বিশ্বখ্যাত রাজনীতিবিদদের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড

বিশ্বখ্যাত রাজনীতিবিদদের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল বলেছেন, “বাকি সব শাসনতন্ত্র বাদ দিলে গণতন্ত্র হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ শাসন ব্যবস্থা।” আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, গণতন্ত্রের ভুল থাকা সত্ত্বেও অন্য শাসনতন্ত্রের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার ধরতে পারার মতো সক্ষমতা আমরা রাখি না। তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কেননা সচরাচর গণতান্ত্রিক কোনো সরকারকে দেখা যায় না কোনো সাংবাদিক গুপ্তহত্যার সুষ্ঠু বিচার করতে বা জনগণের টাকায় বিলাসিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। এসব যখন হরহামেশাই ঘটছে, এসবের চেয়েও এককাঠি এগিয়ে ক্ষমতার জোরে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান অবিশ্বাস্য রকমের কিছু উদ্ভট কাজ করে থাকে। এমনই কিছু নজির ‌জবান’-এর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো–

 

প্রধানমন্ত্রী অবস্থায় রাষ্ট্রপতির ছেলেকে অপহরণ, পরে নিজে রাষ্ট্রপতি হয়ে নিজের জন্য ক্ষমা ঘোষণা

ভ্লাদিমির মেসিয়ার। Image: hlavnespravy.sk

স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির মেসিয়ার এক উদ্ভট কাজ করেন রাষ্ট্রপতির ছেলেকে অপহরণ করিয়ে। তিনি সিক্রেট সার্ভিসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মাইকেল কোভাক-এর ছেলেকে অপহরণ করেন এবং নির্যাতন করে অস্ট্রিয়ায় ফেলে আসেন। অপহরণের কথা শুনে মারা যান রাষ্ট্রপতি কোভাক। ফলে একাধারে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বর্তায় মেসিয়া-র ওপর। দায়িত্ব নিয়েই আরো উদ্ভট কাজের নজির স্থাপন করেন তিনি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ব্যবহার করে নিজেকে এবং অপহরণের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা প্রদান করেন! এতে আইনত আদালতেরও কিছু করার ছিল না। এর এক বছর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে স্লোভাক সংসদ মেসিয়ারের ওই রাষ্ট্রীয় ক্ষমা রদ করতে ভোট দেয়। অবশ্য রদ হয়নি এখনো।

 

বার্লুসকোনি সেটিই করেছেন যে কাজে তিনি সেরা

সিলভিও বার্লুসকোনি। Image: abc.net.au

যদি প্রশ্ন করা হয় মাতাল কোনো জোকারকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বানান তাহলে কেমন হবে? এর উত্তরে বলা যায়, বার্লুসকোনিকে দেখলেই হয়। দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারিতে তার এতই দুর্নাম হয়েছিল যে, নতুন কোনো ঘটনাই আর ইতালির জনগণকে অবাক করতো না। কিন্তু তিনি আবারো সবাইকে অবাক করিয়ে দেন যখন তার প্রিয় যৌন কর্মীদের মধ্যে একজন রুবিকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য নিজে পুলিশ স্টেশনে টেলিফোন করেন। ইতালির মিলান শহরে খদ্দেরের সঙ্গে যৌনকর্মী রুবিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বার্লুসকোনি তখন ফোন করে রুবিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মিশরের রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারকের সঙ্গে নাকি রুবির যোগাযোগ ছিল। তাই টেলিফোন করেছেন তিনি। এই ব্যাখ্যাটি মিথ্যা ছিল। কেননা রুবি মিশরীয় ছিলো না, বরং মরক্কান ছিলো।

 

বোরিস ইয়েসিন পাঁচ মাসে ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী বদলান

বোরিস ইয়েসিন। Image: sputniknews.com

রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েসিন সব সময় সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতে ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করতে চাইতেন। তার ওই চরিত্রের জন্য পশ্চিমা সমাজ তাকে নিরীহ মাতাল ভাবতে শুরু করে এবং রাশিয়াকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করতে থাকে। এমন সময় বোরিস ইয়েসিন ১৩ মাসের মধ্যে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন অর্থাৎ প্রতি আড়াই মাসে একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন তিনি। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ দেখা গেলেও পরে বোঝা যায় তা রাজনৈতিক ছিল না। আসলে বরখাস্ত করতেন হিংসার বশবর্তী হয়ে। তিনি মনে করতেন, তার আকর্ষণ চুরি করবেন প্রধানমন্ত্রী।

 

জিমি কার্টার এক যৌন নিপীড়নকারীকে ক্ষমা করে দেন

জিমি কার্টার। Image: Department of Defense

বিচার প্রক্রিয়ায় শেষ মুহূর্তের রাষ্ট্রীয় ক্ষমাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কিত হয়ে থাকে। বিল ক্লিনটন এক ধনাঢ্য ঋণখেলাপিকে ক্ষমা করে দেন, বুশ ক্ষমা করেন ইরান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত আর্মি জেনেরালদের। কিন্তু সবচেয়ে বিতর্কিত কাজটি ছিল জিমি কার্টার যখন পিটার ইয়েরোকে ক্ষমা করেন। পিটার ইয়েরোকে বন্দি করা হয় ১৪ বছর বয়সী কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের দায়ে। তার শাসনের শেষ দিনে ওই রাষ্ট্রীয় ক্ষমা দান করেন। ইয়েরো ছিলেন ফোক গায়ক। কার্টারের পছন্দের ঘরানার গান গাইতেন তিনি। তাই যৌন নিপীড়ক ইয়েরোকে ক্ষমা করে দেন কার্টার।

 

হাঙ্গেরির ফুটবলভক্ত প্রধানমন্ত্রীর কোটি কোটি ডলার ব্যয়

ভিক্টর অর্বান। Image: theglobalist.com

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এতটাই ফুটবলভক্ত ছিলেন যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতেন দেশজুড়ে নিত্যনতুন স্টেডিয়াম তৈরি করতে। নতুন মাঠ নির্মাণ করা অবশ্য ভালো দিক। তবে তিনি এমন সব জায়গায় স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন যেখানে খেলা দেখার মানুষই নেই। নিজ গ্রামে তিনি বড় স্টেডিয়াম তৈনি করেন যে, সেখানে আশপাশের সব গ্রামসহ শহরের মানুষ এলেও স্টেডিয়াম দর্শকপূর্ণ হবে না। ওই অপব্যয়ের তকমা থেকে বাঁচতে মন্ত্রিসভার সবাইকে তিনি জোর করে স্টেডিয়ামে পাঠাতেন স্থানীয় দলের খেলা দেখতে।

 

রিচার্ড নিক্সন সাংবাদিককে মারার জন্য গুপ্তহন্তারক লাগান

রিচার্ড নিক্সন। Image: businessinsider.com

যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা দুনিয়ার তাবৎ সাংবাদিকরা অনেক সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ট্রাম্পের সঙ্গে সংবাদ সংস্থার বৈরি সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু এখনকার বিরোধ নস্যি মনে হবে তারই পূর্বসূরি রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরোধতার নজির দেখলে। তাকে বলা হয় অামেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি। সত্তরের দশকে নিক্সন প্রায় যুদ্ধই ঘোষণা করেন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে। তিনি গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইকে ব্যবহার করেন সংবাদমাধ্যমগুলোর বিপক্ষে এবং বিভিন্ন সংবাদ নেটওয়ার্কের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দেন। এমনকি তিনি এক রিপোর্টারকে গুপ্তহত্যার কথাও ভাবেন। রিপোর্টার জ্যাক এন্ডারসন একটি সংবাদ পাওয়ার জন্য শুধু সাংবাদিকের নৈতিকতাই ভঙ্গ করেননি, একই সঙ্গে এমন কিছু তথ্য হাসিল করেন যার দ্বারা নিক্সন ক্ষমতাচ্যুতও হতে পারতেন। তখন নিক্সন হুকুম দেন সাংবাদিকের গুপ্তহত্যা করতে। ওই যাত্রায় জ্যাক এন্ডারসন বেঁচে যান শুধু নিক্সনের গোপন দল তখন ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল নিয়ে কাজ করছিলো বলে।

 

হুগো শাভেজের ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ টিভি শো

ভেনিজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ। Image: qz.com

প্রথম দিকে হুগো শাভেজ-এর গণতান্ত্রিক সরকার ছিল ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। কিন্তু স্বৈরাচার ছিলেন না তিনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর একটা টিভি শো শুরু করেন যেটি চার ঘণ্টা ধরে চলতো এবং তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তিনি সরাসরি শোতেই নিতেন। ওই অনুষ্ঠানের একটি অংশ ছিল যেখানে শাভেজ মার্চ করে কোনো ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে যেতেন এবং বলতেন ‘এক্সপ্রপ্রিয়েট’- এর অর্থ দাঁড়ায় ‘দখলচ্যুত করো’। আরেকটি অংশে দেখানো হতো তার দেশের নাগরিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে ফোন করলে সমাধান দিয়ে দেন। সবচেয়ে অদ্ভুদ কাণ্ড ঘটে ২০০০ সালের একটি শো’তে, যখন তাকে একজন প্রশ্ন করেন ইকুয়েডরের এফএআরসি-এ লক্ষ্য করে কলোম্বিয়ার বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে ভেনিজুয়েলা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কলোম্বিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এমন শো’কে ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক শো’ বলা যেতেই পারে।

 

ব্রিটিশ চ্যান্সেলর ধনাঢ্য প্রতিবেশীদের বাড়ি বাঁচাতে রেল পথ ঘুরিয়ে দেন

জর্জ অসবর্ন। Image: newstatesman.com

হাই স্পিড-২ (HS-2) ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও বিতর্কিত পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে একটি। এটি উচ্চগতি সম্পন্ন ট্রেন। এর সম্পূর্ণ গতিলাভের জন্য সোজা পথ দরকার ছিল। সোজা রেললাইন করার জন্য বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়, এমনকি ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে নিতে হয়েছে রেললাইন। কিন্তু বিপত্তি হয় যখন লাইনটি তৎকালীন চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন-এর এলাকা বরাবর আসে। তখন তা বাঁকা করিয়ে দেন যেন তার ধনাঢ্য প্রতিবেশীরা ক্ষেপে না যায়। অবশ্য চ্যান্সেলর দাবি করেন, তা পরিকল্পনার অংশই ছিল। এত কিছু গুঁড়িয়ে যে সোজা লাইনটি আসছিল তা হঠাৎই বেঁকে যায় তার বন্ধুদের খুশি করতে।