মেন্ট শব্দটা ব্যবহার করেছি যেটা আমাদের আনন্দকে ‘উপভোগ্য’-এর পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গটা আসলেই গোয়েবলসের১৪ ‘টোটালের ক্রেইগ’ (১৯৪৩) ভাষণটার উদাহরণ দিই সব সময় যেটা প্রমাণ করে, মানুষ নিজেকে যন্ত্রণা দেয়াটাও উপভোগ্য মনে করতে পারে। ওই ভাষণেই গয়েবলস এ রকম কিছু একটা বলেছিল, ‘তোমরা কি এমন কোনো যুদ্ধ চাও যে যুদ্ধে তোমাদের এমন ভোগা ভুগতে হবে, তোমাদের সহ্যের সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করবে?; প্রটেস্ট্যান্ট সেক্সুয়ালিটিকেও একই জায়গা থেকে দেখি যেখানে এই জাতের সেক্সুয়ালিটি উপভোগ করার জন্য সবার আগে নিজের জীবনে করা পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হওয়া খুবই জরুরি। এই অনুতপ্ত হওয়াটাই হচ্ছে তোমার এনজয়মেন্টের দুনিয়ায় সারা জনমের একমাত্র টিকেট। এই অনুতপ্ত হওয়া বা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতিটাই যে কোনো কিছুকে উপভোগ করার ট্রিগারটা চেপে দেয়,কিংবা উপভোগ করার জন্য মানসিক বা নীতিগতভাবে কোনো বাধা থাকলে তা উতরে যাওয়ার জন্য অদ্ভুত একটা টনিক হিসেবে কাজ করে।১৫
ওই প্রতিটা উদাহরণের মধ্যে মৌলিক একটা ভারসাম্যহীনতা দেখছি আমরা যেখানে এই বাড়তি মূল্য (Surplus Value) টাই উপভোগ করার সব ইমেজকে আকৃতি দান করবার জন্য একটা ছবির ফ্রেমের মতন কাজ করে। এই বিষয়টা মার্ক্স নিজেও টের পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, কমিউনিজমের নামকা ওয়াস্তে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতন করেই আমরা ক্যাপিটালিজমের স্বাদটুকু নেয়ার বন্দোবস্ত করতে পারি। মানে, অযথাই ওই প্যারাডক্সের ঝামেলাটুকু মোকাবিলা করার কোনো মানে হয় না।
আমার মনে হয়, ওই ভারসাম্যহীনতাটাই ক্যাপিটালিজমের বাকি সব কাজ চালিয়ে নেয়। বরং ক্যাপিটালিজম হচ্ছে মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে যুগান্তকারী একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ওই ভারসাম্যহীনতার বিষয়টা কোনো সমস্যা তো না-ই, বরং একমাত্র সমাধান। ক্যাপিটালিজমের এও খাসলতের কারণেই মার্কসিস্টরা এই সিস্টেমটি এত অপছন্দ করে আর আশা করতে থাকে, কবে একটা বড়সড় বাজার ধ্বংস হবে আর ক্যাপিটালিজমের পতন ঘটবে। কিন্তু সব রকম বাজার ধ্বসের পর দেখা যায়, দিন শেষে কাহিনী হয় পুরোই উল্টোটা। ক্যাপিটালিজম আরো নির্মমভাবে ও নতুনরূপে ফেরত আসে। ক্ল্যাসিকাল মার্কসিস্ট আলোচনায় মনে করা হতো, প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের মধ্যেই বুর্জোয়াদের মৃত্যু সংবাদ নিহিত আছে১৬। কিন্তু দেখছি, শুধু প্রলেতারিয়ান বিপ্লবেই মুক্তির আশা খোঁজাটা খুবই ভয়াবহ। তাই আমাদের এটা মেনে নিতেই হবে, শুধু ক্ষমতা দখল করাটাই সব বিপ্লবের (এমনকি প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ক্ষেত্রেও) একমাত্র উদ্দেশ্য নাও হতে পারে।
এর মানে কি বিপ্লব কখনোই ছকে কষে সাজানোর মতো কোনো বিষয় নয়?
জিজেক : হুম, বিপ্লব কখনোই ছকে কষে সাজানোর কোনো বিষয় নয়। হেগেলও এভাবে দেখতেন। মার্কস ভেবেছিলেন, প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের তরিকা হবে খুবই স্পষ্ট যেটাতে তাদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকবে না। ইতিহাসের একটা পর্যায়ে এসে শ্রমিক শ্রেণীর কিংবা সাবজেক্ট নিজেকে এর সাথে যুক্ত করতে চাইবে। তখন তারাই বুঝে যাবে তাদের কী করা উচিত এবং ওই মুহূর্তে তারা সেটি করবেও। কিন্তু না! কোনো বিপ্লবই এত নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বা এত স্বচ্ছতার সাথে কাজ করে না। কয়দিন আগের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই আমরা তা বুঝতে পারবো। এই বইয়ের একেবারে শেষ দিকে কমিউনিজমের ক্ষণ স্থায়িত্বের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমি শুধু বিপ্লবের স্বচ্ছতা নিয়েই কথা বলিনি, বরং তাদের সাথেও দ্বিমত করি যারা বলে, কমিউনিজম মানুষের Private Life (ব্যক্তি পরিসরের উঠাবসা)-কে আরো স্বস্তিদায়ক করে তুলবে। আমার কথা হচ্ছে, কে জানে বলুন তো? হয়তো, কমিউনিজমে ব্যক্তিমানুষ তার নিজের মতো একান্তে থাকতেই পারবে না আর। তাই মার্কসবাদকে খারিজ না করেও আমরা ইতিহাসের গুরুত্ব নিয়ে আলাপ দিতে পারি যেখানে বিপ্লবগুলো হবে অস্বচ্ছ কিংবা বিপ্লবের ফল নিয়ে আমরা কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবো না।
আমরা সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের পাঠকরা যদি আপনার লেখালেখি নিয়ে আরো জানতে চান তাহলে আপনার কোন লেখাগুলো তাদের অবশ্যই পড়তে অনুরোধ করবেন?
জিজেক : প্রথমেই বলবো আমার ইভেন্টঃ ফিলোসফি ইন ট্রান্সিট নামের লেখাটা পড়ে দেখতে। এরপর যদি আরো জানার ইচ্ছা থাকে তাহলে এবসল্যুট রিকয়েল বইটা পড়ে দেখতে পারেন। আমার কাছে দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে প্লেটো, দেকার্ত আর হেগেলকেই সবচেয়ে বড় তিন ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়। কেন জানেন? কারণ তারা প্রত্যেকেই নিজেদের সময়ে দর্শনের জগতে পুরো নতুন একটা চিত্রকল্প তৈরি করে দিয়েছিলেন। ফুকো কোথায় যেন বলেছিলেন, ‘সমগ্র দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসের সারসংক্ষেপটাই তো প্লেটোর সমালোচনার ইতিহাস, তাই না?’ দেকার্ত আসার পরও একইভাবে সবাই দেকার্তকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ওই একই কথা হেগেলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্যি। তাই এই তিনজনকে এক সঙ্গে নাম দিয়েছি, ‘ফিলোসফার্স অফ এন ইভেন্ট’।
অনুবাদকের টীকা
১. ফিচার বলতে আমি থিওরির মেটা-ন্যারেটিভগুলোকেই বুঝি। যেমন- মার্কসের পুরো থিসিসটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বেইস স্ট্রাকচার আর সুপারস্ট্রাকচারের মেটা-ন্যারেটিভ। আবার ফ্রয়েডের মেটা-ন্যারেটিভ হতে পারে ইড, সুপারইগো আর ইগোর ধারণা কিংবা ফুকোইয়ামার ক্ষেত্রে আছে ‘এন্ড অব হিস্ট্রি’র ধারণা।
২. থিওরির সংজ্ঞা খুঁজতে না চেয়ে বরং থিওরিকে যদি চশমার ফ্রেমের সাথে তুলনা করি তাহলে বলবো, জিজেক সব সময় দুটি চশমা পকেটে নিয়ে ঘোরেন। একটা হেগেলের আর অন্যটা লাঁকার ফ্রেম। এই দুটি থিওরেটিকাল ফ্রেমওয়ার্কের বোঝাপড়া না থাকলে জিজেক বোঝাটা হয়তো বেশ কঠিন।
৩. জিজেক এখানে জার্মান ভাববাদের কথা বলতে চেয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছে। পটভূমির অংশটুকু বাদ দিলে কান্টের Critique of Pure Reason থেকেই জার্মান ভাববাদের পথচলা শুরু হয়েছিল বলে মনে হয়। এরপরের কাজটুকু এগিয়ে নিচ্ছিলেন ফিকটে, শেলিং আর হেগেল। তবে তাদের প্রত্যেকের সাথে যে প্রত্যেকের ফারাক আছে সেটি হেগেলের লেখা The Difference Between Fichte’s and Schelling’s System of Philosophy বইটা পড়লেই বোঝা যায়।
৪. হেগেল ফিলোসোফিকে যেভাবে দেখতেন,তা অক্সফোর্ড প্রকাশনী থেকে হেগেলের অনুবাদ বই Philosophy of Right-এর ভূমিকার অংশটুকুতেই পাওয়া যায়। বইয়ের ১৩তম পৃষ্ঠায় এই বাক্যটা নক্স অনুবাদ করেছিলেন এভাবে যে, The owl of Minerva spreads its wings only with the falling of the dusk যেখানে হেগেল দর্শনের মাধ্যমে সমাজকে নতুন রূপ দেয়ার চেয়ে শুধু বর্তমান বোঝার পক্ষপাতী ছিলেন। মার্কস সেখানে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, The philosophers have only interpreted the world, in various ways. The point, however, is to change it.
৫. পরম-উদ্দেশ্য বলতে Ontology বোঝাচ্ছি। যে কোনো একটা ঘটনার বা event-এর কার্যকারণের পরম্পরাগুলো খুঁজে দেখলে সাবজেক্ট-এর সত্তা (being), রিয়ালিটি ইত্যাদি বিষয়ে জানার প্রয়োজন হয়। এই পরম-উদ্দেশ্যের জায়গা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করলে মানবমুক্তি নিয়েও নানান প্রশ্ন তৈরি হয় যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কাজ হচ্ছে দর্শনশাস্ত্রের Ontology নামের অংশটুকুর। অন্টোলজির কয়েকটা অধিক আলোচিত প্রশ্ন এরকম- ‘সত্তা কি?’, ‘বস্তুর অস্তিত্বশীল হওয়ার কারণ কি?’ ইত্যাদি।
৬. জিজেক এখানে অনেকটা জ্যেল দিল্যুজের মতন অবারিত বা Open-ended ভবিষ্যতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। মার্কসকে যারা কনফর্মিস্ট বলে দাবি করেন (যদিও আমার তা খুব কমই মনে হয়েছে) তারা দিন শেষে ফুকো কিংবা দিল্যুজের কাছে আশ্রয় খোঁজেন। আসলে আমার কাছে মনে হয়, মার্কস আর হেগেল দুজনই সব সময় যে কোনো বিপ্লবকে একটা নির্দিষ্ট historical order (ঐতিহাসিক পর্যায় বা ক্রম)-এর অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মার্কস এই জায়গার সংকটটা mode of production-এর পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে দেল্যুজ কখনোই ক্রিটিক-এর এই বাচ্চাকাচ্চাদের মতন করে সবকিছুকে totalising বা সমগ্রতাকরণে রাজি ছিলেন না। আর ’৬৮-র আন্দোলন, ইরানি বিপ্লব কিংবা ব্ল্যাক প্যান্থারের উত্থানের পর সারা বিশ্বের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, ওই মুহূর্তে এমন একরোখা totality-র বা সমগ্রতার কথায় সায় দেয়াও তাদের জন্য মুশকিল ছিল। তাই দিল্যুজ আর গাট্টারি দুজনই সব সময় তাদের social machine-এর কনসেপ্টে ফিরে আসতেন (দেখুন Choat, Deleuze Studies, vol 3) যেখানে কিছুদিন আগে ভাইরাল হওয়া ‘বৈষম্য’ ভিডিওটাও দিল্যুজিয়ান অর্থে একটা মেশিন হতে পারে। কনফর্মিস্ট মানুষজন হয়তো এসব ভার্চুয়াল কন্টেন্টকে ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘উপকারি’, ‘অপকারী’ বলে এড়িয়ে যাবে। কিন্তু নন-কনফর্মিস্ট মানুষজন ওই একই কন্টেন্টের মাধ্যমে সমাজে অন্যদের সাথে নারী-অধিকার নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর একটা উসিলা খুঁজে পাবে।
৭. দেখুন http://occupywallst.org/
৮. ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি নিয়ে জেরেমি রিফকিন এবং জোহান স’ডারবার্গ-এর কপিরাইট বিষয়ক আলোচনা দেখুন https://www.theguardian.com/commentisfree/2014/mar/31/capitalism-age-of-free-internet-of-things-economic-shift এবং http://firstmonday.org/article/view/938/860। তবে এখানে টরেন্টর একই সাথে ফাইল শেয়ারিং ও ডাউনলোড পদ্ধতির কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে।
৯. গ্লোবালাইজেশনের ফলে অনুন্নত দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না এবং বেকারত্বের ও বৈষম্যের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অর্থনীতির ভাষায় এটিকে Infant Industry Argument বলা হয়। Brexit-এর কেইস স্টাডিটা এর একটা উদাহরণ। এটা গ্লোবালাইজেশনের বেশ পরিচিত একটা রেটোরিক হওয়াস্বত্ত্বেও জিজেক এই সংকটকে দেখছেন পরবর্তী ডায়ালেক্টিকে যাওয়ার একটা অংশ হিসেবে।
১০.Critique আমাদের শেখায়, আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে আভাস পাই তাকে Sense-datum বলে। আর এই আভাস থেকেই আমরা যে কোনো জড়বস্তুর (material thing) কল্পনা করি বা construct করি। ফলে এই জ্ঞানলাভের বিষয় (subject) যেটাই হোক না কেন, এই ন্যূনতম অভিজ্ঞতাটা না থাকলে জ্ঞানলাভ করা অসম্ভব। এই জ্ঞানলাভের সময় আমাদের মনের মধ্যে যা যা উপস্থাপিত হয় তাকেই Appearance(জার্মান ভাষায়, Erscheinung) বলা হয়। Critique-এ তিনি বলেন, … that which is called substance in appearance things are not as they would be with a thing in itself which one thought through pure concepts of the understanding. তবে A prioricognition নিয়েও তিনি কম চিন্তিত নন। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই কান্টের appearance শব্দটির অনুবাদ করেছেন অবভাস, প্রতিভাস ইত্যাদি। ওই দায়টুকু এড়ানোর জন্য ‘appearance’ শব্দটি ইংরেজিতেই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরো জানতে দেখুন, Critique of Pure Reason(1781), কান্টের দর্শন (১৯৭৯), Kant’s Critique of Pure Reason within the Tradition of Modern Logic (1994)।
১১. আমাদের রিয়ালিটি হচ্ছে অজস্র সংবেদনশীল অভিজ্ঞতার (understanding) সমাহার অর্থাৎ Reality (Realitdt) is in the pure concept of the understanding that to which a sensationed in general corresponds, that, therefore, the concept of which in itself indicates a being (in time)।(A143/B182) দেখুন Critique of Pure Reason (1781)।
১২. হেগেল-এর Logic-এ সাবজেক্টের প্রথম ত্রয়ীটা ছিল সত্তা (Being), সত্তাসার (Essence) এবং প্রত্যয় (Notion)। সত্তাসারের ত্রয়ীটা ছিল সত্তাসার (Essence as Ground of Existence), প্রতিভাস (Appearance), প্রকৃতত্ব (Actuality)। বোঝাই যাচ্ছে, হেগেল appearance-কে ডায়ালেক্টের অংশরূপে বিবেচনা করতেন, কান্ট আর হেগেলের পার্থক্যটা মূলত এ জায়গাতেই। দেখুন Science of Logic (1816)।
১৩. অনিশ্চয়তা বা uncertainty কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোনো দুর্বলতা নয়, বরং ওই অনিশ্চয়তাটাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। তবে এখানে অনির্ণেয়তা, অসম্ভাব্যতা ও অসম্পূর্ণতা শব্দগুলো ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৪. গয়েবলস নাৎসি রাজনীতিবিদ। হিটলারের মৃত্যুর পর তিনি একদিনের জন্য জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। এমনকি রোমান্টিক সাহিত্যের ওপর তিনি ডক্টরেট উপাধিও পেয়েছিলেন। তার Totaler Kreig ভাষণের ইউটিউব লিংকটি সংযুক্ত করা হলো (https://youtu.be/JUZBQg4Z1JE)।
১৫.যে কোনো এনজয়মেন্টের পেছনে ওই অনুতপ্ততার অনুভূতি খুবই অপরিহার্য। তা হোক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, গুলাগ কিংবা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয়। হলে ওঠা নবাগত ব্যাচের একটা শিক্ষার্থীকে যখন বলা হয় ‘ক্যাম্পাসের কুত্তারে সালাম দিবি, কারণ ওই কুত্তার ক্যাম্পাস-লাইফ তোর থেইকা বেশি! তখন নবাগত শিক্ষার্থীর মধ্যে এই অনুতপ্ততার অনুভূতিকেই ট্রিগার করার চেষ্টা করা হয়। ফলে পরবর্তীকালে এই নবাগত শিক্ষার্থীই হয়ে ওঠে পরবর্তী বছরে র্যাগিং নামক নিপীড়নের কঠিন সমর্থক। আরো জানতে চাইলে দেখতে পারেন The Sublime Object of Ideology (1989)।
১৬. মার্কস-এঙ্গেলস এর কথার এই অংশটুকু কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো (১৮৯৩)-এর প্রথম অধ্যায়ের পৃষ্ঠা ৩৫-এ এভাবে দেয়া আছে যে, ‘যাতে (যাহাতে) বুর্জোয়া শ্রেণীর মৃত্যুবাণ রয়েছে, শুধু সেই অস্ত্রটুকুই সে গড়েনি; এমন লোকও সে সৃষ্টি করেছে যারা সে অস্ত্র ধারণ করবে, সৃষ্টি করেছে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী, প্রলেতারিয়েতদের।’